
নবম পর্ব:
আমার অস্থিরতার মাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। ইদানীং হুইস্কিতে আর কাজ হচ্ছে না। মাতাল অবস্থায় সামান্য একটু মৌজে থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই চরম বিষাদ আর অস্থিরতা আমাকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে আর কিছুতেই লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে পারি না। আমার তো স্কুলে যাওয়া হলো না। যা-কিছু পড়াশুনা তা বাসায় বসেই করতে হবে। মা বলেছে, বাংলা পড়ে শেষ করতে। মা এরই মধ্যে আমাকে শিক্ষিত করে তোলার জন্যে একটা প্লান করে ফেলেছে। প্রথম শিখবো বাংলা। তারপর ইংরেজী, তারপর অঙ্ক, বিজ্ঞান, সমাজ, পৌরনীতি, ধর্ম এমন অনেক নামই শুনলাম। এখন সবগুলো মনে নাই। পরে সময় করে বলবো। প্রত্যেক বিষয়ের জন্যে সময় বরাদ্ধ এক বছর। আচ্ছা, মা তো বললো এক বছর, কিন্তু এটা কি উনার এক বছর, না আমার এক বছর? মার হিসাবে যদি বছর ধরে পড়তে হয় তাহলে তো মরার আগে সব সাবজেক্ট শেষ করে মরতে পারবো না! পড়তে বসলেই কেমন যেন অস্থির লাগে। ডাক্তার তো আর পেগও বাড়াচ্ছে না সেই কতদিন হয়ে গেল। আমি তো ঠিকই ধেই ধেই করে বেড়ে চলেছি। দুই পাতা পড়তে-না-পড়তেই মাথা ভোঁ ভোঁ করে। মনে হয় উঠে দৌড় লাগায়। তখন আর কিছুই ভাল্লাগেনা। টিভি দেখা, মুন্নির সাথে গল্প করা বা মার সাথে ফোনে কথা বলা কিছুতেই শান্তি পাই না। কী করলে কিছুটা শান্তি পাবো তাও বুঝে উঠতে পারি না। অস্থিরতার মুহূর্তগুলোতে টিভি, মুন্নি, এমনকি মাকেও বিরক্ত লাগে; কাউকেই সহ্য হয় না। মা বাসায় না থাকলে মুন্নিই তো একমাত্র বন্ধু আমার, যার সাথে সুখদুখের দুইটা কথা বলা যায়। কিন্তু তখন ও কেমন যেন হামবড়েঙ্গা কথাবার্তা বলে। শুনলে মেজাজ আরো তিরিক্ষি হয়ে উঠে। তখন ওকে বেশী চালাক মনে হয়, আবার পরক্ষণেই মনে হয় বোকা। মনে হয় সবই বোঝে, কিন্তু কাজ করে সব অবুঝের মতো। নাকি ও আমার মতো অস্থিরতায় ভুগছে। আমি না হয় বয়স্ক ছোট মানুষ, অসুস্থতার কারণে অস্তিরতায় ভুগছি, কিন্তু ও তো সত্যিকারের বড় মানুষ, বয়সেও বড়! ও কেন আমার মতো অস্থিরতায় ভুগবে? কে জানে হয়তো ওরও অন্যরকম সমস্যা আছে যা ও বলবে না কারো কাছে। নানারকম মানুষের মনে হয় নানারকম ঝামেলা। কেউ কারো সাথে শেয়ার করবে না। শেয়ার করতে গেলে আবার কোন ঝামেলা থেকে কোন ঝামেলা হয় তার কোনো ঠিক আছে নাকি। তার চাইতে চুপ থাকা অনেক ভালো। আর কথা যদি বলতেই হয় তো এমনভাবে বলো যেন কেউ বুঝতে না পারে ইউ আর ইন ট্রাবল। বুঝতে পারলেই সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে। মা যখন ফোনে তার বান্ধবীদের সাথে কথা বলে তখন দেখি, যদি সুখের কথা বলে, বলে যে সবকিছু ভালো চলছে, সবকিছু ঠিকঠাক ফিটফাট, তাহলে আর কথা আগায় না। যদি সমস্যার কথা বলে, বলে আমার অসুস্থতা নিয়ে উদগ্রীব তখন আর যেন কথা শেষই হতে চায় না। অপর প্রান্তের আন্টির চোখে তখন রাজ্যের চকচকানি। মাকে তখন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে প্রশ্ন করা হয় মিকাইল ফেরেশতার মতো। আর মাও তখন আগুনের মতো দগদগে লাল জলন্ত পাথরের উপর দাঁড়িয়ে একটার পর একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ না উনার পাপের স্খলন হয়।
আমার অস্তিরতাও তখন শতগুণ বৃদ্ধি পায়। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে মার অস্তিরতা। আমার খুব ভয় হয় ইদানীং। মা যদি পাগল হয়ে যায়। মাকে আমি পাগল হিসাবে দেখে যাব দুনিয়াতে ভাবলেই আমার হুইস্কির নেশা ছুটে যায়। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। তখন কিছুতেই আর শ্বাসপ্রশ্বাস সচল রাখতে পারি না। মনে হয় বুকের মাঝে ধুলোয় ঠাসা বাংলাদেশটা চেপে আছে। বুকের উপর দাঁড়িয়ে আছে ১৮ কোটি মানুষ। একবার, শুধু একবার একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়ার জন্যে, কিন্তু কিছুতেই পেরে দিচ্ছি না। কিছুতেই এই ছোট্ট বুকে আটকাপড়া দমটাকে বাইর করতে পারছি না। যতই চেষ্টা করছি, ছটফট করছি, পরিস্থিতি যেন ততই খারাপের দিকে যাচ্ছে, যেতে যেতে মরে যাব-যাব করি কিন্তু শেষ পর্যন্ত মরি না। আবার পুরোপুরি দমফুটাটা পরিষ্কার হযে বাইরও হয় না। সামান্য একটু বাইর হয়ে আবার কষ্টকে দ্বিগুণ করে দিয়ে বুকের মধ্যে আটকা পড়ে এবং এই শ্বাসকষ্টটা চলতে থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। আমি অনেক চেষ্টা করি মা যেন আমার এই কষ্টটা টের না পান। কিন্তু কী আশ্চর্যের ব্যাপার, মা সবকিছু আমার আগেই টের পেয়ে যান। আমার বুকের কষ্ট যেন মার বুকে জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। আমার অস্থিরতা দেখে মার পাগল হওয়ার দশা, আর মা পাগল হয়ে যাবে ভাবলেই মৃত্যু এসে আমাকে তার হিমেল কম্বল দিয়ে জড়িয়ে ধরে, যেমন হাসপাতালে দর্জাল নার্স আমাকে একটা তারেবোনা টাওয়েল দিয়ে পেঁচিয়ে মমি বানিয়ে রেখেছিল। আমি শত চেষ্টা করেও নড়াচড়া করতে পারছিলাম না।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে সদ্য জন্ম নেয়া অনেক শিশুর মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তাই তারা ইদানীং শিশুর মা-বাবাকে পরামর্শ দিচ্ছে শিশুকে শক্ত টাওয়েল দিয়ে মুড়িয়ে মমি বানিয়ে রাখতে, যেন সে নাড়াচাড়া না করতে পারে। কেননা তারা তাদের পা দিয়ে, কখনও-বা হাত দিয়ে বুকে ঘুসি মেরে নিজেকে মেরে ফেলে। আবার কখনও-বা নিজেকে উল্টিয়ে ফেলে দম আটকিয়ে মারে। তাদের এই প্রবণতা সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে, শিশু জন্মের আগেই বুঝে যায় এই দুনিয়া হবে তার জন্যে সাংঘাতিক রকমের ভোগান্তির জায়গা। তারা দুনিয়াতে এসে খুশি না। তাই তাড়াতাড়ি চলে যেতে চায়। সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে আমারও তাই মনে হয়েছিল, এখনও হয়। শুধু মার কথা চিন্তা করে আমি এই সুকর্ম, বা কুকর্মও হতে পারে, থেকে বিরত থাকি। এখন আর আমি মরতে পারি না, চাইলেও পারি না। শুধু মা কষ্ট পাবে বলেই পারি না। আমার এই অভাগিনী মাকে একটু স্বস্তিতে রাখার জন্যে হলেও আমি হাবিয়া দোজখে হাসিমুখে পার করে দেবো সারাটা জীবন।
মা তো আমাকে একটু শান্তি দেয়ার চেষ্টার কোনো ত্রæটি রাখছে না। গত এক বছরে ঢাকা শহরে এমন কোনো ডাক্তার নাই যার কাছে মা আমাকে নিয়ে যায়নি। শুধু ডাক্তার বলছি কেন, এমন কোনো কবিরাজ, বৈদ্য, তান্ত্রিক, নিউরোসার্জন, মৌলানা, পীর, ফকির, সন্ন্যাস, বুদ্ধিজীবি, মনোবিজ্ঞানী, এমনকি একজন কবিডাক্তার আমাদের তার এক প্রিয় কবির কাছে নিয়ে গিয়েছিল। উনি ডাক্তার না, তবে চিন্তাবিদ। সবকিছু নিয়েই তিনি গভীরভাবে চিন্তা করতে ভালবাসেন। তিনি নাকি মানুষ নামের ফেরেস্তা। উনার পরশে যাদু আছে, কথায় আছে বেহেস্তি সুরার নহর। উনি অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলে আমাকে খুশি করার চেষ্টা করেছিল, হাসানোর চেষ্টা করেছিল। উনার কথা হলো, কেউ যদি হাসতে পারে তাহলে সে অসুস্থ না, সাময়িক শরীর খারাপ। সময় দিলে শরীর নিজেই ঠিক করে নেবে নিজের এই সমস্যা, চিন্তার কিছু নাই। ওষুধপথ্য খাওয়া যেতে পারে, তাতে শরীর তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে বলে ডাক্তররা বলে। তবে এইসব কৃত্রিম ওষুধের ক্ষতির দিকটিও কিন্তু কম না। এটা নদীর এপার ভেঙ্গে ওপার গড়ার মতো অবস্থা। ডাক্তাররা শুধু ভুলে যায় যে দুপারই আমার। উনি আমাদেরকে উনার লেখা কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন। মাকে বলেছিলেন কবিতা পড়তে। কবিতা নাকি মানুষের মনোকষ্ট দূর করার মহৌষধ। উনি বিখ্যাত বিখ্যাত কবির উদ্বৃতি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন কবিতার মহত্ব ও মহিমা। আমি উনার সামনে বসে খুব মনোযোগ সহকারে এইসব শুনলেও এখন আর কিছুই মনে করতে পারছি না। তবে এইটুকু মনে আছে যে উনার কথাগুলো সুন্দর। যদি সত্যি হয় তাহলে আরো সুন্দর। তবে মিথ্যাই-বা বলবো কেন? সবার কাছে তো আর একই জিনিস সত্যি না? যার-যার সত্য তার-তার মতো। এই যেমন মার সত্য মুন্নির সাথে মেলে না। আবার আমার সত্য খবিশের সাথে। কয়েকদিন আগে মবিন সাহেব একটা বক্তৃতা দিয়েছিল সত্য-মিথ্যা নিয়ে। সত্য-মিথ্যা নাকি ব্যক্তির নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করে। এটা ব্যক্তির শিক্ষার ব্যাপার, জানাশোনার ব্যাপার। চারদিকে নানারকম মিথ্যা দেখি মানুষ মহাসত্য বলে মেনে নিচ্ছে। কোনদিন প্রশ্নও করে নাই কেন আমি বিশ্বাস করবো তোমার কথা, কেন মনে করবো তুমি যা বলছো তা সত্যি। আমারও তোমার মতো একটা সত্য-মিথ্যার আদালা জগৎ থাকতে পারে। সেই জগতের সাথে কারো মিল থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। আজব ব্যাপার, কিছু কিছু মহামিথ্যা যুগযুগ ধরে সত্য বলে টিকে আছে। সেইসব মহামিথ্যা-প্রচারকারীরা অবশ্য মনে করে ওরা যা করছে তাহাই একমাত্র সত্য। জগতে আর কোনকিছুই সত্য না, তাদের এই ধ্যানধারণা ছাড়া। তারা তাদের এই মহামিথ্যা প্রচারের জন্যে সবই করতে পারে। এমনকি অন্যকে খুনও করতে পারে সত্যের নামে। তাদের কথা বিশ্বাস না করলে তাদের ধ্যানধারণা মেনে না নিলে নির্ঘাৎ মৃত্যু। কী আজব দুনিয়া রে বাবা! এই জন্যেই আমার মনে হয় মানুষের সত্য-মিথ্যা তার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ের সাথে জড়িত। তারা সেই স্বার্থ আদায়ের হাতিয়ার হিসাবে নিজস্ব ধ্যানধারণা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয় মহত্বের নামে, সত্যের নামে, ধর্মের নামে, উন্নতির নামে, শিল্পের নামে, সংস্কৃতির নামে, আরো কত কী!
বাহ, ভালোই তো নেশাটা ধরেছে দেখছি! মাথা বেশ খুলে গেছে। উনি যা বলেছিল তার প্রায় সবই দেখি হুবহু মনে আছে। মা এখন বাসায় নেই। চাকরি শুরু করবে বলে বসের সাথে দেখা করতে গেছে। মুন্নিও এই ফাঁকে হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে টাঙ্কি মারছে। কারণ আমি এখন ওকে দেখছি না। এই-ই করে ও ফাঁক পেলে। মা আর খবিশ যখন বাইরে যায় মুন্নি প্রথমে একটু সাজুগুজু করে তারপর বারান্দায় যায়; ঘরে আসে, আবার বারান্দায় যায়। এই করে করে যখন মোটামুটি কাহিল তখন যায় ওর মা-বাবা আর ভাইয়ের সাথে কথা বলতে। আমাকে কিছু বলে না, কিন্তু আমি বুঝি, আর ওর কথাও আমি শুনি। মার সাথে কথা বলে বাবার সাথে কথা বলে, ভাইকে আদর করে। কী খাবে জিজ্ঞেস করে। এই রকম নানা কথা বলে, আবার মাঝে-মধ্যে হাসাহাসিও করে। মুন্নিকে একদিন বলতে হবে ওর মা-বাবার সাথে আমার দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্যে। আমি শুনছি, ও কিন্তু আমার গল্পই বেশী করে। আমি কী খাই, কী পরি। মদ খাই এই কথাও মনে হয় ও কইছে ওর মা-বাবার কাছে। মা কিন্তু ওরে নিষেধ করছে আমার মদ খাওয়ার কথা কাউকে বলতে। কিন্তু ও তো মার এই কথাটা শুনলো না। অবশ্য ও মার কোন কথাই শোনে? সামনে ভাব দেখায় খুব শুনতেছে। একটু আড়ালে গেলেই ও তখন ভাব নেয় মহারাণীর।
চলবে।