মাতাল শিশু ( পঞ্চম পর্ব)- মোয়াজ্জেম আজিম/ ধারাবাহিক উপন্যাস

  
    

        মাতাল শিশু

                      

  মোয়াজ্জেম আজিম

পঞ্চম পর্ব:
আমাদের বাসায় চমক একটার পর একটা লেগেই থাকে। এরই মধ্যে বলা নাই কওয়া নাই খবিশের বাবা এসে হাজির। আমি তো একবারে টাসকি, কয় কী, খবিশের আবার বাপও আছে নাকি? ও তো জন্মের বেজন্মা! আমারই যেখানে বাপ নাই! আমি তো ওর চাইতে হাজারগুণ ভালো মানুষ। তাও তো আমার বাপ আমার কোরো খোঁজখবর নিলো না কোনদিন। আর এই ইতরের বাপ নাকি আজমীর থেকে ছুটে এসেছে ছেলের খোঁজখবর নিতে। আজব না? মাও লোকটাকে দেখে খুশি হয় নাই। কিন্তু সামনে আবার বিরক্তিমাখা একটা হাসি দিয়ে বলেছে ‘আঙ্কেল চলে এসেছেন ভালো করেছেন। আমি কতদিন সাগরকে বলেছি আপনাকে ফোন করে বলতে একবার এসে ঘুরে যাওয়ার জন্যে। ও তো আমার কোনো কথাই শোনে না। বললেই বলে, এইতো করছি, করবো। এই বলে মা গজরগজর করতে করতে অন্য ঘরে চলে গেল। মা যেন লোকটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে, কে জানে এই মরণ কতদিনের জন্যে এসেছে। মানুষের যদি কোনো কাণ্ডজ্ঞান থাকতো। ঢাকা শহরে কোনো মানুষকে শুতে দেওয়া তো দূরের কথা, বসতে দেওয়ার জায়গা আছে? ছেলেরই যেখানে ঠাঁই নাই সেখানে উনার বাপ এসেছে ভাই ফলাতে! জন্মের খবিশ লোকগুলো দেখলেই গা জ্বলে! মার এই গজর-গজর অবশ্য নতুন কিছুনা। উনি সবকিছুতেই সামনে এক, আর আড়ালে আরেক। আমি প্রথম প্রথম অবাক হলেও এখন বুঝে গেছি, মানুষ এই রকমই। জন্মের মিথ্যুক মানুষ সত্যের বড়াই নিয়ে সারাক্ষণ খুনোখুনি করে।

মা আমার আর এক পেগ লাগবে। মনে মনে বললাম বটে কিন্তু এখন চিৎকার-চেঁচামেচি করলে খবর আছে। মার মেজাজ এখন চরমে। এখন পেগের বদলে থাপ্পড় আর ধমক জুটতে পারে। তার চেয়ে বরং খবিশের বাপকে দেখি। লোকটা আমার সামনেই জড়োসড়ো হয়ে বসা। উনি সোফায় বসলেও এমনভাবে বসেছে যেন সোফা টের না পায়। ভাবখানা এমন যেন সোফাও উনাকে যে কোনসময় বকা দিয়ে উঠতে পারে। যাইহোক উনি মুখে একটা দুশ্চিন্তার ছাপ ফেলে বসে থাকলেও কোথায় যেন একটা পুলকও উনার মধ্যে কাজ করছে। সব কিছু দেখছে খুব কৌত‚হল নিয়ে, যেন জীবনে উনি প্রথম কোনো সোফায় বসে টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখছে। যদি এই মুহূর্তে টিভি বন্ধ। কারেন্ট নাই। আমাদের টিভি সাধারণত বন্ধ হয় না। মা মাঝে-মধ্যে বন্ধ করলেও বাসা থেকে বাইর হওয়ার সাথে সাথে হয় খবিশ, না হয় মুন্নি চালু করে দেয়। এখনও মুন্নি ঘরে ঢুকে টিভি চালু করার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলো যে কারেন্ট নাই। তারপর লোকটাকে দেখে বলে সালামালিকুম, আঙ্কেল। ও কিন্তু জানে যে একজন মুরুব্বী ঘরে বসা, তাও প্রথমে পাত্তা না দিয়ে যেন মুরুব্বীকে বুঝিয়ে দিলো আপনাকে এতো পাত্তা দেওয়ার কিছু নাই। মুন্নি অবশ্য খুবই চালাক। ও খুব ভালো করেই জানে মাকে কিভাবে খুশি রাখতে হবে। লোকটা থতমত খেয়ে অলাইকুমআসসালাম বললেও উনার কথাগুলো গোঙ্গানীর মতো শোনায়। মুখে লজ্জিত হাসি নিয়ে মুন্নিকে দেখে, যেন দুর্গত এলাকার কোনো ক্ষুধার্তদের খাবার নিয়ে উড়ে আসা হেলিকপ্টার দেখছে। মুন্নি একটা ছেলান মার্কা হাসি উনাকে উপহার দেয়। উনি আরো বেশী লজ্জিত ও কুণ্ঠিত বোধ করেন। মুন্নি উনার সামনে দিয়ে বসন্তের বাতাস উড়িয়ে চলে গেলেও উনি মুখ খুলে আর কিছু বলার সাহস দেখান না। উনি মূর্তির মতো বসে থাকেন বন্ধ টিভির দিকে মুখ করে।
মা এসে আমাকে বাজের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে যান। এবং সব কিছুতেই ধুপধাপ করছেন, রাগে গজর-গজর করছেন। এটা কতক্ষণ চলবে কে জানে। এরই মধ্যে খবিশের সাথে ফোনালাপ শেষ। বাবার আগমন উপলক্ষে তার আজ বাসায় দুপুরে আসা হবে না। রাতেও ফিরতে দেরি হবে। মা অবশ্য বলেছে তুমি আসো। এসে এই আপদ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করো।
মা বললো বটে কিন্তু খবিশ কী আর মার কথা শুনবে? ও তো নিজের ধান্ধায় ব্যস্ত। বাপ যদি বড়লোক হতো, টাকার কুমির হতো তাহলে আর মাকে বলতে হতো না, বাসায় এসে এই আপদ বিদায় করো। ও নিজেই গিয়ে সদরঘাটে বসে থাকতো অন্তত একদিন আগে। এখন খবিশের বাপ আরেক ধান্ধাবাজ এসেছে মাকে জ্বালাতন করতে। ছেলের জ্বালাতনের উপর বাপ এসেছে বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়ে। মা এতসব রাগ কিভাবে হজম করে?
এরই মধ্যে চলে গেল বেশ কয়েকদিন। খবিশ মধ্যরাতে আসে ভোররাতে চলে যায়। বাপকে দেখা দেয় না। আগে তো জানতাম বাপ ছেলেকে দেখা দেয় না, যেমন আমার বাপ। এখন দেখছি ছেলেও বাপকে দেখা দেয় না। খবিশের বাপও নিশ্চয় একসময় খবিশকে পাত্তা দিতো না। এখন খবিশ দিচ্ছে না। বাপ-ছেলের চোর-পুলিশ খেলা।
এদিকে খবিশের বাপ বড়খবিশ বসে আছে ছেলের সাথে দেখা না করে, চিকিৎসা না করে কিছুতেই ঢাকা ছাড়বে না। তাতে কে খুশি হলো আর কে বেজার হলো তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। তবে খবিশের বাপ মনে হয় মুন্নির প্রেমে পড়েছে। সারাক্ষণ মুন্নির পেছন পেছন লেগে থাকে। মা না থাকলে মুন্নিকে রাণীর মতো বসিয়ে সব কাজ নিজে করে দেয় আর বলে, তুমি আমার জান, তোমাকে কষ্ট করতে দেখার চাইতে মৃত্যও ভালো। মুন্নি মিটিমিটি হাসে। আর আয়েশ করে বসে টিভি দেখতে থাকে। খবিশের বাপ এক কাপ চা আর পিরিচে দুটো টোস্ট নিয়ে আসে মুন্নির জন্যে। বলে, মহারাণী তোমার জন্যে। মুন্নি কিছু বলে না। যেন সে সত্যি কোন অজানা রাজ্যের রাজকুমারী। ফুরুৎ ফুরুৎ শব্দ করে চায়ে চুমুক দেয়, বিস্কুট খায় টিভির দিকে অপলক তাকিয়ে। যেন সে যাদুকরের ম্যাজিক আয়নায় দেখছে তারই রাজ্যের আজবলীলা। দেখছে, কেবল দেখছে। রঙিন টিভির বর্ণিল রঙের ছটা মুন্নির মুখাবয়বে তৈরী করে ভাবনার ফানুস। সে ব্যথিত হয়, হেসে ওঠে, গভীর ভাবনায় কপালে ভাঁজ ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করে, দুঃখী মানুষের জন্যে তৈরী করে দরদ মাখানো বয়ান, জনতার উদ্দেশ্যে একটা ঘোষণার জন্যে তৈরী হতে গিয়ে অন্ধকারে ঢুবে যায় বিদ্যুতের অভাবে।
তারপর খেয়ালী রাজকন্যা আবদার করে, দাদু, তুমি আমাকে গল্প শোনাও।

অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা

দাদু অন্ধকারে বসে নিজের গড়া রাজকন্যাকে আলোর দেশের গল্প শোনায়। বলতে বলতে মুন্নিকে নিয়ে যায় কামরূপকামাক্কার যাদুরাজ্যে। যেখানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব বড় বড় ওস্তাদের ওস্তাদ যাদুকর বাস করে। সে দেশে পানি নাই, আকাশের মেঘ শান্তির কবুতর হয়ে উড়ে বেড়ায় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সাদাসাদা বরফের কবুতর ধরে মুখে দিতেই পানি হয়ে যায়। মজা না! মুন্নি বিস্ময়ের ঘোরে বুড়ার আরো কাছে চলে আসে। এত কাছে যে একজনের নিঃশ্বাসে আর-একজনের চুল উড়ন্ত কবুতরের পালকের মতো শিহরিত হয়, নড়েচড়ে উঠে। সেদিকে কারো কোনো খেয়াল নাই। কেবলই গল্প বলা আর শোনার মাঝে বিচরণ। কবুতরের পাখনায় ভর করে দুজন যাদুরাজ্যের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ায়। বুড়া গল্প করে তার যৌবনের, গল্প করে কিভাবে যাদুরাজ্যের রাজকন্যার মন জয় করেছিল, কিভাবে করেছিল রাণীর মন জয়। শুধু ওস্তাদের মন জয় করতে পারেনি বলে আজ তার এই দশা। ওস্তাদের অভিশাপে আজ আর তার যাদুবিদ্যা কাজ করে না। তবে সর্পবিদ্যার কিছু কৌশল কাজে লাগায়ে সে সর্পরাজ কিতাব আলী সর্দারের মন জয় করতে পেরেছিল। তিনি খুশি হয়ে তার সাথে কাজ করার অনুমতি দেন। তারপর দীর্ঘ দশ বছর ওনার সাথে বনেজঙ্গলে পাহাড়-পর্বতে ঘুরে বেড়ায়। নদীয়া, কুলাওড়া, ধলেশ্বর, পানিশ্বর, জৈন্তা, বিষণাকান্দি, বাঘেশ্বর, আসাম, আশুলিয়া, আম্মাপাড়া, কাপড়তোলা, চৌদ্দশ কুদাল্লে, আজমিরী, সাপাত সহ এমন হাজারো দেশে সাপ ধরে সর্পরাজ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করলে ওস্তাদ সর্দার কিতাব আলী খুশি হয়ে উনার মেয়ের সাথে তার বিবাহ দেন। সেই কন্যা নূরীর প্রথম সন্তান সাগর।
-ছেলেটা জন্মের পর পর, বোন তোরে কী কইতাম! চারদিক আন্ধার কইরা বিপদ নাইমা আসলো আমার মাথার উপর। যে বছর ছেলেটা জন্মাইল সেই বছর আচম্বিত এক শিলাবৃষ্টিতে এলাকার সাপখোপ, শিয়ালবেজী সব মইরা সাফ। আমার ব্যবসা বন্ধ। সাপধরা, সাপের চামড়া, বিষ, হাড়গোড় এইগুলা  বিক্রি করতাম আসামের বৈদ্যিবাজার কাপড়তোলায়। এখন কী করি? শুধু কী সাপই মরলো কৃষকের মাথায়ও বাড়ি। তখন সবেমাত্র ধানকাটা শুরু। মানুষ খালি পয়লা বৈশাখের জন্যে এক মুট কি দেড় মুট ধান কাইটা আনছে। তার তিন দিনের মাথায় শিলাবৃষ্টি। হাজার মণ ধান পাওযা কৃষকও সেই বছর না খায়া থাকছে। সারা এলাকার মানুষ একরকম না খায়া পার করলো একটা বছর। তোর নানু খালি চটি থেক্কে উঠছে। হায়রে, মানুষটা পেডের ভুকে কুত্তার মতো খালি আমাকে গালিগালাজ করতো। আমি কী করি ক, সারা দিনরাত বনেবাদাড়ে ঘুইরাও কিছুর কোনো সন্ধান করতে পারি না। এক সের চালের ব্যবস্থাও করতে পারি না সারা দুনিয়া ঘুইরা। এই করতে করতে আইলো দেশে পানি। বর্ষাকাল, চারদিকে জলাতলা পানি। সারাদিন পানির মধ্যে পইড়া থাইকাও তিন টাকার মাছ ধরতে পারি না। কষ্টের দিন যেন আর শেষ হইবো না। একদিন তোর নানু দেখি একটা বড় পাতিল বাইর করছে। আমাকে কয় পোলাডারে পানিতে ভাসায়ে দিমু। যদি আল্লার রহমত থাকে তো নিশ্চয় কোন ধনী মানুষের বাড়ি গিয়া উঠবো। মুছা নবী নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেইকা বাইচা থাকছে ফেরাউনের বাড়িতে। আমার পোলাও যদি হায়াত থাকে তো মরবো না। তর মতো নিমুরাদ্দের বাড়িতে থাকলে পোলা আমার না খায়াই মরবো। তার চাইতে জ্যান্ত ভাসায়ে দেই। যদি মালিক বাঁচায় তো বাঁচবো, না হয় আল্লার মাল আল্লায় নিয়া যাইবো। আমার প্রথম সন্তান। কথাটা শুইনা কী করছি আর মনে নাই। তোর নানীরে বকছি, মারছি, চুল ধইরা টাইনা খাড়া করছি, আবার ধাক্কা দিয়া মাটিতে ফালাইছি। পাগলের মতো কিছুক্ষণ কী করছি এখন আর মনে নাই। তারপর গিয়া ইস্কুল ঘরে বইসা ছিলাম। খিদা, গরম আর লাগাতার উপোস্যে শরীর, কোন ফাঁকে যে ঘুমায়ে পড়ছে, তা বুঝবার পারি নাই। স্বপ্নে দেহি তোর নানী আইসা আমাকে ডাকে, কয় উঠো, রান্না হইছে, খায়ে ঘুমাও। গোস্তের গন্ধে সারা বাড়ি মউমউ করতাছে। আমি খাইতে বসলাম। বাসনভরা ভাত, তার উপর টিলার মতো উঁচা কইরা দিছে গোস্ত, কী সুন্দর কচি খাসির গোস্ত। আমি কয়েক লোকমা খায়ে জিগাই, কিগো গোস্ত কই পাইলে? তোর নানী মুচকি হাসি দিয়া কয়, নিজে খায়েও বুঝো না? তোমার পোলার গোস্তই তো। বোন চিরিং কইরা সারা শরীরের রক্ত মাথায় উইঠা আসলো, সারা শরীর মোছর দিয়ে বমি আসতে চাইলো। ঘুম গেল ভাইঙ্গা। উইঠা দেহি ইস্কুল ঘরের পাশে এলাকার ছেলেছোকরারা রিলিফের দুম্বা দিয়া খিচুরি পাকায়। গিয়া বসি ওদের পাশে, জানায় দুইদিন ধইরা খাওয়া নাই। পোলাগুলা খুব ভালা আছিলো। তয় এলাকায় সাপখোপ ধরি বইলা আমারে কয়েকবার নিষেধ করছে। আমি তাদের কথা শুনি নাই বইলা খুব রাগ আছিলো আমার উপর। একজন তো কয়, আমারে খাওয়া দেওন যাইবো না। কয়, ও এলাকার সাপখোপ মাইরা শেষ কইরা ফালাইতাছে। ওরে জামাই আদর কইরা খাওয়ানের কিছু নাই। শেষমেষ আর একজনের উছিলায় এক বাটি খিচুরি দিলো। বউ বাচ্ছার জন্যে মিনুতি কইরা আরো দুই চামচ বাড়তি লইয়া বাড়ি আইলাম।
বাড়ি আইসা দেখি পোলাডা উটানের মধ্যে শোয়া, তর নানী নাই। এদিক দেখি সেদিক দেখি, ভাবলাম জঙ্গলে গেছে বুঝি। এদিকে খিচুরির মধ্যে আঙ্গুল চুবায়ে পোলাডার মুখে দেই, আমিও একটু চাটান দেই, বাপবেটা চাটতে চাটতে খিচুরি শেষই কইরা ফালাইতাছি, তোর নানী আর আসে না। শেষে উইঠা বাইর হই, এদিক খুঁজি সেদিক খুঁজি, পাড়াপরশি সবাইরে জিগায় কেউ জানে না কই গেল, কেউ দেখে নাই কহন গেল। সারা দেশ খুঁইজাও তার কোনো হদিস পাইলাম না।
এহন পোলা নিয়া পরছিনি আমি বিপদে। আমি এই পোলা নিয়া কী করি ক। শেষে দিশবিশ নাই পাইয়া আতকাপাড়ার মলুমিয়ার কাছে এই পোলারে বিক্রি কইরা দিলাম ১০ টাকায়। এই ১০ টাকা লইয়া আমি রওয়ানা করে দিলাম নিরুদ্দেশে।
মলুমিয়া লোক ভালো। ছেলেরে আমার পড়াশুনা করাইছে। কিন্তু মানুষ করতে পারে নাই। এই পোলা বড় হওয়ার পর এলাকায় নানা আকাম-কুকাম কইরা দেশের মানুষরে জ্বালায়ে খাইতো। তারবাদে পরিস্থিতি যখন চরম। দেখলো দেশের মানুষ ক্ষেপছে, ধরতে পারলে হাড়গোর আর আস্ত থাকবো না, তখন কেমনে কেমনে ঢাকায় আইসা এখন বড় অফিসার। মেলা টাকা কামায় করে, কিন্তু বাপরে দেখে না। পালকবাপের খোঁজও কোনদিন লই নাই। এ কেমন মানুষ হইলো ক। বুড়ার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে সেইদিকে খেয়াল হইলে সে বাম হাতের তালু দিয়ে চোখ মোছে। মুন্নির চোখে কান্নার বদলে বিস্ময়ের আলোকরশ্মি ঝিকমিক করে।

শেষ পর্যন্ত খবিশের সাথে তার বাপের দেখা হয়। মা-ই খবিশকে কঠিন ধমক দিয়ে বলেছে, প্লিজ আসো, দেখা করে কী করবে করে এই আপদ বিদায় করো। আমি আর পারছি না।
খবিশের বাপেরও মনেহয় ছেলের সাথে দেখা করার ইচ্ছা নাই। ভাবখানা এমন ভালোই তো আছি। ছেলের সাথে দেখা হওয়া মানেই সমস্যা শেষ। আর সমস্যা শেষ মানেই তখন দেশে ফেরত যাওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। তার চাইতে এ-ই ভালো, খাওয়া, ঘুম, তরুণীর সাথে রসালাপ। এমন আতিথেয়তা ছেড়ে কেউ যেতে চায়, না যেতে পারে? সেদিনও খবিশ অনেক রাতে আসে। এসে বাপকে ডেকে তোলে। কিন্তু আজব ব্যাপার, খবিশ কিন্তু খবিশের বাপকে বাপ বলে না। বলে, ওঠেন, আপনার সাথে কথা আছে। বলেন কী করতে হবে আমাকে?
খবিশের বাপ ঘুম থেকে উঠে বিস্ময়ে কী এক ঘোরের মধ্যে বসে থাকে, কিছ্ইু বলে না। খবিশ অনেকটা ধমকে ওঠে, বলেন, কেন এসেছেন?
খবিশের বাপ থতমত খেয়ে নড়েচড়ে বসে তারপর শুরু করে, বাজান শরীলডা খুব খারাপ। কলজার মধ্যে ব্যথা। কাজকর্ম কিছুই করতে পারি না। বাজান একটু চিকিৎসা করায়ে দেন, যেন একটু কাজকর্ম কইরা খাইতে পারি। ভিক্ষা করতে হইলেও তো ঘরের বাইর হইতে হয়। ব্যথা যখন উঠে তখন আর খুপড়ি থেকে বাইর হইতে পারি না। এক গেলাস পানিও ঢাইলা খাওয়ার ক্ষেমতা থাকে না। দুইদিন-তিনদিন না খায়া থাকি। তারপর যখন ব্যথাটা একটু কমে তখন কুত্তার মতো চারদিকে ছুটাছুটি করি খাওয়ার জন্যে। বাজান, একটু চিকিৎসা করায়ে দেন। খবিশের বাপের চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ে সে হাতের তালুতে চোখ মুছে।
খবিশ নরম গলায় বলে, শোনেন আমার তো সময় নাই। দেখতেছেন তো দিনরাত কাম করেও ডালভাত যোগাড় করতে পারি না। তাও আপনারে আমি কিছু টাকা দেই, দেশে গিয়া চিকিৎসা করান। ঢাকা শহরে আদতে কোনো চিকিৎসা নাই। সবই টাকার খেলা আর মানুষের মনের সন্তুষ্টি। টাকা দেই দেশে গিয়া চিকিৎসা করান।
-বাজান, টাকা-পয়সা কিচ্ছু চাই না। একটু চিকিৎসা করায়ে দেন। আমি দু-একদিনের মধ্যে চলে যাবো।
অনেক কথার পর মা এসে হাজির হয়। মা বলে, সাগর, একদিন কাজ থেকে ছুটি নিয়ে হলেও তুমি উনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। তারপর উনারে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে লঞ্চে উঠায়ে দিয়ে আইসো।
ঠিক হয় পরশু বাপকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে খবিশ। সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যায়। কিন্তু নিশ্চিন্তের ঘুম ভাঙ্গে কঠোর এক চিন্তার ঝনঝনানিতে। আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি সবাই চিন্তায় বিমর্ষ। মুন্নি এক কোনায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। খবিশের বাপ আর-এক কোনায় ফাঁসির আসামীর মতো ঝুলে পড়ার অপেক্ষায়। মা দাঁড়িয়ে আছে, ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ, যেন বিজ্ঞ বিচারক দণ্ড কার্যকর করার আদেশ হাতে। খবিশ জল্লাদের ভ‚মিকায় কম্পিত। খবিশের এই হম্বিতম্বি রাগে, না দুঃখে, না শাস্তি দিতে পারার আনন্দে তা বোঝা যাচ্ছে না। এ যেন বহুদিন পর খুঁজে পাওয়া চিরশত্রæকে শিক্ষা দেওয়ার আয়োজন। শেষ পর্যন্ত মা-ই ত্রাণকর্তী। হঠাৎ করে মা তার চড়া গলা নরম করে বলেন, আঙ্কেল শোনেন, যা হওয়ার হইছে। এই নেন, এখানে দুই হাজার টাকা আছে যা খুশি কইরেন। এখন বাজে সাড়ে চারটা, চলে যান সদরঘাট। ছয়টার লঞ্চ ধরতে পারলে সন্ধ্যায় পৌঁছে যাবেন আজমিরী। ডাইরেক্ট সুনামগঞ্জের লঞ্চে উঠবেন, ওরা আজমিরী নামায়ে দেবে। যান যান, দেরি কইরেন না। খবিশের বাপ রাজ্যের শক্তি দুই পায়ে জড়ো করে উঠে দাঁড়ায়। হাতের পোটলা আর টাকাটা নিয়ে মাথা যতটা সম্ভব নীচু করে বেরিয়ে যায়।
খবিশ বুড়া বের হওয়ার সাথে সাথে ধাম করে দরজা লাগিয়ে দেয়। ঘরের সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। গরীব মানুষ খুব যন্ত্রণা করতে পারে। খবিশ প্রায়শই বলে ‘গরীর নাকি গজবের পয়দা’। কথাটা আমার বুঝতে বেশ সময় নিয়েছে। কিন্তু এখন মনেহয় ভালোই বুঝি। গরীব গজবের পয়দা, গরীব মানুষকে আল্লাও পছন্দ করে না।
মুন্নি অবিরাম কেঁদেই চলেছে। মা বলে, যা আর কাঁদতে হবে না, ঘুমা গিয়া।
শুনে মুন্নির কান্না যেন একটু বেড়ে গেল।
-কী, ব্যাথা পেয়েছিস?
-হ্যাঁ।
-তাহলে আগেই চিৎকার করলি না কেন?
-চিৎকার করতে লজ্জা লাগে।
-কানতে লজ্জা লাগে না?
-লাগে তো।
-তাহলে কান্দস কেন?
-না কান্দে তো পারি না।
-আচ্ছা কান্দ। তারপর ক উনি তোরে কেন ঝাপটায়ে ধরলো?
-উনি আব্বেইতি মেয়েদের মাথা খাইতে চায়।
-তুই কেমনে জানস?
-উনি নিজেই কইছে।
-কী কইছে?
-কইছে, উনিতো যাদুরাজ্যে ছিলো, তখন উনার ওস্তাদের কাছ থেকে একটা ওষুদ আনছে, এই ওষুদ খাওয়ার সময় যদি আব্বেইতি মেয়েদের সাথে ঘুমাইতে পারে তাইলে নাকি চিরযৌবন লাভ করতে পারবে।
-তুই এই কথা আমারে আগে বললি না কেন?
-আমি তো ভাবছি উনি মজা করার জন্যে এই কথা কইছে।
-ঠিক আছে যা ঘুমা গিয়া।
সবাই আমরা যার যার বিছানায় যাই একটা চরম স্বস্তির অনুভূতি নিয়া। আপাতত এক আপদ বিদায় হয়েছে এক উসিলায়। মাকে মনে হলো বেশী রিলাক্স। মুন্নি তথৈবচ, আর খবিশ এখনও উত্তেজিত। যাইহোক আমরা সবাই ভোরের আলো ফোটার আগেই সেদিন ঘুমে পতিত হওয়ার চেষ্টায় রত হলাম।
চলবে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments