মাতাল শিশু (১২তম পর্ব)/উপন্যাস/ মোয়াজ্জেম আজিম

  
    
মোয়াজ্জেম আজিম

১২তম পর্ব:
সুফী কাম কৃষক কাম ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুরে আসার পর বেশ কিছুদিন পার হয়েছে। মাকে কেমন যেন স্বপ্নের ঘোরে পেয়েছিল। ভাবখানা এমন যেন মুসকিল আসানের পথ উনি পেয়ে গেছে। কয়েকদিন বেশ কয়েকবার উনার সাথে ফোনে কথা বললো। আবার যাওযার প্লান করলো। যদিও মিরপুর যাওয়া বাসাবো থেকে অনেক বড় ঝামেলার কাজ, কিন্তু মা এখন এসব ঝামেলাকে মোটেও ঝামেলা মনে করে না। উনি এখন মঙ্গলগ্রহেও যেতে রাজি আছে আমার চিকিৎসার জন্যে। মার এই বাড়াবাড়ি রকম ভালবাসার কারণ কী আমি বুঝি না। এটার নাম কি নাড়ির বন্ধন? বাবার সাথে কি ছেলের নাড়ির বন্ধন থাকে না। থাকবো কেমনে, মানুষতো আর বাবার পেট থেকে বাইর হয় না। আবার মাঝে মাঝে এও চিন্তা করি মার জন্যে কি আমি এত হ্যাসেল সহ্য করবো? করবো কেন? মার নাড়ির সাথে আমার বন্ধন, আমার নাড়ির সাথে তো আর মার বন্ধন নাই? এই জন্যে মার এই কষ্ট আর চেষ্টাটা আমার কাছে মাঝে-মধ্যে ধন্দ তৈরী করে। দুনিয়াটা কি তাহলে মেয়েদের আর মায়েদের গড়া? এই সংসার, সমাজ, দেশ? না, শুধু সংসারটা মাদের গড়া, বাকী বাবারা গড়েছে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার কাজে। তৈরী করেছে সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতি, আইন, কানুন, রীতিনীতি সব। সবই তাদের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত। মা’রা শুধু তার নাড়ি ছিঁড়ে বেড়িয়ে আসা সন্তানের জন্যে একটা ঘর আর খাবারের নিশ্চয়তাটুকু চায়। কিন্তু তারা এইটুকু বোঝে নাই যে এই সংসারের বীজ থেকেই সমাজ, ধর্ম আর রাষ্ট্রের জন্ম। আবার এই সমাজ, ধর্ম বা রাষ্ট্রই তাদের হাতে পায়ে পড়িয়েছে সোনার শিকল, দিয়েছে চলন-বলনের নানান রীতিনীতি।
বাহ বেশতো! আমি তো ভালই গভীর চিন্তাভাবনা করতে পারি ইদানিং! অনেক কিছুই পারি, শুধু বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে দুনিয়ায়। মানুষের এই অনেককিছু পারাই মনে হয় তার নিজের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পারার প্রতিযোগিতায় মানুষ এখন মরিয়া। সবাই এমন কিছু পেরে দেখাতে চায়, যা মানুষ আগে কখনও দেখেনি। আর তা দেখাতে গিয়ে যদি নিজের বা ভবিষ্যৎ বংশধরের বারোটা বাজলো তো কার কী এসে যায়! নিজের বুদ্ধিমত্তা, ক্ষমতা, জ্ঞানগরিমা, সর্বোপরি নিজের অস্তিত্ব জাহির তাকে মানুষরূপী দানবে পরিণত করছে। এখন একজনই হাজার জনের চেয়ে বেশী কাজ করতে পারে। এখন একজনই একটা বিরাট ফ্যাক্টরী চালাতে পারে যা আগের দিনে লাগতো একহাজার জন; এখন একজনই চালাতে পারে এমন এক জাহাজ যা হাজার মানুষের পক্ষেও নাড়ানো সম্ভব না; এখন একজনের হাতে নিক্ষেপিত একটি বোমা-ই ধ্বংস করে দিতে পারে একটি দেশ! কিছু মানুষ দানবে পরিণত হয়েছে। আর বেশীরভাগ মানুষ পরিণত হয়েছে গরু-ছাগলে। যারা সারাদিন ঘাসের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরেও ভুরিভোজনের ব্যবস্থা করতে পারে না। এমন নজির হাজারটা দেয়া যাবে। তবু মানুষকে থামানো যাবে না।
যেমন এখন থামানো যাবে না খবিশকে। খবিশ এখন মরিয়া কিভাবে টাকা কামাবে। ম্যাজিক লোশন নিয়ে মার সাথে কয়েকদিন ধরে ঝগড়া চলছে। মা স্পষ্ট বলে দিয়েছে কোনরকম দুই নম্বরী উনি সহ্য করবে না। আর খবিশের কথা হলো ব্যবসাকে যদি তুমি দুই নম্বরী বলো তবে দুনিয়াতে সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে হবে। দুনিয়া অচল হয়ে যাবে। কোনকিছুই আর থাকবে না। এই যে এত উন্নতি, টাকাপয়সা, গাড়িবাড়ি, বিলাসব্যাসন -তার সবকিছুর পেছনেই ছিল ব্যবসা। আমাদের পেয়ারা নবীও ব্যবসা করতেন। তিনি কি তখন দুই নম্বরী করতেন? কিন্তু মা শেষ পর্যন্ত পুলিশে খবর দেবেন বললে খবিশের চেহারা জুড়ে নেমে আসে কালবৈশাখী ঝড়ের পূর্বাভাস। ঝড়পূর্ব নীরবতায় নিমজ্জিত হয় আমাদের তিন রুমের এই বাসা।
আমরা সারারাত একটা গুমোট-ভ্যাপসা গরমে পার করি। সকালে সবাই ওঠার আগেই খবিশ বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর মাও যায় তার অফিসে। মা তার পূর্বের চাকরীতে যোগ দিয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। কাজ না করে কি আর বেশীদিন চলতে পারবে? যদিও এখন খবিশ চায় মাকে টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতে। কিন্তু মা মনেহয় ওকে টাকা দেওয়াতে এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে এখন আর ওর কাছ থেকে নিতে পারে না। যাই হোক, ওনারা কাজে চলে গেলে আমাদের ভালই হয়। মুন্নি আর আমি এখন অনেক খেলতে পারি। গল্পগুজব করতে পারি। এমনকি মু্িন্নকে মাঝে-মধ্যে জড়িয়ে ধরেও কেমন যেন সুখ পাই, যা আগে পেতাম না। মুন্নিও আমার সাথে ইদানিং ছেনালীর মাত্রা মনেহয় বাড়িয়ে দিয়েছে। খবিশ এখন আর আগেরমত প্রত্যেকদিন ফাঁকে-ফোঁকরে আসে না। ধরা খাওয়ার পর মাও নানারকম চেকের মধ্যে রাখে। খবিশ বা মুন্নি দুইজনই কোনরকম রিস্ক নেওয়ার সাহস দেখায় নাই বহুদিন। তাতে আমার হয়েছে সুবিধা। মুন্নিও দিন-কি-দিন আমার হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও আমিও ভয় পাই যদি মা টের পায় তো দুজনকেই কয়েক টুকরা করে ফেলবে। কাজেই বাড়াবাড়ি রকমের কিছু করার সাহস আমারও নাই। কিন্তু ওর উপস্থিতি ভাল লাগে। খবিশের সাথে মাখামাখি করছে না ভাবলে আরো ভাল লাগে। মুন্নি অবশ্য ওর মা-বাবা আর ভাইবোনের সাথে গল্প করে কিছুসময়। তখন বলে যে আমি যেন সামনে না থাকি। সামনে থাকলে ওর লজ্জা লাগে। ওর মা-বাবাকে ও একটা জুতার বাকসে লুকিয়ে রাখে। সেখানে তারা তিনজন থাকে। একটা ওর মা, একটা বাবা আর একটা ছোট বোন। মা বা খবিশ ঘরে না থাকেল ও ওদেরকে বাইর করে কথা বলে। প্রথম প্রথম আমার কাছেও লুকাতো, এখন আর লুকায় না। আমি ওকে কথা দিয়েছে মাকে বলবো না। ও অবশ্য মাকে বলেছে ওর মোবাইল ফোন লাগবে। ও ওর মা-বাবার সাথে কথা বলতে চায়। ওর আসল মা-বাবা থাকে গৌরিপুর, আর জুতার বাক্সে থাকে পুতুল মা-বাবা। ও বলে, মা-বাবার সাথে কথা না বলে কি থাকা যায়? গৌরিপুর কোথায় তা আমাকে মুন্নি বলেছে। ট্রেনে করে যেতে হয়। না না, প্রথমে রিকসায় করে কমলাপুর স্টেশন, তারপর ট্রেনে করে ময়মনসিং, তারপর বাসে করে গৌরিপুর সদর। সেখান থেকে আবার রিকসা করে বিশ্বনাথ মন্দির, তারপর একটু হাঁটলেই ওদের বাড়ি।
মা তো ওর মোবাইল লাগবে শুনে এমন করছিল যেন তিনি চড়ক গাছে উঠেছেন। মুন্নি কিন্তু খারাপ কিছু বলেনি। শুধু বলেছে তার একটা মোবাইল লাগবে। তাতেই মা এবং খবিশ এমন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো যে আমি পড়ে গেলাম মহা ধন্দে। ব্যাপার কী? কিছুই তো বুঝতে পারতেছি না। মুন্নি মোবাইল ইউস করলে মার ক্ষতি কী?  মা আর খবিশ মিলে তো দুইটা করে মোবাইল নিয়েছে! এখন অবশ্য মা বাইরে গেলে একটা মু্িন্নর কাছে রেখে যায়। আর বলে যায়, ‘মুন্নি, ফোন করবো ঘণ্টায় ঘণ্টায়, ঠিকাছে? ফোনের কাছাকাছি থাকিস।’ তারপর থেকে মা ফোনে মুন্নির সাথে এবং আমার সাথে ঘণ্টায় ঘণ্টায় কথা বলে।  কিন্তু ফোন চাওয়াতে মা কেন ক্ষেপে গেল, আর সাথে সাথে খবিশও? খবিশ অবশ্য অন্য ধান্ধায় আগেই জেনেছি। মার সামনে মুন্নির উপর রাগ দেখায়, আর মার আড়ালে দেখায় মার উপর রাগ। খবিশ মু্িন্নকে বলেছে, ‘ওর সামনে যদি গালাগালি করি তো বুঝবি নাটক, সত্যি না। বুঝিস না?’ মুন্নি মাথা নাড়ে। এবং তখন থেকে খবিশের গালিতে মুন্নি আর রাগ করে না। করলেও আর্টেফিসিয়াল, মাকে দেখানো। আজকেও খবিশের গালাগালি শুনে মুন্নি মুচকি মুচকি হাসছিল। আমি কিন্তু সবই দেখি। মা অবশ্য রাগের ঠেলায় কিছুই দেখতে পায় না। আর এমনিতেই মার চোখের সমস্যা। চশমা ছাড়া দূরের জিনিস কম দেখে। অবশ্য মা কম দেখলে কী হবে, বোঝে কিন্তু অনেক বেশী। মা না দেখে অনেক কিছু বলে দিতে পারে। মুন্নি কী করে, কী বলে সব। খালি খবিশের কোনকিছুই মা খুব একটা বুঝতে পারে না। খবিশ মাকে যা বোঝায় মা তা-ই বোঝে, তা-ই সত্যি মনে করে। মাকে তখন আমার অনেক বোকা মনে হয়। পারে শুধু মুন্নির বেলায়। মুন্নিও ইদানিং মাকে আর পাত্তা দেয় না। এখন সে হাসি হাসি মুখ যতটা সম্ভব নিচু করে মাকে বলে, যদি মোবাইল কিনে না দেয় তো কাজ করবে না। ভাবখানা এমন যেন বলতে লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু মাথা নিচু করাতে ও হাসছে, না কাঁদছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মাও সবসময় বুঝলেও এখন ঠিক ধরতে পারছে না আসলে মুন্নির মনোভাবটা কী। মা বলে গরীবের ঘোড়া রোগ। উনি রাগে গজগজ করতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে মোবাইল দিয়ে কী করবে। মুন্নি বলে, কথা বলবে ওর মা-বাবার সাথে।
মা-বাবার সাথে কথা বলতে আবার ফোন লাগে নাকি। ও তো এমনি-এমনিই প্রত্যেকদিন কথা বলে। আমার মনে হয় ও আসলে আর-কারো সাথে কথা বলতে চায়। ওই আইসক্রিমওয়ালা এখনও মনেহয় ওরে দেখতে আসে। আমি শুনেছি নীচ থেকে শিসও দেয়। মুন্নি অবশ্য প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও এখন শিস শুনে বারান্দায় যায়। কথা বলতে শুনিনি। ও মনে হয় ঐ পোলার সাথে ফোনে কথা বলবে, সরাসরি বলবে না। মুন্নির ভাবচক্কর আমি কিছুই বুঝি না। ঐ পোলার সাথে ভাব নেয়, আবার অন্য পোলাদের সাথে দেখি আগ বাড়ায়ে ফিসফাস করে।
আর কিছু বলে না মা। গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। কিন্তু আমি মার এই রকম চটে যাওয়ার কোন কারণ বুঝতে পারছি না। মা আর খবিশ মিলে যেখানে চারটা ফোন ইউজ করে সেখানে মুন্নি একটা চাইলো তো একেবারে দুনিয়া উল্টে যাওয়ার যোগাড়! কেন মুন্নিকে একটা ফোন কিনে দিলে কী হয়? মাকে আমি বলবো ঠিক করেছি। কিন্তু এখন বলা ঠিক হবে না। পরে সময় করে বলতে হবে। অবশ্য মুন্নির ব্যাপারে ওকালতি না করাই ভাল। কোন কথায় আবার কী বেরিয়ে আসে তার কোন ঠিক আছে নাকি। ইদানিং আবার মুন্নি সর্ম্পকে কিছু বলতে গেলে কেমন যেন লজ্জা-লজ্জা লাগে। সবার এমন হয় কিনা কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু মা আর মুন্নি ছাড়া তো কাউকে চিনিও না যে কথা বলবো। খবিশকে চিনি কিন্তু ওর কাছ থেকে কিছু জানার চাইতে না জানা অনেক ভাল।
চলবে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments