মাতাল শিশু (চতুর্থ পর্ব)- মোয়াজ্জেম আজিম (ধারাবাহিক উপন্যাস)

  
    
মোয়াজ্জেম আজিম

চতুর্থ পর্ব:

হঠাৎ করে খবিশের এক নতুন পরিচয় আমাদের সামনে উন্মোচিত হলো। আমি, বিশেষ করে মা, একেবারে থ। আমি বিস্মিত হব কিনা বুঝতে পারছি না। অবশ্য আমার অনুভূতি নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যাথা নাই। আমার আনন্দ-বেদনা প্রকাশ নিয়েও কারো কোনো কথা নাই। সবাইকে কাঁদতে দেখেও যদি আমি হাসি তাও কেউ মাইন্ড করে না। এদিক থেকে সুবিধাজনক একটা অবস্থানে আছি। আমার অনুভূতিও সবার সাথে মেলে না। অন্যরা যখন হাসে তখন ব্যথায় আমার বুক ফেটে যায়। আবার যখন কাঁদে তখন হাসিতে পেট ফেটে যায়। বেশিরভাগ মানুষেরই কার্যকারণের কোনো আগামাথা বুঝি না। কে যে কোন কারণে কী করে আল্লামালুম! জগৎ এত রহস্যময় ভাবতেই বড় ভালো লাগে।
আমি তো আর দশটা মানুষের মতো না। জন্মের আগেই ২৮৭ পত্রিকা মুখস্ত করেছি। আগের দিনে হলে কোরআন মুখস্ত করতাম, হয়ে যেতাম বড়পীর। আমার মা তো আর কোরআন পড়েনি। আমিও কোরআন শেখার চান্স পাইনি। তবে পত্রিকাই এখন মানুষের জ্ঞানের আধার। মানুষ পত্রিকা পড়ে নিজেকে মহাজ্ঞানী মনে করে। খবিশও তাদের মধ্যে একজন। অথচ আমি যতদিন ধরে পৃথিবীতে আছি আর খবিশকে যতটুকু চিনি তাতে সে একজন পুরুষবেশ্যার বেশী কিছু হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। আর এই কাজে সে যথেষ্ট পারদর্শিতাও দেখিয়েছে। না হলে মা কেন এত কিছু সহ্য করেও খবিশকে ত্যাগ করবে না। আবার মুন্নিও খবিশকে পাগলের মতো ভালবাসে। মা বাসায় থাকাকালে দেখায় সে আমার উন্মাদ প্রেমিক। আর মা ঘর থেকে বাইর হওয়ার সাথে সাথে যে উন্মাদ হয়ে যায় খবিশের জন্যে। আমার খালাও ফোনে খবিশের সাথে রসিয়ে রসিয়ে কথা বলে। মা তো তার কোন বান্ধবীকে খবিশের সাথে পরিচয় করে দেয় না প্রেম হয়ে যাবে এই ভয়ে। কিন্তু মা ভয় পাক আর যা-ই পাক তলে তলে তার সব বান্ধবীর সাথে খবিশের শোয়া শেষ। এহেন একজন পুরুষবেশ্যা নাকি এখন লেখক। সে লেখালেখি করে রীতিমত পয়সা কামায়। শুধু কামায় বললে ভুল হবে। রীতিমত বড়লোক হওয়ার মতো অবস্থা।
ও গড, আর কত রসিকতা তুমি করবা। না, চিন্তা করতে গিয়ে আমার নেশা ছুটে যাচ্ছে। ইদানীং মনে হয় মাও আমার সাথে দুইনাম্বারী শুরু করেছে। দেয়ার কথা দুই পেগ ডেইলি তিনবেলা। দেয় ঠিকই, কিন্তু মনে হয় পানি মেশায় বেশী। নেশা একটু হয়, কিন্তু থাকে না বেশীক্ষণ। ডাক্তারকে বলে দেয়া উচিত যে তোমার প্রেসক্রিপশন কিন্তু ফলো করা হচ্ছে না ঠিকমত। আর ফলো না করলে ডেভেলপমেন্টও হবে না। খবিশ তো তলে তলে নানারকম ধান্ধায় ব্যস্ত। কেমনে কেমনে একটা ব্যাংক থেকে মার্কেটিং চ্যারেটির অংশ হিসাবে আমার চিকিৎসার জন্যে এককালীন মোটা অঙ্কের টাকা ম্যানেজ করে ফেলেছে। এই খবর মিডিয়ায় দেওয়াতে আমি এখন এনজিও, বিদেশী দাতাসংস্থা, মিডিয়া আর বোগাস চ্যারেটিওয়ালাদের স্পেশাল টার্গেটে পরিণত হয়েছি। খবিশ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পয়সা কামানোর ধান্ধায় তৎপর। মাকে বুদ্ধি দিয়েছে কিভাবে চিকিৎসার টাকা বাঁচিয়ে গুলশানে ফ্লাট কেনা যায়। ডাক্তার এই দিকে অনুদানের খবর পেয়ে আমার হুইস্কির পেগ বাড়িয়ে দিয়েছে দুই গুণ। শুনেছি ডাক্তার নাকি মদের দোকান থেকে পারসেনটেজ পায়। মদের দোকানও এই খবর পেয়ে তাদের মদের দাম বাড়িয়েছে দিয়েছে। লে হালুয়া, গাঙ্গের পানি গাঙ্গে।

অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা

মাকে অবশ্য আমি দোষ দিই না। বেচারী গত ছয়টা মাস কী নিদারুণ কষ্টে যে আমার এই ঘোড়ারোগের চিকিৎসা করে যাচ্ছে তা কেউ ভিতর থেকে না দেখলে বুঝতে পারবে না। ভিতর থেকে দেখতে পারে এমন মানুষ বলতে তো খবিশ। সারাক্ষণ মার কাছাকাছি থাকে, কিন্তু কিছুই দেখে না। ও তো জন্মান্ধ। ও দেখে হাতে, চোখে না। ওর হাত দেখতে পায় সবই। যেখানে স্বার্থ, সেখানেই হাত দুটো অনায়েসে ঢুকে পড়ে। হাতিয়ে নেয় সর্বস্ব। মা সবই বোঝে কিন্তু কিছুই বলে না। মা আমার সর্বংসহা ধরিত্রী। ক্ষতবিক্ষত বুকে টেনে নেয় পরম আত্মীয়তায় পরিচিত তষ্করকে।
ইদানীং খবিশের অনেক সাংবাদিক বন্ধুবান্ধব হয়েছে। কোন এক পত্রিকার সে নিয়মিত লেখক। তার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ টাকাও পায়। মানুষ কি পাগল, না ছাগল! খবিশের লেখা কিভাবে পড়ে? লেখক হতে হলে আগে প্রস্টিটিউট হতে হয় তা তো জানতাম না! মাই গুডনেস! এমন একজন অমানুষের লেখা মানুষ পড়ে? নাকি সবাই অমানুষ? শব্দটা বলার সুবিধার জন্যে অ-টা কেটে দিয়েছে?
পর মুহূর্তেই মার জেরা থেকে বেরিয়ে আসে তথ্যটা। সে আসলে একজন পর্ণোলেখক। ইদানিং নাকি এই লাইনের লেখকের রমরমা অবস্থা। পাঠকের অভাব নাই। অনলাইন ম্যাগাজিনে ছাপা এইসব রসগল্প মানুষ শতশত টাকা খরচ করে ডাউনলোড করছে প্রতিদিন মোবাইলে, আইপডে, কম্পিউটারে। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। পর্ণোলেখক? মানুষ তাদের লেখা শতশত টাকায় কিনে নিচ্ছে! কিন্তু পর্ণোলেখা মানে কী? কিভাবে লিখতে হয়? ওদের আকার-ইঙ্গিতে যা বুঝছি তাতে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা গোপনীয়। শত শত মানুষ যেটা হাজার হাজার টাকা খরচ করে নিত্যদিন ডাউনলোড করে তা গোপনীয় হয় কেমনে? পত্রিকার গল্প নিয়ে যেভাবে খবিশ আর মা কথা বলছে তাতে মনেহয় খবিশ খুব বড় মানের কোনো অপরাধ করছে নিত্যদিন। কিন্তু কেন? পত্রিকা তো প্রত্যেকদিন একটা দেখি। মুন্নিও মাঝে মাঝে বসে বসে ছবি দেখে। সুন্দর সুন্দর মেয়েদের নানা ভঙ্গির ছবি দেখে, সাথে আমিও দেখি। তাতে আমার কিছুই মনে হয় না। মাকেও দেখি আয়নার সামনে দাড়িয়ে ন্যাংটা হয়ে নানা ভঙ্গিমায় নিজের শরীর দেখে। তো পত্রিকায় মানুষেরটা দেখলে কী এমন ক্ষতি যে সারাক্ষণ হায় হায় করতে হবে? রাতেও তো খবিশের সামনে মা ন্যাংটা হয়ে ঘুরে বেড়ায়, মা বাসায় না থাকলে মুন্নি খবিশের সামনে ন্যাংটা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। আবার যখন টেলিভিশনে একটা মেয়ে একটু বুকের কাপড় ফেলে দেয় অমনি মা, না হয় মুন্নি বা খবিশ তাড়াতড়ি চ্যানেলটা চেঞ্জ করে ফেলে। বলে, আজকাল আর ফ্যামিলি নিয়ে কিছু দেখা যাবে না! একা একা এত কিছু দেখে, সবাই মিলে দেখলে কী এমন ক্ষতি আমি তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি না। শুধু এইটুকু বুঝি যে, কেউ তার আসল চেহারা অন্যকে দেখাতে চায় না। সবকিছুতেই রাকঢাক, সবকিছুতেই লুকোচুরি। মার নির্দেশে খবিশ তার একটা পত্রিকার কপি নিয়ে আসলো। এটা সে তার গোপন লকারে লুকিয়ে রেখেছিল। পত্রিকাটা মা হাতে নিলো। আমিও দেখছি। কই অন্য আর সব পত্রিকার মতোই, কাগজেই ছাপা। পাথর বা গাছের পাতায় ছাপা হলে না হয় কথা ছিল, শুধু সাইজে একটু ছোট এই যা। ছবিও আহামরি কিছু না। লেখাও কিন্তু বাংলা অন্যসব পত্রিকার মতোই। এমনসব ছবিতো আমি সব জায়গায় দেখি। টেলিভিশন, পত্রিকা আর আমাদের ঘর সর্বত্রই ন্যাংটা মানুষ ঘুরঘুর করছে। শুধু কেউ কাউকে বলবে না এই যা। তো খবিশের পত্রিকায় হলেই মার হম্বিতম্বি!

মা মনে হয় খবিশের ফেইমে জেলাস ফিল করছে। আর একটা ভয়ও আছে। খবিশ যদি টাকা কামাই করতে পারে তো এখানে থাকবে না। না থাকলে তো আমার খুবই সুবিধা হয়। কিন্তু মা নাছোড়বান্দা, কিছুতেই খবিশকে হাতছাড়া করবে না। খবিশের জন্যে যে মার কত রকমের ভোগান্তি, তাও কী এমন মধু যে সে এই মানুষটার মধ্যে পায়, আল্লামালুম! মা আবারও পত্রিকাটা খবিশকে দেয় এবং পড়তে বলে। খবিশ তার পত্রিকা থেকে কয়েকটি হেডলাইন পড়ে শোনায়। শুনে মা যে খুব মজা পাচ্ছে তা না লুকাতে পারলেও চেষ্টা করছে যেন কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ না পায়।
খবিশ পড়ে : বাসাবোর পানিসেবনে তিন জন প্রেগনেন্ট, মার সাথে ছেলের প্রেম পরিণামে বাবা খুন, গাজিপুরে ইয়াবা রানী মাক্কির কীর্তি
চব্বিশ ঘণ্টায় বত্রিশ জনের সাথে সেক্স . . .
এইটুকু শুনে মা বললো, আর পড়তে হবে না। তুমি এখন যাও। খবিশ প্রভুভক্ত কুকুরের মতোই একটু সরে গিয়ে বিছানায় কু-কু করে আর লেজ নাড়ায়। আমার মনে হলো এবার এক পেগ না হলে আর পারছি না।

মা আবারও ঘুরেফিরে খবিশের কাছে এসে বসে। জিজ্ঞেস করে এই পত্রিকা মানুষ পড়ে? খবিশ বলে, পড়ে মানে, ছাপিয়ে কল পাচ্ছে না! মানুষ তো গতানুগতিক খবরাখবর পড়ে পড়ে ক্লান্ত, রাজনীতিবিদদের ক্যাচাল আর কার ভালো লাগে! তার চাইতে এই সব ইরোটিক, সেক্সি হিউমার অনেক বেশী জনপ্রিয়। টাকাও কামানো যায় ভালো। তাই ভাবলাম কিছু তো আর করতে পারলাম না। কিছু একটা করি যা মানুষ পছন্দ করে। আর তুমি তো চেনো। আমার বন্ধু শাহ আলাম। আগে ফেনসিডিল বিক্রি করতো এখন সেই ব্যবসা গুটিয়ে পত্রিকার ব্যবসায় নেমেছে। সেই সুবাদেই আমারও লেখক হওয়া। হ্যানি, তুমি রাগ করোনি তো? আমি বেশীদিন এই পত্রিকায় থাকবো না। তুমি দেখে নিয়ো, কয়েক মাসের মধ্যেই কোনো জাতীয় পত্রিকায় কাজ পেয়ে যাব। হাতটা পাকাচ্ছি আরকি।
মার মুখ শক্ত। কিছুই বলে না। কিছুক্ষণ নীরবতার পর আবার বলে, আচ্ছা এগুলো কি সত্যি কাহিনী?
মার এই যুতসই প্রশ্নটা শুনে খবিশের চোখ চকচক করে ওঠে। সে যেন চমৎকার একটা টপিক পেল একটা লেকচার দেওযার জন্যে। সে রীতিমত গলা পরিষ্কার করে শুরু করে।
তোমার কি মাথা খারাপ! পত্রিকার কোনো খবরই কি সত্যি? সত্যি কথা কি মানুষ খাবে? মানুষ তো শুনতে চায় মিথ, মিথ্যা, বানোয়াট গল্প। তবে বলতে হবে বা লিখতে হবে সত্যি ঘটনা হিসাবে। তাইতো রিপোর্ট আকারে আমরা এইসব গল্প ছাপাচ্ছি। এই দেখোনা, বাসাবোর গল্পটি। তিনজন নারীর কিছু কথাও আমরা ছেপে দিয়েছি তাদের নামঠিকানা সহ। কাজেই কারো পক্ষে তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নাই। কবে ঘটনা ঘটেছে, কোন ল্যাবে পরীক্ষা হয়েছে, কবে হয়েছে, কোন ডাক্তার টেস্ট করেছে, সব। এমনকি তুমি যদি তার সত্যতা প্রমাণের জন্যে ডাক্তার বা রিপোর্টকৃত নারীদের খোঁজ নিতে যাও, তাও পাবে। টাকা দিয়ে সব সেট করা আছে। বড় পত্রিকাগুলোও তাই করে। তবে ওরা আরো বড় চোর। বড় মিথ্যুক। মিথ্যা বলবে, কিন্তু সারাক্ষণ মানবতা, মূল্যবোধ আর মনুষ্যত্বের কচকচানিতে সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে, এই যা। মা শুধু শোনে, কিছুই বলে না।
মার পক্ষে খবিশকে কিছু বলা সম্ভব না। মার নিয়ত ভয়, যদি সে চলে যায়। হায়রে, আমার দুখিনি মা! তোমার ভয় তোমাকে নিঃস্ব করে ফেললো, তাও তুমি ভয় থেকে বাইর হতে পারলে না।
চলবে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments