
১৭তম পর্ব:
মুন্নি একদিন লাপাত্তা। মার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। হায় হায়! এখন কী উপায়? আমাকে কে দেখবে? আমাকে বাসায় একা রেখে তো আর মা কাজে যেতে পারবে না! যদিও এখন আমি একা একা প্রায় সবকিছুই করতে পারি। টয়লেট করতে পারি। এমনকি রান্নাঘরে গিয়ে প্লেটে খাবার তুলে নিজে নিজেই খেয়ে নিতে পারি। কিন্তু মা কেন যেন একেবারেই ভরসা পাচ্ছে না আমাকে বাসায় একা রেখে যেতে। এমনকি আমাকে একা রেখে একমুহূর্তের জন্যেও বাইরে যেতে চায় না। মুন্নি চলে যাওয়াতে এখন নাকি থানায় গিয়ে জিডি করতে হবে। তাও মা যাচ্ছে না আমকে রেখে। আবার আমাকে নিয়ে থানায় যেতেও মার আপত্তি। আমি বলেছিলাম, আমাকে নিয়ে যাও, পুলিশ দেখে আসি। আমি টিভিতে দেখেছি পুলিশ। সবসময় খালি দৌড়াদৌড়ি করে। আর মানুষকে তাড়া দেয় কুত্তার মতো। আমার টিভিতে পুলিশ দেখলে ভয় লাগে না। তবে থানার পুলিশ দেখলে মনেহয় আমি ভয় পাবো। টিভিতে তো দেখছি সারাক্ষণ মানুষকে মারে। কাউকে পিটিয়ে মারে, কাউকে গুলি করে মারে। আমার বয়েসি ছেলেকে গলা টিপে ধরেছে তাও দেখেছি। এখন আমার পুলিশের কথা মনে হলেই ভয় লাগে। ওদেরকে দিয়ে তো বিশ্বাস নাই। খবিশ বলেছে, টাকার জন্যে নাকি ওরা নিজের পুটকি নিজে মারতে পারে। তখনতো খবিশের কথা বিশ্বাস করতাম না। এখন মনেহয় করলে করতেও পারে। পুলিশকে দিয়ে বিশ্বাস নাই। দিনদুপুরে যে-লোক বন্দুক নিয়ে ঘোরাফেরা করে তার পক্ষে সবকিছ্ইু করা সম্ভব। দেখেছি সিনেমায় মানুষ বন্দুক নিয়ে যায় বনেজঙ্গলে বাঘভালুকের হাত থেকে বাঁচার জন্যে, আর ওরা এখানে এই ঢাকা শহরে মানুষের মাঝে বিশাল বিশাল বন্দুক নিয়ে সারাক্ষণ ঘোরাফেরা করে। কেউ কেউ আবার কালো কাপড়ে সারা শরীর, এমনকি মাথামুখ ঢেকে জল্লাদ সেজে মেশিনগান নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যখন-যেখানে যাকে-খুশি নাকি গুলি করে মারে! এটার নাম নাকি ‘ক্রসফায়ার’। সরকারই নাকি ওদের হাতে বন্দুক তুলে দিয়ে বলেছে মানুষ মারার জন্যে। তো ওদের আর দোষ কী? আমাকে দিলে আমিও মেরে ফেলতাম। কাকে মারতাম প্রথমে? আমার মনেহয় খবিশকে মারতাম। নাকি মুন্নীকে? আমাকে ছেড়ে চলে গেল! নাকি মাকেই? তার ভুলেই তো আমার অমন দশা? না, মাকে মারতে পারতাম না। তবে মারতাম। কাউকে না কাউকে ক্রসফায়ার করতাম। তারপর হাসপাতালে পাঠাতাম যেন তারা কেটে টুকরা টুকরা করে তাদের মা-বাবার কাছে মাটি দেওয়ার জন্যে পাঠিয়ে দেয়। এভাবেই তো ওরা করে বলে শুনি। সব সরকারই নাকি এমন! আবার এদেরকেই মানুষ ভোট দেয়। এদের জন্যই মানুষ মারামারি করে মরে। আজীব দুনিয়া! কেউ এটা নিয়ে কিচ্ছু বলে না!
কিসের মধ্যে কী নিয়ে ভাবছি! মুন্নির এই পালিয়ে যাওয়াটা কিন্তু আমার মাকে আরো আগেই বলা উচিত ছিল। কিন্তু বলি কেমনে? একটা কঠিন চুক্তির কারণে মাকে কিছু বলতে পারি নাই। ওর সাথে আমার চুক্তি হয়েছিল যে, যতবার এই ছেলের সাথেও দেখা করতে যাবে ততবার আমাকে এক পেগ করে মদ দেবে। আমার হতো মজা! এক পেগ মেরে টিভির সামনে বসে পড়লে সময় কোনদিক দিয়ে যেতো টেরই পেতাম না। মুন্নি কতক্ষণ বাইরে থাকলো না-থাকলো তাতে আমার কিচ্ছু যায়-আসে না। কিন্তু মাঝে-মাঝে মেজাজ খুব গরম হতো। মুন্নির লটরপটর ইদানীং সাংঘাতিক রকম বেড়ে গেছিল। আমার পক্ষে সহ্য করা কঠিন হচ্ছিল।
এইতো সেদিন আমাকে বললো, ভাইয়া, সুমন না তোমার সাথে দেখা করতে চায়।
আমার সাথে আবার দেখা করার কী হলো! আমি কি ওর শালা-সুমন্ধি নাকি! আমি বললাম, মা বলেছে কাউকে ঘরে ঢুকতে না দিতে। আমি মার পার্মিশন ছাড়া কাউকে ঘরে ঢুকতে দিতে পারবো না। এটা শুনে মুন্নি আর কিছু বলেনি। আমিও গম্ভীর ভাব নিয়ে বসে থাকাতে ও আর কোনো কথা বলার সাহস দেখায়নি। পাড়ার ছ্যাঁচড়া পোলার সাথে লটরপটর করতেছো করো। এর বেশী চাইলে খবর আছে! মনে মনে ওকে অনেক গালিগালাজ করছি তো করছিই। এতদিন খবিশের সাথে প্রেম করেছে, এখন আবার শুরু করেছে পাড়ার ছ্যাঁচড়া জুনিয়র-খবিশের সাথে! শালী! মাকে বলেই দেবো। আমার দরকার নাই এই পেগের। মবিন সাহেব বলেছে মদ যত কম খাব ততই ভাল। আমিও কথা দিয়েছি বেশী খাব না। আর এখন এই খবিশদের পাল্লায় পড়ে মার অজান্তেই খেয়ে যাচ্ছি পেগের পর পেগ! মার স্থির বিশ্বাস আমি মদ কমিয়ে দিয়েছি। তলে তলে যে এতকিছু হচ্ছে, মা আর মবিন সাহেবের কানে যদি যায় তো দুনিয়া উল্টে যাবে। আমার আর জায়গা হবে না মবিন সাহেবের বাগানে। মাও আমার সব চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে পারে। একটা মহিলা যেখানে নিজের জীবন দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে আমাকে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁেচ থাকার ব্যবস্থা করে দিতে, সেখানে কিনা তারই ঘরের চাকরানী এক বিরাট ষড়যন্ত্রের মাঝে আমাকে নিয়ে খেলছে প্রেমের খেলা! না, আমি আর তা হতে দেবো না। কালই মাকে বলে দেবো। কিন্তু হায়, সেই কাল আর আমাদের জীবনে আসলো না। মাকে বলার আগেই একদিন দুপুরে পাড়ার ছ্যাঁচড়া পোলা এসে দরজায় নক করলো। মুন্নি গিয়ে জিজ্ঞেস করে, কে?
দরজার ওপারে কোন সাড়া শব্দ নাই। মুন্নি আবার জিজ্ঞেস করে, কে? না, কেউ কোনো কথা বলে না। মুন্নির চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ও আতঙ্কিত। আমি জিজ্ঞেস করি। মুন্নি, কী হয়েছে? মুন্নি বলে, কেডা জানি দরজায় ধাক্কায় কিন্তু কথা কয় না। আমি বলি, থাক, ধাক্কাক, তুই দরজা খুলিস না। এরই মধ্যে ফোন আসে। মুন্নি দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরে। ইদানীং আমি বুঝে গেছি ঐ ছেলেটার ফোন হলে মুন্নির চোখমুখ কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তারপর মুন্নি আমার কাছে এসে সে কী সুন্দর সুন্দর কথা! আমি বললাম, সুন্দর সুন্দর কথা বলে লাভ নাই। আমি তোকে যেতে দেবো না। এমনকি এক পেগ দিলেও না। আমি মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। শুনে মুন্নি মুচকি মুচকি হাসে। ও ভেবেছে আমি এমনি এমনি বলছি। ও জানে না যে আমি যা সিদ্ধান্ত নিই তাই করি। আমি বললাম, হাসো আর যা-ই করো, আমি কিন্তু মাকে ফোন করবো তুই যদি ঘর থেকে বাইরে যাস। মুন্নি মুখ গোমড়া করে বসে থাকলো বারান্দায়। কিছুক্ষণ পর শুনলাম নীচ থেকে ঐ ছেলের গলা। যতটা পারে নীচে নামিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু নীচ থেকে দোতলায় কথা বলতে হলে তো কিছুটা গলায় জোর নিয়েই বলতে হয়। আমার চান্দি গরম হয়ে যায়। মুন্নিকে ঠিক করার আর কোনো পথ নাই মাকে বলা ছাড়া।

কিন্তু মাকে বলার আগেই ঘটনাটা ঘটে গেল। এখন আমি কী বলি। তাও বললাম যে পাড়ার এক ছ্যাঁচড়া পোলার সাথে মুন্নির ভালবাসা। ও মনে হয় ওই পোলার কাছে গেছে। তুমি দোকানে গিয়ে খোঁজ নাও। ছেলের নাম নাকি সুমন। ওর নাম কুমন বা গুমন হওয়া উচিত ছিল! শালা! শয়তানের বাচ্চা!
মা কিছু বলে না। শুধু চোখ মোছে। কিন্তু চোখে তো আমি কোনো পানি দেখি না। মার চোখ বরাবরই অগ্নিগোলক হয়ে যায় রেগে গেলে। আজ অবশ্য মাকে রাগান্বিত যত না তার চাইতেও অসহায় মনে হচ্ছে। কিন্তু মা এত চিন্তা করছে কেন আমি বুঝি না, আমি আছি না! আমি তো এখন সব কাজ একা একাই করতে পারি। মা কয়েকদিন আগে আমাকে ডিম ভাজি করাও শিখিয়েছে। বড় হলে নাকি রান্না করে খেতে হবে। তখন মাও থাকবে না, মুন্নিও থাকবে না। একে একে নাকি সবাই চলে যাবে যার যার গন্তব্যে। গন্তব্য মানে কী জিজ্ঞেস করার পর মা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল, আমার কথার কোনো উত্তর দিলো না। আমিও মার আনমনা ভাব দেখে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। গন্তব্য শব্দটা মনে হচ্ছে বেশ জটিল। দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করার সাহস দেখায়নি। ইদানীং মা কিন্তু আমাকে ধমক দেয়। একদিন মাইর দিবেও বলেছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কেমনে মারবে। বলে যে, মুন্নির মতো করেই দুই গালে দুইটা থাপ্পর দেবে। কথাটা আমি গায়ে না লাগালেও পরে খুব মনখারাপ হয়েছিল মার এই কথা শুনে।
সেদিন মুন্নি ঠিকই ওই পোলার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। বিনিময়ে আমাকে দিয়েছিল ডাবল পেগ। আমি আর খুব বেশী কথা বাড়ায়নি। মনে হয়েছিল ডাবল সট নিয়ে দেখি কেমন লাগে। তারপর দিলাম ঘুম। ঘুম থেকে উঠে দেখি সবকিছু ঠিকঠাক। মুন্নি বাসায়। মা এরই মধ্যে চলে এসেছে। তার মানে আমি ঘুমিয়েছি সেই বিকালে, আর এখন সন্ধ্যা প্রায় শেষের দিকে। আমার ধারণা সেই ঘুমের সময় ও সব জিনিসপত্তর পোটলা করে রেখেছিল। তার পরেরদিন মা অফিসে যাওয়ার সাথে সাথে ও আমাকে আবারও ডাবল পেগ অফার করে। এর পর কোন ফাঁকে কিছু না বলে দরজা খোলা রেখে বেরিয়ে যায়। সারাদিন দরজা খোলা থাকার পরও কোনো চোর আসেনি ঘরে। এটাও আর এক আজব কাণ্ড ঢাকা শহরে। সারাদিন দরজা খোলা! আমি তখন ডাবল পেগ মেরে বেহুশ হয়ে ঘুমাচ্ছি। অথচ চোর-ডাকাতের কোনো খবর নাই! ওরাও কি ডাবল পেগ মারলো নাকি? সন্ধ্যায় মা এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞেস করে। দরজা খোলা কেন? আমি বলি, জানি না। মুন্নি কই? তাও জানি না। মা এদিক-সেদিক চোখ ঘুরায়, দুই-তিন বার চোখ ঘুরানোর পর চিৎকার করে ওঠে। হায় হায়! মুন্নি কি সবকিছু নিয়ে ভাগছে নাকি? বাবু তুমি কখন ঘুমাইছো? জানি না, বলে ভালমত কিছু না বুঝেই কাঁদতে শুরু করি। কিছু স্পষ্ট না বুঝলেও এটা বুঝেছি যে একটা বড় রকমের ঝামেলা বাঁধিয়েছে মুন্নি শয়তানের বাচ্ছা। সুমন না গুমনের সাথে পালিয়েছে! এখন উপায়? মনে মনে বলি। মাকে কিছু বলি না। আমার আরো আগেই বলা উচিৎ ছিল। এখন কী বলবো তাও বুঝতে পারছি না। কিছু বলে আবার আমি না মাইর খাই! বসে রইলাম। পরিস্থিতি একটু শান্ত হোক। তারপর না হয় বলবোনে যে, মা আমি চিনি যেই ছেলের সাথে গেছে। তুমি যাও দোকানে গিয়ে খোঁজ নাও। ও হয়তো দোকানের পেছনেই আছে।
খানিক পর যেই বলেছি কোন দোকান কার দোকান, মা একসাথে এত প্রশ্ন করে যে কী বলছে তা বুঝতেও পারি না। বলি যে দোকান। কার দোকান, কিসের দোকান কিছুই জানি না। শুধু জানি মুন্নি দোকানে যায় এক ছ্যাঁচড়া পোলার সাথে দেখা করে। তুমি দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করো।
-নাম কী?
-গুমন।
-গুমন?
-না না, সুমন। ছেলের নাম সুমন। হ্যাঁ, মুন্নি তাই বলে।
শেষ পর্যন্ত মা সাদিয়া আন্টি আর সুমি আন্টিকে ফোন করে বাসায় আসতে বলে এবং মুন্নির পালানোর কথা বলতে গিয়ে একদম কেঁদে ফেলে। বেশ কয়েকবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মা কাঁদে আর কথা বলে। মার এই ফোঁপানোতে কাজ হয়। সাদিয়া আন্টি আর সুমি আন্টি কিছুক্ষণের মধ্যে এসে হাজির। বলে, এত চিন্তা করছিস কেন? আমরা আছি না। কোনো সমস্যা নাই। সব ঠিক হয়ে যাবে। চল, থানায় একটা জিডি করতে হবে প্রথমেই। তারপর না হয় শালীকে খোঁজা যাবে।
ওমা, সাদিয়া আন্টি দেখি খবিশের মতো গালি দেয়! শেষ পর্যন্ত মা আর সাদিয়া আন্টি যায় থানায়, আর সুমি আন্টি থাকে বাসায় আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্যে। আমি আর আন্টি তখন অনেক মজা করি। উনি আমার মাথায় হাত বোলায়, গায়ে হাত বোলায়। আবার কোলে নেয়ার চেষ্টা করে। যদিও এখন আমি অনেক বড় হয়ে গেছি। তাই পারে না, না পেরে হাসে আর হাঁপায়। না পারা যেন একটা মজার ব্যাপার! উনার হাঁপানো আর হাসিতে কেমন যেন ছেনাল-ছেনাল ভাব আছে। বলে, ওমা ছেলে তো লায়েক হয়ে গেছে! কোলে নেয়ার আর কোনো কায়দা নাই। ছেলেরই এখন বউ কোলে নেয়ার বয়েস হয়ে গেছে। বলে আর খালি হাসে। এই কথার মাঝে হাসির কী হলো আমি বুঝি না। আমার রাগ হয়, লজ্জাও লাগে। উনি খালি বিয়ে, বউ, জামাই ইত্যাদি-মার্কা কথা কয়। আর খালি হাসে। হাসতে হাসতে উনি আমার গায়ে হেলে ঢলে পড়ে। আমি কিছু বলি না। খালি হাসি। উনার কি হাসির ব্যারাম আছে নাকি কে জানে! আমাদের এত মন খারাপের মাঝেও উনি খালি হাসে। আর মজার মজার কথা কয়। আমি উনার কথার মাঝে খুব একটা মজা না পাইলেও দেখাদেখি হাসি, হাসতেই থাকি।
আমাদের এই হাসাহাসির যথেষ্ট সময় না দিয়েই মা আর সাদিয়া আন্টি ফেরত আসে। থানায় জিডি করা শেষ। এখন সাদিয়া আন্টি বলে চিন্তা করিস না, ওকে খুঁজে কোনো লাভ নাই, যদি আসে এমনিই আসবে। তবে আসলেও ওকে আর বাসায় রাখা যাবে না, রাখিস না। এই মেয়ে যে কোনো ধরনের অঘটন ঘটিয়ে বসতে পারে। থানায় জিডি করেছিস, এখন তোর দায়িত্ব শেষ। কিন্তু মার চেহারা থেকে দুশ্চিন্তার ছাপ যাচ্ছেই না। সাদিয়া আন্টি খুব অভয় দেয়ার চেষ্টা করছে। আর সুমি আন্টি খালি আছে আমার সাথে ফাইজলামি করার তালে।
মা আবারও সবগুলো রুম ভালভাবে পরীক্ষা করে বললো, জানিস সাদিয়া, মুন্নিনা ওর কাপড়-চোপড় ছাড়া প্রায় কিছুই নেয় নাই। এমনকি আমার বেডসাইড ড্রয়ারে হাজারখানেক টাকা ছিল তাতেও হাত দেয়নি। এই শয়তানের বাচ্ছা যে কোথায় গেছে, কার সাথে গেছে, ভাল ছেলে নাকি মন্দ ছেলে তাও তো জানি না। খুব টেনশান হচ্ছে, জানিস? এতদিন ছিল মেয়েটা! অনেক ভাল ছিল বলতে হবে। মাঝে মাঝে যে ঝামেলা করতো না তা বলবো না। কিন্তু ঝামেলা কে না করে ক? মুন্নি সেই তুলনায় কমই করতো বলা যায়। ভাল ছেলে ও কই পাবে? ভাল ছেলে এখন আর দেশে আছে নাকি? সব তো চোর-বাটপার, ডাইলখোর, খুনী-ডাকাত। জানিস সাদিয়া, আমার না খুব কান্না পাচ্ছে।
সাদিয়া আন্টি মাকে সান্ত্বনা দেয়, শোন, এত টেনশান করিস না। একটা ছেলের হাত ধরে যেহেতু গেছে, জেনে-শুনেই গেছে। এখন আল্লা আল্লা কর, যেন কোনো খারাপ কিছু না হয়।
সাদিয়া আন্টির এই কথা শুনে মা যেন আরো চুপসায়ে গেল। আমিও ভাবছি, আরো খারাপ আর কী হবে? চলে গেছে তো চলে গেছে। তার আবার খারাপ-ভাল কী? ফেরত আসলে মাকে বলবো ওকে ধরে আচ্ছামত বানান দিতে।
মুন্নি কিছুই নিয়ে যায়নি শুনে আমার মাথায় প্রথমেই আসলো ওর মা-বাবার কথা। ওদের নিয়ে গেছে, নাকি রেখেই চলে গেছে? যদি রেখে যায় তো তাদের এখন দেখাশোনা করবে কে? চিন্তাটা মাথায় আসার পর থেকেই ধান্ধায় আছি কিভাবে একবার খাটের নীচে গিয়ে দেখে আসবো। মা, সাদিয়া আন্টি আর সুমি আন্টি -না, সুমিকে আর আন্টি ডাকবো না, ও আমার সাথে বেশী ফাজলামি করে। ডাকবো সুমি। ওরা যখন মনোযোগ দিয়ে টেনশান করছে। এই ফাঁকে আমি গিয়ে খাটের নীচে দেখে আসলাম। ওমা, কিসের কী! ওর বাবা-মা ভাই-বোন যেমন ছিল তেমনি আছে! আমাকে দেখে কেমন যেন হৈ চৈ করে উঠলো। কিন্তু আমি বেশী আমল দেইনি। বাবা আমার দরকার কী! তোমাদের মেয়ে তোমাদের রেখেই প্রেম করতে চলে গেছে! এখন থাকো, বাক্সের মাঝে আরাম করে ঘুমাও! নাওয়া-খাওয়া সব বন্ধ। কিন্তু মা যদি আবার টের পায় সেই চিন্তায় আমি বেশীক্ষণ খাটের নীচে থাকিনি। কোনো কথাও বলিনি ওদের সাথে। কিন্তু এখন বেশ খারাপ লাগছে। মুন্নি এটা কিভাবে পেরে দিল? ও প্রত্যেকদিন আমাকে বলেছে, ও দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশী ভালবাসে ওর মা-বাবাকে। সারাক্ষণ ওদের চিন্তায় মশগুল -ওরা খেল কিনা, ওদেরকে গোসল দিতে হবে। মার অসুখ করেছে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে সে-সময় কই। সামনের ঈদে বাবার জন্যে জামা, মার জন্যে শাড়ি, বোনের জন্যে ফ্রক আর ছোট ভায়ের জন্যে একজোড়া রঙচঙে জুতা কিনবে। মুন্নি বলেছিল, ঝলমলে রঙচঙ ওর খুব পছন্দ। আসলে ওর সব কালারই পছন্দ, তাই এখন ঠিক করেছে ও যা-ই কিনবে সব মাল্টিকালার কিনবে। কবে যেন কোন এক বড়লোকের বাচ্চার পায়ে ও দেখেছে মাল্টিকালার মোজা আর মাল্টিকালার জুতা। কী সুন্দর! একই জুতার মাঝে টুকটুকে লাল, ময়ূরের লেজের মতো ঘন নীল, কাঁচা হলুদ আর ফাল্গুনের কচি ধানক্ষেতের মত সবুজ! কী যে সুন্দর। বলে একদম খুশিতে মুন্নি হাঁসফাঁস করছিল। সেই রাতেই মুন্নি গেল সেই জুতা চুরি করতে। চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লো। তারপর সেই বড়লোক মানুষটি মুন্নিকে অনেক চড়থাপ্পড় দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে রওয়ানা করলো থানার উদ্দেশে। ঐ লোকটা মুন্নিকে তুলে নিলো এক বিরাট হাতির পিঠে। তারপর ওরা যেতেই থাকে, যেতেই থাকে। পাহাড়, জঙ্গল, নদী, নালা, খাল, বিল পার হয়, কিন্তু পুলিশের আর দেখা পায় না। তারপর হঠাৎ করেই দেখলো কতকগুলো শুয়োর ওর দিকে এগিয়ে আসছে। দেখে, শুয়োরগুলো ওকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে! হঠাৎ দেখলো হাতিটাও উধাও হয়ে গেছে শুয়োরগুলোর ধেয়ে আসা দেখে। ও দাঁড়িয়ে আছে বিরাট এক মরুভ‚মিতে। চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে শুয়োরের দল। কিন্তু মুন্নি ভয় পাচ্ছে না। দলটা আরো কাছাকাছি আসতেই সে দেখলো, ওরা শুয়োর না, আসলে পুলিশ! পুলিশ দেখে ভয়ে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিন্তু ওর বুক থেকে ভয়টা কিছুতেই নেমে যাচ্ছিল না। তখনই ও ঠিক করেছিল চুরি ও করবে না। টাকা জমিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই জুতা কিনবে। এই কথা ও আমাকে কতবার যে বলেছে তার কোনো হিসাব নাই। আজ সেই মা-বাবা আর ভাইবোনকে খাটের নীচে রেখে ও চলে গেল? আমাকেও কিছু বলে গেল না? এ নাকি ওর ভালবাসা!
এরই মধ্যে সাদিয়া আন্টি আর সুমি শয়তান চলে গেল। যাওযার সময়ও সুমি আমাকে একটা চিমটি দিয়ে গেল। আমি আঁ করে উঠতেই সবাই হাসাহাসি করলো। এই শয়তানিতে মারও মনে হলো সায় আছে।
মুন্নির হারিয়ে যাওয়াটা মাকে এমন অক‚ল সাগরে ফেলে দিয়েছে যে, আমার বিস্মিত হওয়া দিয়ে ব্যাপারটা কভার করা যাচ্ছে না। মুন্নি থাকাকালীন তো কখনও এত ভালবাসা দেখিনি! গতকাল চলে যাওয়ার পরই শুরু হয়েছে মার ভালবাসার জোয়ার! এখন দেখছি মা মুন্নিকেই সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। মাকে এতটা ভেঙ্গে পড়তে আগে দেখিনি। এমনকি খবিশ চলে যাওয়ার পরও মার মধ্যে এতটা হতাশা আর কষ্টের ছাপ দেখিনি। মুন্নিকে মা সত্যিই খুব ভালবাসতো। নাকি মুন্নিকেই এখন মার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন? ভালবাসা কি ডিপেন্ড করে প্রয়োজনের উপর? কোথায় যেন পড়েছি। খবিশের পত্রিকায় হবে হয়তো, বা অন্য কোনো প্রত্রিকায়। আমার জ্ঞান তো সবই পত্রিকা থেকে। নাকি মা ঠিক করে রেখেছিল ছেলের বউ বানাবে? সে সাধ আর মার পূরণ হলো না! পাড়ার ছ্যাঁচড়া পোলার হাত ধরে মুন্নি ভাগলো। পুরো আকাশের ধোঁয়াধোঁয়া কষ্ট এখন মার চোখে। মা বসে আছে বারান্দায়, টিভির ভিতর নৌকাডুবির পর মদনচরে যেমন মানুষ বসেছিল পানির দিকে চেয়ে।
চলবে।