মাতাল শিশু/ধারাবাহিক উপন্যাস(শেষ পর্ব)/ মোয়াজ্জেম আজিম

  
    
মোয়াজ্জেম আজিম

মোয়াজ্জেম আজিম মেলবোর্ন প্রবাসী লেখক। প্রশান্তিকায় তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস ‘মাতাল শিশু’র প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয় ৭ জুলাই ২০১৯। সর্বমোট ২৬ পর্বে সমাপ্ত আখ্যানটির আজ শেষ পর্ব। উপন্যাসটি নিয়ে আমরা প্রশান্তিকায় অসংখ্য প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। প্রতিটি পর্বে মনোগ্রাহী পেইন্টিং করে সমৃদ্ধ করেছেন শিল্পী আসমা সুলতানা মিতা। অসংখ্য ধন্যবাদ মোয়াজ্জেম আজিম, মিতা এবং অগণিত পাঠককে। ভবিষ্যতে আরও গল্পকথা বা অন্য কোন বিষয় নিয়ে নিশ্চয়ই লিখবেন মোয়াজ্জেম আজিম।

শেষ পর্ব:
গত কয়েকদিন ধরে আমরা গ্রামে যাই-যাই করছি আর নানু আমাদের সাথে তাল দিয়ে মরি-মরি করছে। তবে আমি সিউর উনি মরবে না, মরার জন্যে এসব করছে না। শুধু-শুধু আমাদেরকে ঝামেলার মধ্যে রাখাই উনার উদ্দেশ্য। উনি মানুষের ভাল দেখতে পারেন না। আর তাই আমরা আসার সাথে সাথে উনি বিছানায় শয্যাগত। আগে বসে বসে টিভি দেখতো এখন দেখে শুয়ে শুয়ে। জরিনার মাকে অর্ডারের পরিমাণ একটু বেড়েছে। আমাদের সাথে আগের মতোই দেখেও না দেখার ভান করে। কিন্তু টিভি দেখার কোনো কমতি নাই। আগের মতোই দুইচোখ আঠা দিয়ে টিভি স্ক্রিনের সাথে লাগানো। এদিকে উনার বাড়িতে থাকতে গিয়ে আমার প্রায় নাভিশ্বাস দশা। ড্রিংস তো মোটামুটি প্রায় বন্ধই বলা চলে। তার উপর এগুলো দেখতে হয়, দেখার পর যে রাগ পেটের মধ্যে জমা হয় তা হজম করতে হয়। তাতে আমার মদের পরিমাণ যেখানে বাড়ার কথা তা না বেড়ে বরং কমে প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। রাতে ঘোমানোর আগে মাত্র এক পেগ। এক পেগ কোনো খাওয়া হইলো? মুন্নি পালানোর আগে যখন গুমন নিয়া রঙ্গ-তামাশা করতো, তখন তো ও আমাকে পারলে মদের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে! দিনে পাঁচবার ডাবল পেগ দিতো, চাইলে আরো একবার। আর এখন কিনা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টায় একবার! মাল না পেয়ে আমার শরীর এখন যেন শুকনা বিলে শাপলার দশা। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করে না। সারাদিন শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। আবার যখন শুয়ে থাকি তখন বাইরে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করে। যখন বাইরে যাই তখন ঘরে চলে আসতে ইচ্ছা করে। যখন যা কিছু করি, তা না করে অন্য একটা কিছু করতে ইচ্ছা করে। কেমন যেন সবকিছু আওলাঝাওলা লাগে! কিছুই ভাল্লাগেনা। জন্মের পর এই আমার মদ ছাড়া দুইদিন পার করার অভিজ্ঞতা হইলো। নেশায় না থাকলে সবকিছুই উলটপালট লাগে। মানুষকে আর মানুষ মনে হয় না। চারদিকে শুধু জন্তু-জানোয়ার দেখি। এই তো গতকাল সকালে ঘুম থেকে উঠে পুরোনো অভ্যাসবশত ড্রয়িংরুমের দিকে যেতেই দেখি টিভির সামনে জলজ্যান্ত এক শুয়োর বসে আছে। প্রথমে দেখে তো এমন ভয় পেলাম যে হার্টফেইল করার দশা। আমার তো আবার ফার্মের মুরগীর হার্ট! এমন দৃশ্য সহ্য করা কি অত সহজ? আমার তো মনে হইলো এই বুঝি খেইল খতম। যা-ই হোক, নিজেকে অতি কষ্টে সামলায়ে দেখি, এ তো টিভির কিট নানুজান। উনি প্রত্যেকদিন যেমন বসে থাকে আজও তাই। তাহলে আজ উনাকে শুয়োরের মতো দেখলাম কেন? এই চিন্তা মাথায় নিয়ে যখন আগাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ করে দেখি আমার সামনে দিয়ে একটা নেড়ি কুত্তা কু কু করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ব্যাপার কী দেখার জন্যে ঠিকমত উঁকি দিয়ে দেখি জরিনার মা। আমার সমস্যা কী? মনের মধ্যে কঠিন একটা আতঙ্ক নিয়ে মার রুমে ঢুকে দেখি আমাদের বিছানায় শুয়ে আছে এক শিয়াল। আতঙ্কে ওয়া করে চিৎকার করে উঠতেই মা এসে আামাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে, সোনা? আমি এখন এইসব কথা কেমনে কই? মাকে শুধু বলি, খারাপ লাগছে।

আমার অস্থিরতা মা টের পায়। পেয়ে আমাকে ব্যস্ত রাখার নানা কৌশল আবিষ্কারে মা নিজেকে ব্যস্ত রাখে। মিথিলাকে নিয়ে আমার সাথে পলাপলি খেলে, ব্যাকইয়ার্ডে গিয়ে গোল্লাছুট খেলে, বালু দিয়ে রান্নাবান্না করে মিছামিছি পিকনিক-পিকনিক খেলে, আরো কত কী! কিন্তু কিছুতেই আমার মনে ফুর্তি আসে না। আসবে কোত্থেকে? আসল জিনিস না হলে মনে ফুর্তি আসে নাকি? যার যা দরকার সেটা দিতে হবে তাহলেই না ফুর্তি। আমি অবশ্য আশায় ছিলাম গ্রামে চলে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। মাও সেই আশাতেই বসা। কিন্তু কবে যে গ্রামে যেতে পারবো তা আল্লা মালুম। বজ্জাত মহিলার খপ্পরে পড়ছি। বাসায় শান্তিতে থাকতেও দেবে না, আবার যেতেও দেবে না। নানাভাই মাকে বলেছে, তোমার আন্টি একটু ভাল বোধ করলেই আমরা তোমদের নিয়ে রওয়ানা করবো। কিন্তু সেটা যে কবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নাই। একেকটা দিন যায় আর আমি গুনি কয়দিন গেল। আমার মনে হয় গুনলে হয়তো দশ-বারো দিন হবে, কিন্তু আঙ্গুলে গুনে দেখি মাত্র তিনদিন। হায় আল্লা, এ তো দেখি আমার সেই ডাক্তারের খোঁয়াড় থেকেও ভয়ঙ্কর। আচ্ছা, হঠাৎই মনে হলো, আমি এত বেশী বেশী চিন্তা করছি কেন? উনি তো আর আমার শরীরে সুই ফোটাচ্ছে না সকাল-বিকাল? তাও তার উপর এত বিরক্ত হচ্ছি কেন? নাকি উনি কোন অদৃশ্য সুই দিয়ে সমানে খুঁচিয়ে চলেছে আমার হাতপা? অবশ্য উনার চোখেই সুই আছে। উনি তাকায় না তাতেই সুই এসে হাতে-পায়ে লাগে, আর যদি তাকাতো তাহলে মনে হয় এত দিনে মোরব্বা হয়ে যেতাম।
কবে যাব, কবে যাব এই চিন্তা করতে করতেই একদিন সত্যিসত্যি সেই দিন এসে হাজির।
আজ মঙ্গলবার। সকালটা বেশ সুন্দর। ঝলমলে রোদ। গত কয়েকদিন চরম লেথার্জিক লাগলেও আজ শরীরে বেশ তাগদ পাচ্ছি। গ্রামে চলে যাব এই নেশাতেই শরীর-মন বেশ তরতাজা হয়ে উঠেছে। নানুর শরীর এখন ভাল। উনিই অনুমতি দিয়েছে নানাভাইকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে রেখে আসতে। আসলে উনিও তো চায় না আমরা উনার বাসায় থাকি। এমনিতেই উনি মিথিলার উপর ক্ষেপা ছিল, তার উপর আমরা এসে জুটেছি! উনারও নাকি নাভিশ্বাস অবস্থা। উনার এখন একটাই দাবি, আমাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দাও। যতদূর শুনলাম এইদিকে আবার ওনার ছেলেমেয়েরা বুড়া মার দায়িত্ব নিয়ে ঠেলাঠেলিতে ব্যস্ত। তাই নানাভাই চান না যে উনি গিয়ে ছেলেমেয়ের গলগ্রহ হয়ে থাকুক। অবশ্য উনার নাকি একটার পর একটা আজগুবি দাবী লেগেই আছে। সুযোগ পেলেই জরিনার-মা মাকে এসব বলার চেষ্টা করে। মা কিছু শোনে, কিছু না-শুনে হাঁ-হুঁ করে। ‘তাই নাকি’ টাইপের একটা উত্তর দিয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ে। আমার মনে হয় জরিনার মাও নানুর উপর মহাক্ষেপা। নানাজান অনেক টাকা বেতন দেয় আর ভাল খাওয়াদাওয়া-সুযোগসুবিধা দেয় বলে কোথাও যাচ্ছে না। না হয় কবেই চলে যেতো। জরিনার মা-ই আমাদের খবর দিলো যে নানু নানাভাইকে বলেছে তাড়াতাড়ি আমাদের গ্রামের বাড়ি রেখে আসতে মিথিলাসহ।

ড্রাইবার আর জরিনার মা সব বেগবোচকা ওঠাচ্ছে। নানাভাইও রেডি, শুধু মা এখনও আমরা যে রুমটাতে ছিলাম সেখানে কাপড়চোপড় বদলাচ্ছে। মা সবসময় তাড়াতাড়ি রেডি হতে পারতো আজ কিন্তু ইচ্ছা করেই দেরি করতেছে। আর কেউ জানুক আর না জানুক, আমি জানি কেন দেরি করছে। মা আসলে সবার শেষে গাড়িতে উঠবে। হাতে থাকবে একটা মাঝারি সাইজের মেয়েদের ট্র্যাভল ব্যাগ। আর সেটাতে থাকবে খবিশের দেওয়া সেই ভারি প্যাকটা। মা আসলে এই ব্যাগটার কারণেই তাড়াতাড়ি ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে। মার খুব ভয় যদি কেউ টের পেয়ে যায়। যদি বাসাবো থানার ওসি খোঁজ পায় যে তার দেওয়া ব্যাগটা এখন মার কাছে আছে, আর মা কোথায় আছে সেটা যদি বাইর করতে পারে তো যার ব্যাগ তার হাতে যেতে তো বেশী সময় লাগবে না। আবার যে-কোনদিন খবিশও তো এসে বলতে পারে যে আমার পোটলা আমারে ফেরত দাও। মার যতই খবিশের জন্য দরদ উথলায়ে উঠুক, খবিশ না আসুক মা নিশ্চয় এখন সেটাই চায়? আমার তাই মনে হয়। দুদিন আগে যখন সুমি আর সাদিয়া আন্টি একসাথে আসলো আমাদের সাথে দেখা করতে তখন খবিশের জন্যে মার সে কী চিন্তা! বারবার চোখ মোছে আর খবিশের গুণগান গায়। আবার যখন সাদিয়া আন্টির সাথে কথা কয় তখন মনে হয় খবিশকে আর মার সহ্য হচ্ছে না। সাদিয়া আন্টিকে মা সবই বলে। কিন্তু সুমিকে বলে শুধু ভালগুলো। আমার মনে হয়, মা চায় না খবিশ ফেরত আসুক। অবশ্য খবিশ তো আর আমাদের বাসায় ফেরত আসবেও না। যদিও আসে, তো আসবে ওর ব্যাগ ফেরত নিতে, যা মা একেবারেই চায় না। মার তো বদ্ধমূল ধারণা খবিশকে বাসাবো থানার ওসি গুম করে ফেলেছে। এখন চুপেচাপে কয়েকটা মাস পার করতে পারলে মিসিং পারসন হিসাবে খবিশের নাম থানায় নথিবদ্ধ করে নেবে, ব্যাস হয়ে গেল। তার সেই নথি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তেলাপোকা আর ইঁদুরের খাদ্য যোগান দেবে। নথির শেষ পাতাটার সাথে খবিশের স্মৃতিও ইঁদুরের পেটে চলে যাবে চিরদিনের জন্যে। কিন্তু এটাও ঠিক মাকে খবিশের ফেরত আসার ভয়টা তাড়াতে থাকবে অনেকদিন। তারপর হয়তো আস্তে আস্তে হালকা হয়ে যাবে।
মার জন্যে অপেক্ষা করে করে শেষ পর্যন্ত আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। আমি আর মিথিলা পেছনে, মাও আমাদের সাথে পেছনেই বসবে। নানাভাই আর ড্রাইভার বসবে সামনে। মিথিলা গাড়িতে উঠেই কলবল করে কী যেন বলছে। কিন্তু সেদিকে এই মুহূর্তে আমার খেয়াল দেবার সময় নাই। আমার কেমন যেন টেনশান হচ্ছে মাকে নিয়ে। নাকি মার টেনশান গোপনে আমার কাঁধে ভর করতেছে? আমি ঠিকই জানি এই ব্যাগের বড় ভাগীদার আমিই। নিজের অজান্তেই আল্লা আল্লা করছি। আল্লা আল্লা করার এক ফাঁকে মা এসে গাড়ির দরজা খুলে চট করে গাড়িতে উঠে বসলো। হাতে কোনো ব্যাগট্যাগ কিচ্ছু নাই। আরে আজিব, মা কি এই পোটলা না নিয়ে চলে যাবে নাকি! নাকি মা এই পোটলা কাউকে দিয়ে দিয়েছে! মার জন্যে টেনশানটা মুহূর্তের মধ্যে টার্ন নিলো পোটলার জন্যে টেনশানে। এখন তো মনে হচ্ছে মাকে জিজ্ঞেস করে বসি খবিশের দেওয়া সেই ব্যাগ কই। মনে মনে হাজারো প্রশ্নের উদয় হচ্ছে, আর একটা-একটা করে আমি তাদের গিলে খাচ্ছি। কতক্ষণ খেতে পারবো কে জানে! আবার না কোন কথা পেটে না গিয়ে মুখ ফসকে বাইরে বেরিয়ে আসে! তাহলে তো নানাভাই, মিথিলা আর ড্রাইভারের সামনে বিরাট পেজগি লেগে যাবে। এরই মধ্যে গাড়ি চলতে শুরু করছে। মার মুখ শুকনা, আমার ভেতরে তোলপাড়, মিথিলা আমাদের পাশে বসে আমাদের অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পেরে চুপ মেরে গেছে। নানাভাই আর ড্রাইভার ওরা দুজনও চুপ। মনে হচ্ছে আমরা কোনো শোকসভায় বসে আছি। টিভি ক্যামেরা ঘুরে ঘুরে মৃত ব্যক্তির ছবির উপর গিয়ে স্থির হলো। আজকের এই শোকসভার মৃতব্যক্তির নাম মুন্নি, নাকি খবিশ? সরি, খবিশের ভাল নাম কী? মনে করতে পারছি না কেন? ও, মনে পড়েছে, সাগর। সাদিয়া আন্টি তো সাগর ভাইয়া বলেই ডাকে। মার মুখে খবিশের নাম খুব একটা শোনা যায় নাই, এই-তাই বলেই চালিয়ে দিতো। মুন্নিও তাই, এই-তাই, মাঝে-মাঝে মার সামনে ধরুন, নিন, খাইতে আসুন। মুন্নি থাকলে নিশ্চয় ও আমাদের সাথে যেত। অবশ্য ও থাকলে তো আমাদের গ্রামের বাড়ি যাওয়াই লাগতো না। যত অঘটন সবই তো ওর জন্যে। মুন্নির প্রেমের বলি এখন আমরা সবাই। মুন্নির কথা ভাবতে গিয়ে আমার মনে উদয় হতে থাকা প্রশ্নের স্্েরাত কিছুটা কমেছে। এখন আমি আমার চোখের সামনে যা পড়ছে তাই দেখছি। এতক্ষণ কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ খেয়াল করতেই চোখের সামনে শুধু এম্বুলেন্সের দৌড়াদৌড়ি দেখছি, সাথে কান ফাঁটানো সাইরেন। রাস্তায় এত এম্বুলেন্স কেন? মানুষের মড়ক কি লাইগা গেছে? তালুকদার তো বলছিল আর কয়টা দিন অপেক্ষা করেন, দেখবেন মানুষ কেমনে মরে। পঙ্গপালের মতো নাকি মরবে। পঙ্গপাল কেমনে মনে কে জানে। দেখছি বলে তো মনে পড়ে না, তবে বেশ কয়েকবার শুনছি। পঙ্গপাল মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি মরে। এই কারণেই এম্বুলেন্সগুলো এত তাড়াহুড়া করতেছে। কোনরকমে হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছতে পারলেই হয়। কিন্তু তাড়াহুড়া করে লাভ কী! পঙ্গপালের মতো মারা গেলেতো ডাক্তার চিকিৎসা করারও সময় পাবে না। তালুকদার অবশ্য বলছিল আজরাইল আইসা খাড়াইলে নাকি ডাক্তারের বাপের সাধ্য নাই রুগিকে রক্ষা করার। সে তাড়াতাড়ি হোক, আর সময় নিয়া হোক। এম্বুলেন্সের লাগাতার হর্ন এত বিরক্ত লাগছে যে সহ্য করা কঠিন। মাল পেটে থাকলে না হয় সহ্য হতো, মনে হতো বিয়ার সানাই। এখন যেখানে মেজাজ এমনিতেই তিরিক্ষি সেখানে যদি সারা দেশের রুগি সব মিছিল করে এম্বুলেন্সের সাইরেন বাজিয়ে হাসপাতালের দিকে দৌড়াইতে থাকে তাহলে সেটা সহ্য করা কি অত সহজ? কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। গাড়িও যে খুব আস্তে চলছে তা না। মাঝে-মধ্যে এম্বুলেন্সের জন্যে জ্যাম লেগে যাচ্ছে, তাতে গাড়ির গতি না কমায়ে উপায় থাকতেছে না। কিন্তু রাস্তা ফাঁকা পাইলেই ড্রাইভার জোরে একটা টান দিচ্ছে। গাড়িটা দ্রু চলতে থাকলে খুব ভাল লাগে, এই মূহুর্তে গাড়িটা আমাদের দ্রæতই চলছে। খুব দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে মানুষের জটলা, পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে হাজারে হাজারে রিকসা, ঠেলাগাড়ি, বাস, ট্রাক টেম্পু, সিএনজি। নানাজানের চাইতেও সুন্দর এবং বড়বড় গাড়ি, সাথে হাজার হাজার এম্বুলেন্সতো আছেই, যতনা গাড়ি তার চায়তেও বেশী এম্বুলেন্স। আজ কি এম্বুলেন্স দিবস নাকি! আমরা এসব পেরিয়ে যাচ্ছি আর দেখছি। সবচেয়ে বড় সুখ হলো যে এই জঞ্জালের শহর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি দ্রæত। মনে হচ্ছে আমরা পালাচ্ছি। যত দ্রæত সম্ভব পালাচ্ছি। যতই আমি দেখছি যে গাড়ি খুব দ্রæতগতিতে ছুটছে ততই আমার মন আনন্দে ভরে উঠছে। আমার মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা এই ইটকাঠ, লোহালক্কড়, ধোঁয়াধুলা, ময়লা-আবর্জনার শহর ছেড়ে চলে যাব গ্রাম নামক এক সবুজ-শ্যামল শান্তির দেশে। আহা কী সুখ! সেখানে নিশ্চয় পুকুরে টলমল করে পানি, পুকুরের পাড় ধরে মাছরাঙ্গাদের বাসা, পুকুরপাড়ে বকুলফুলের গাছ, গাছের ডালে দোয়েলের বাসা, বাসার মাঝে ছোট্ট দোয়েলছানা, পাশেই বিশাল আমগাছ, সেই গাছে ঘুঘুর গানে বিরক্ত হয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে সবুজ টিয়া? আহা, কী সুন্দর গ্রাম! এবং আমরা খুব শীঘ্রিই সেই গ্রামে পৌঁছে যাব। আহা কী মজা! কিন্তু শহর যেন শেষ হবে না। সেই কতক্ষণ ধরে মানুষের জটলা, এম্বুলেন্সের জটলা, গাড়ির জটলা দেখছি তো তো দেখছিই। আমরা সবকিছু পেরিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু শহর পেরিয়ে যেতে পারছি না। ভাবতে ভাবতে, চলতে চলতে, দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত। কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। পুরাপুরি ঘুমে না ঢুকেই চলে গেলাম সেই প্রথম দিনের হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার ঘড়ঘড় করা গাড়িটায়। দেখি গাড়িটা কেমন করে যেন চেঞ্জ হয়ে এম্বুলেন্স হয়ে গেছে। রুগির বেড়ের পাশে আমি বসা। মা, নানাভাই ড্রাইভার কাউকেই দেখিছি না। শুধু আমি আর এম্বুলেন্সের বেডে কেউ একজন শুয়ে আছে। তার শরীর সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। আমার কেন যেন মনে হলো যে শুয়ে আছে সে আসলে মুন্নি। মুন্নির কথা মনে হতেই আমি একটু উঠে গিয়ে সাদা কাপড়টা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কে। দেখি না, যে শুয়ে আসে সে মুন্নি না, খবিশ। কিন্তু খবিশের গলাকাটা। কাটা গলা থেকে এখনও রক্ত পড়ছে। তা দেখে আমি ভয়ে চিৎকার করে মাকে ডাকতে থাকি কিন্তু আমি বুঝতে পারি যে আমার গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না, আমি আরো প্রাণপণে চেষ্টা করি চিৎকার করতে। আমার এই ভয়ের মুহূর্তে একজন এসে আমার কাঁধে হাত রাখে। বলে, ভয় পাইয়ো না বাবু। আমি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি, এ তো বুড়াচাচা, খবিশের বাপ! আরে উনি কোত্থেকে আসলো। উনাকে দেখে আমি কেমন যেন বেশ ভরসা পাইলাম মনে হলো। উনি উনার ছেলেকে ভাল করে ফেলতে পারবে। উনি তো বিরাট কবিরাজ। উনি চাইলে যে কোনো রুগিকে ভাল করে ফেলতে পারে। উনি নিজে থেকেই বলে, বাবু, তুমি কোনো চিন্তা কইরো না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এই যে আমি রওয়ানা করছি কামরূপ-কামাক্ষ্যা। সাগরকেও সাথে নিয়ে যাবো। আমার ওস্তাদ চাইলে ওরে আবার জীবন্ত করে ফেলতে পারবে। ওস্তাদ তো পারে না এমন কোনো কাজ নাই। উনি সাতদিনের মরা চৌদ্দ টুকরা বডি একসাথে করে জীবন্ত করছে এমন নজিরও আছে! আর সাগরতো এখনও তাজা, শরীরের রক্ত এখনও শুকায় নাই। তুমি কোনো চিন্তা কইরো না। আর মুন্নিকেও খুঁজে বাইর করবো। আসলে আমি জানি মন্নি কই আছে, কিন্ত বলতে নিষেধ আছে। আমার ওস্তাদ বলছে আপাতত মুখ খুলিশ না। সময় হলে সবই বলবো। তুমি যাইবা আমার সাথে যাদুরাজ্যে। চলো যাই, দেখে আসো দানব-রাজার দেশ। সেখানে গেলে তুমি খুশিই হইবা আমি জানি। আমি কিন্তু তোমারে দেখে একটুও অবাক হয়নি। আমি আগেও বহু দেখছি, শিশু জন্মায়েই কথা কয়, হাঁটে, শিকার করে নিজের ভোজ নিজেই যোগাড় করে। কামরূপ-কামাক্ষ্যার যত শিশু আছে তারা সবাই তোমার মতো। ওরা তো দানবের জাত! ওদের মায়ের পেটে থাকতেই দাঁত গজায়। জন্মের পরপরই রক্ত খাইতে হয়।  তুমি দেখলে খুশি হইবা। তোমার অনেক বন্ধু জুটবে, চলো যাই। আমার তো মনে হয় তুমিও দানব সন্তানই। দুনিয়াতে তো এখন বনজঙ্গল উজাড় হয়ে যাচ্ছে, তাই দানবও এখন আর জঙ্গলে থাকবার পারতেছে না। না পাইরা মানুষের সমাজে চলে আসতেছে। কী করবো কও? তাদেরও তো বাঁচতে হইবো নাকি?  চলো যাই।
এই কথা বলেই উনি চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে যেতে চাইলে আমি মাকে ডাকি। মা দেখো দেখো, কে এসেছে!  দেখি মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কী কী যেন বলছে। মা বলে, কে এসেছে বাবা? আমি কিছু বলি না। বুঝি যে, না, আমি আসলে যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি। নানাভাইয়ের গড়িতেই।
গাড়িটা আমাদের দ্রæতই চলছে। আমার প্রথম দিন হাসপাতাল থেকে বাইর হয়ে বাড়ি আসার কথা খুব মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে আমি আবারো হাসপাতালের মতোই কোনো এক কযেদখানা থেকে মুক্ত হয়ে ছুটে চলেছি শান্তির উদ্দেশ্যে। সেবার আমি মাকে আ-উ করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মা আমরা কোথায় যাচ্ছি? মা বলেছিল, আমরা বাড়ি যাচ্ছি, সোনা। সেই বাড়ি নামক যাদুরাজ্য সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। গত ২৭ মাসে আমি বাড়ি নামক এক দুর্গ থেকে হাজারো অভিজ্ঞতা নিয়ে ছুটে চলেছি গ্রাম নামক আর এক যাদুরাজ্যের উদ্দেশে। পার্থক্য শুধু সেবার আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আর এই বার ঘুম আসতে গিয়েও চলে যাচ্ছে। কিছুতেই ঘুমকে পুরোপুরি বাগে আনতে পারছি না। চোখ মেলে এবং চোখ বুজে কেবল শহর পেরিয়ে যাওয়া দেখছি তো দেখছিই …

সমাপ্ত 

পেইন্টিং ও অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments