
১৩তম পর্ব:
ইদানীং আমরা বেশ ঘনঘন ডাক্তার মবিন সাহেবের বাসায় যাচ্ছি। মা-ই বেশী উগ্রীব হয়ে থাকে যাওয়ার জন্যে। আমারও ভাল লাগে, কেমন যেন নানীবাড়ি-নানীবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার মতো লাগে। যদিও আমার নানীবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নাই। তবে পত্রিকায় পড়েছি নানা মানুষের নানীবাড়ি সম্পর্কিত নানা অভিজ্ঞতার বর্ণনা। ডাক্তার সাহেবের স্ত্রীকে আমি নানু বলে ডাকলেও উনি খুব একটা পাত্তা দেয় না। মহিলা খুব মুডি, সারাক্ষণ বসে টিভি দেখে আর কাজের লোকদের অর্ডার করে ।
-এই জরিনা চা দে।
-পানি দে।
-ফ্যানের সুইচটা বন্ধ কর।
-জানালাটা খুলে দে।
-টিভির রিমোটটা দে।
-দোকানে যা ফোনের ক্রেডিট নিয়ে আয়।
-পিয়াজ কাট।
-রান্না বসা আমি আসছি।
একটার পর একটা বলতেই থাকে। বলে বটে কিন্তু কখনও উঠে যেতে দেখি না। অবশ্য আমি তো আর সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকি না। আমি যাই মবিন সাহেবের খামারে কাজ করতে। সারাদিনের প্রায় সবটুকু সময় আমি ডাক্তার সাহেবের সাথে কাজ করে কাটায়। উনাকে নানা বললে উনি খুব খুশি হয়। তাই আমিও উনাকে নানা বলেই ডাকি।
প্রথম যেদিন গিয়েছিলাম, মনে পড়ে সেদিন উনি যথারীতি একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা সাধারণ কৃষক, আমাদের দরজা খুলে দিলো। মা সালাম দিলেও উনি উত্তর না দিয়ে একটু মিষ্টি করে হেসে ভেতরে চলে গেলেন। আজ ড্রয়িং রুমে ঢুকেই নানুর সাথে দেখা। মা সালাম দিলেন যথারীতি। উনি শুনলেন কিনা বোঝা গেল না। আমি খুব একটা কথা বলি না। আগে আমার কথা শুনলে সবাই ভ‚ত দেখার মতো করতো। তারপর এখন কথা শোনার জন্যে আগ বাড়িয়ে আসে। কিন্তু এখন আমার কথা বলতে ভাল লাগে না। প্রথম প্রথম আমি কথা কেউ বুঝুক বা না বুঝুক তার তোয়াক্কা করতাম না। অনর্গল বলে যেতাম। এখন ওনাদের ভাষায় কথা বলতে পারি, কিন্তু দেখি সবাই না বুঝেই একবার ‘হ হ’ করে, আর একবার ‘না না’ করে। যখন থেকে বুঝলাম বেশীরভাগ মানুষই কথা বোঝে না তখন থেকে আমার আর কথা বলতে ভালও লাগে না।

মা আবারো নানীকে বললো ¯øামালাইকুম, আন্টি কেমন আছেন? মহিলা মার দিকে ফিরেও তাকালো না। যেমন টিভির দিকে মুখ তেমনিই থাকলো। আমার একটু রাগ ও দুঃখ দুইটাই একসাথে হলো। মনে হলো কষে একটা দমক লাগাতে পারলে ভাল হত। কিন্তু তা কী আর সম্ভব? উনাদের বাসায় বেড়াতে আসি, আসতে যে দিচ্ছে তাতেই খুশি। রাগদুঃখ হজম করার জন্যে সোফার এক কোনায় বসলাম। ডাক্তার সাহেব চলে যাওয়ার পর মা আর আমি টিভির দিকে মুখ করে বসে আছি। কিন্তু আমি টিভি দেখছি না। আমার ধারণা মাও টিভি দেখছে না। দুজনই দেখার ভান করছি। কিছু একটা করা আর কি। আমার মাথায় অবশ্য মবিন সাহেবের এই বেতমিজ বউকে শায়েস্তা করার চিন্তা ঘুরঘুর করছে।
সাধারণত মানুষ আমার সাথে আগবাড়িয়ে কথা বলতে চায়। কেউ কেউ ধরে দেখতে চায় আমি সত্যিকারের মানুষ কিনা। এই অবাক বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকা মহিলাদের মধ্যে মার বান্ধবীর সংখ্যায় বেশী। আমার বয়েস, কথাবলা, দ্রæত বড় হয়ে যাওয়া, আর আমার বুদ্ধি নিয়ে সারাক্ষণ গবেষণা করতে করতে উনাদের নাভিশ্বাস দশা। আর এই মহিলা দেখি বজ্জাতের হাড্ডি, আমার দিকে একবার ফিরেও তাকালো না! বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে টিভি স্ক্রিনের দিকে। মনে হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেকচার শুনছে। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার সাহেব এসে বললো, চলো আমরা বাগানে যায়। তোমাদের দেখাই আমার শাকসবজির বাগান। বাগানের পাশে একটা মুরগীর ঘরও আছে, আছে দুইটা খরগোশ রাখার কেইস। বেশ কয়েকটা খরগোশও আছে। চলো, তোমাদের দেখাই। উনার উচ্ছ¡াস দেখে উনার স্ত্রীর উপরকার সব রাগ নিমিষেই উড়ে গেল। মা আর আমি খুশিতে কলবল করতে করতে উনার পিছু নিলাম।
ওয়াও! উনার বাড়ির পিছনেই স্বর্গের সিড়ি তা কখনও চিন্তাও করিনি। কী সুন্দর সোনালী সকালের সাথে সবজির সজীবতা আর বিন্দু বিন্দু শিশিরের ঝলমল মুহূর্ত আমাদের এক হেচকা টানে সাক্ষাৎ দোজখ থেকে বেহেস্তের অপার শান্তি ও স্বস্থির দুনিয়ার নিয়ে গেল। আমি যেন হয়ে গেলাম সম্পূর্ণ অচেনা এক সবুজ জগতের বাসিন্দা। উনার বাড়ির পেছনে এত বড় ফাঁকা জায়গা! মানুষের বাড়ির পেছনে এত বড় ফাঁকা জায়গা থাকে, থাকতে পারে তা আমি জন্মেও কল্পনা করিনি। রাত না, ঘুম না, স্বপ্ন না, শীতের এক জীবন্ত রোদেলা সকালে অদ্ভূত এক ঘোরের মধ্যে আমি হাঁটছি। আমার বাম পাশে দুই পাতার ছোট্ট ছোট্ট সবুজ চারা; ডান পাশে লাল, সামনে হলুদ; তার সাথে মিশেছে চারা গাছের কোমলতা। এক একটা ভেজিপেড যেন, এক একটা রং আর কোমলতার নকশিকাঁথা। চিকন চিকন আলগুলো মার মাথার সিঁথির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো। আমি আর মা হেঁটে যাচ্ছি সেই সিঁথির মধ্য দিয়ে মহান মানুষ ঈশ্বরের দৌহিত্র ডঃ মবিন চৌধুরীর পেছন পেছন। উনি হাঁটতে হাঁটতে বাগানের শেষ মাথায় গিয়ে থামলেন। শেষ মাথার ডান পাশে মুরগীর খোঁয়াড়। মুরগী আর খরগোশ যেন মালা হাতে দাঁড়িয়েছে লাইন দিয়ে, পিনপতন নিঃশব্দতা, তাদের সবার মুখ ডাক্তার সাহেবের দিকে, চোখ নিষ্পলক, কান খাঁড়া। ওরা সবাই যেন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায় রত। মবিন সাহেব দাঁড়ালেন বিশেষ ভঙ্গিতে; একবার বাঁদিক, একবার ডানদিক দেখে নিয়ে বললেন অতি সাধারণ একটা কথা। কীরে তোদের খবর কী? মুরগীগুলো নেতার এই অসাধারণ বক্তৃতা শুনে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করলো বেহেস্তের সবুজ মাঠ। তাতে যোগ দিলো খরগোশগুলো মৌন সমর্থন জানিয়ে। আমরা দুজন মনুষ্যকূলে জন্ম নেয়া বিশেষ প্রাণীদ্বয় বাকরুদ্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করছি নেতৃত্বের মহিমা আর গৌরবের অপার রোশনায়। অথচ এই একই ব্যক্তি এই দেশের অনেক মানুষের সাথে, অনেক দলের সাথে যুক্ত হতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছে। কারো সাথেই উনার চিন্তাভাবনা মেলে নাই। কেউ উনাকে বোঝেনি বা উনি মানুষকে বোঝেননি, যতটা বোঝেন গাছপালা আর পশুপাখিকে। মুরগীদের শ্লোগান শেষ হওযার পর উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, কি রে, ডিমডুম কিছু দিবি? তাতে মুরগীগুলো নীরব। কিছু বলে না। একজন মুরগী শুধু কককক করে ওঠে। ডাক্তার সাহেব মুচকি হাসলেন। কী বুঝলেন আল্লা মালুম! উনি নিশ্চয় উনার আওলাদের কথা বোঝে।
-জানো মা, তুমি বললে বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা। তবে তাও বলি, মুরগীগুলো কিন্তু কথা বোঝে। অনেককিছু শিখতেও পারে যদি তুমি ওদের মত করে শেখাতে পারো। আমি জানতাম না ব্যাপারটা। একদিন ডিসকভারী চ্যানেলে দেখলাম, একলোক মোরগ-মুরগীদের নানারকম ট্রেনিং দিচ্ছে। এবং মুরগীগুলোও তা শিখে নিচ্ছে চটজলদি। আমার কাছে ব্যাপারটা প্রথম দিকে একটু অবিশ্বাস্য মনে হলেও পরে মনে হয়েছে হতে পারে, প্রাণতো; জন্মমৃত্যু যেহেতু আছে, নিজের বাড়ি এবং মালিক যেতেতু চেনে, তার মানে বুদ্ধি আছে; সে হয়তো তার মত করে বোঝে। যা আবার আমরা বুঝি না। কিন্তু তাই বলে অবুঝতো নই। আবার শেখালে শেখে, কথা বললে বোঝে। আমরা হয়তো ওদের মত করে বলতে পারি না। বলতে পারলে নিশ্চয় মানুষের মতই কথা বলা যেত। ভাষা না জানলে তো মুরগীর সাথে কথা বলা আর মানুষের সাথে কথা বলা একই। শোনো, একটা মজার কাহিনী বলি, আমি গেছিলাম চায়না। বেশ রিমোর্ট একটা অঞ্চলে। অঞ্চলটার নাম হেবাই, ছোট্ট একটা জেলা শহর, বেইজিং এর কাছাকাছি। আমি তো চায়নিজ জানি না। ওরাও ইংরেজী জানে না। একটা লোক একটা অক্ষরও ইংরেজী বলতে বা বুঝতে পারেনা। আমিও একটা অক্ষরও চায়নিজ বলতে পারি না। এখন বোঝো অবস্থা। কোন কথা বলার কোন যো নাই। কী যে অবস্থা! কেউ কোনদিন এই অবস্থার মধ্যে না পড়লে বোঝা সম্ভব না কমিউনিকেশন কত ইম্পোর্টেন্ট। এক গ্লাস পানিও চেয়ে খাওয়ার উপায় নাই। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে বোঝাতে হয় আমি কী চাই। খাবারদাবার বসে অর্ডার দেওয়ার উপায় নাই। উঠে গিয়ে দেখিয়ে আসতাম কী চাই। এই অভিজ্ঞতার পর মনে হলো পশুপাখি বেশী বুঝতে সক্ষম মানুষের তুলনায় উইদাউট ল্যাঙ্গুয়েজ। শোনো, তোমাদের তো তাড়া নাই?
মা বলে, জ্বী না চাচা, আমাদের কোন তাড়া নাই।
-গুড। তাহলে তোমরা আজ সারাদিন থাকো। সন্ধ্যায় চা-নাস্তা করে বাসায় যাবে। ঠিক আছে?
মা মৌন সম্মতি জানায়। আমি তো আগেই রাজি।
-আর একটা কথা, এখন থেকে প্রত্যেক শুক্রবার ছেলে নিয়ে চলে আসো। আমি আমার মত করে ওর সাথে সময় কাটাতে চাই। তাতে ওর লাভ হলে হতেও পারে, নাও পারে। আমি তোমাকে কোন গ্যারান্টি দিতে পারছি না। তবে অর্গানিক উপায়ে চেষ্টা করা। আমি কোন ওষুধপথ্য দিচ্ছি না। শুধু ওর সাথে সময় কাটাবো, এই যা। বাগানে কাজ করবে, মুরগীদের সাথে খেলবে, খরগোশকে খাবার দেবে। তাতে ওর সময়টা ভাল যাবে। তাতে ওর মানসিক গড়নে কোন প্রভাব পড়তেও পারে। আর মানসিক গড়ন বদলালে শারীরিক গড়নও বদলাতে পারে।
মা শুনে সাথে সাথে রাজি।
উনার প্রস্তাবটা শুনে আমিও খুব খুশি হলাম। এত বেশী খুশি হলাম যে নিজেরই লজ্জা লাগছে। লজ্জায় আমার মাথা নীচু হতেছে তো হতেই আছে। আমি কোনরকমে জোর করে নীচু মাথাটা সামলে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। যাই হোক মোটোমুটি ঠিক হয়ে গেল যে আমরা এখন থেকে প্রত্যেক শুক্রবার উনার বাসায় চলে আসবো, আর সারাদিন থাকবো। আমি কাজ করবো বাগানে, আর মা আন্টির সাথে গল্প করবে। আমার সময় ভাল যাবে আমি জানি। কিন্তু মার অবস্থা হবে খুবই শোচনীয়। আন্টির সাথে আর যা-ই হোক গল্প জমবে না। তবে আমার খুবই খুশি খুশি লাগছে। জন্মের পর এতটা খুশি কখনই হয়নি মাতাল অবস্থায় না থাকলে। মাতাল কথাটা মনে হতেই মদের কথা মনে হলো। সেই কখন এক পেগ মেরেছি। তারপর আর খবর নাই। মাও তো কিছু বলছে না। ডাক্তার না বলেছে নিয়ম করে খেতে! তা না হলে তো কাজ করবে না। মাকে বলবো নাকি? কিন্তু ডাক্তার সাহেবের সামনে কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছি। যদিও উনি জানেন যে আমি অসুস্থ। আর আমার এই ড্রিংক অনেকটা মেডিসিনের মত। ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা না। ডাক্তার বললে তো বিষও মেডিসিন হয়ে যায়। কাজেই উনার সামনে তো লজ্জা পাওয়ার কোন কারণ নাই। তাও পাচ্ছি। লজ্জার চাইতেও বড় কথা এখন তো আর এসব বলা যাবে না। কারণ এখন আমরা কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
উনি বললেন, আচ্ছা বাবু শোনো। তোমার নাম কী বাবুই?
মা বলে, আঙ্কেল, আসলে ওর কোন নাম রাখা হয়নি। প্রথম থেকে বাবু বলতে বলতে এখন বাবুই হয়ে গেছে।
-ও তাহলে তো ওর একটা নাম দিতে হয়। কী বলো?
-জ্বী আঙ্কেল। আপনি ওর একটা নাম দিয়ে দেন।
উনি আমতা আমতা করে বলেন। আমি তো এইসব ব্যাপারে একেবারেই আনাড়ি। তোমার চাচীকে বলো একটা নাম দিয়ে দিতে। ও আবার সাহিত্যরসিক। এসব ভাল পারে।
আমি মনে মনে বলি, তাহলেই হয়েছে। নাম আমার না হলেও চলবে। যে গুমড়োমুখো চাচী আমার, নামও নিশ্চয় দেবে একখান পোতানো গুমোট গন্ধযুক্ত! কী দরকার! যা আছে তাতে তো দিব্যি চলে যাচ্ছে। মার এই আদিখ্যেতা দেখানোতে এখন তো মনে হচ্ছে নামের প্যাঁচে আটকা পড়বো। নামজনিত এই দুশ্চিন্তা মাথা থেকে যেতে-না-যেতেই উনি ঘোষণা দিলেন, মা, তুমি যাও। তোমার চাচীর সাথে গল্প করো। আমি আর বাবু কাজ করবো খামারে।
আমি কাজ করবো! কী কাজ করবো? কী ভাবে করবো? এসব ভাবতে গিয়ে নামজনিত দুশ্চিন্তা কখন উধাও হয়েছে টের পাইনি। খুশি মনে উনার সাথে কাজে লেগে পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। উনি প্রথমেই কিছু দুই পাতাওলা চারা হাতে নিয়ে শুরু করলেন।
-এই যে দেখছো চারাগুলো, এগুলো ফুলকপির চারা। দুই সপ্তাহ বয়স। এখন অবশ্য নার্সারীতে তাড়াতাড়ি চারা বড় করার নানারকম সার ও টনিক ব্যবহার করা হয়। যা গাছের দ্রæতবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কিন্তু আমি চারা কিনি আমার বন্ধু বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, কবি, সমাজকর্মী ফরহাদের নার্সারী থেকে। ও বাংলাদেশে হাইব্রিড বিরোধী প্রচার প্রপাগাণ্ডা চালাচ্ছে ফ্রম দা ভেরি বিগেনিং। ও শুধু অরগানিক উপায়ে ভাল ফলন পাওয়া সম্ভব এটা প্রমাণ করার জন্যে একটা নার্সারী ও একটা এগ্রিফার্ম করেছে। এবং জানো এখন ওর এই ফার্মে যাওয়ার জন্যে ঢাকার এলিট শ্রেণী লাইন দেয়। আমাদের দেশের মানুষের কৌত‚হল শুধু দেখার। অন্যেরটা দেখে ওরা খুব মজা পায়। সব কিছুতেই অন্যের উপর নির্ভরশীল। সবকিছুই অন্যেরটা ভাল। নিজে কিছুই ভাল করবে না, বা করার চেষ্টা করবে না। শুধু অবাক কৌত‚হল নিয়ে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমেরিকা-ইউরোপ বলেছে যে হাইব্রিড ভাল, ভাল ফলন দেয় Ñ অমনি সারা দেশের সার-বীজ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে দেশের সরকারও হাইব্রিডের গুণগানে নেমে পড়েছে নেংটি পরে। আরে বাবা, আগে তো দেখবি তার ভালমন্দ কী হয়, কতদূর হয়? না, তা না, দাদা বলছে ভাল, তো সব ঝাঁপিয়ে পড়ে মরো! আর দেশের হাজার বছরের কৃষিব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে দাও। যাইহোক মানুষের উপর বক্তৃতা না দিয়ে বরং নিজে করে দেখাই, কী বলো? কাজেই দ্রæত বড় হওয়া চারা আমরা লাগাবো না। আমাদের চারা হবে অর্গানিক, আর তা একটু কমই বড় হয়। আমি চাই যার যে-বয়সে যেমন থাকার কথা সে যেন সেইরকম থাকে। কপি শীতের ফসল। আমরা এটা লাগাচ্ছি এখন আশ্বিনের মাঝামাঝি। ফসল তুলবো মাঘের মাঝামাঝি। তিন থেকে সাড়ে তিন মাস সময় দেবো বড় হওয়ার জন্যে। এই চারাগুলো লাগাতে হয় এক থেকে দেড় ফুট জায়গা দিয়ে। অর্থাৎ একটা চারার চারদিকে এক থেকে দেড় ফুট জায়গা রেখে লাগাতে হবে। এই যে দেখছো এক-একটা লাইন। এক লাইন থেকে আর-এক লাইনের দূরত্ব দেড় ফুট। তুমি একটা করে চারা নেবে আর আমি যে গর্তগুলো করছি তার মধ্যে দেবে। তারপর গর্তগুলো মাটি দিয়ে ভরাট করে দেবে। পারবে? আমি একটা দেখিয়ে দিচ্ছি। তারপর একটু পানি ছিটিয়ে দিয়ে আজকের মত কাজ শেষ করবো। ঠিক আছে?
উনি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই কাজে লেগে গেল। উনার অনেক কথাই নতুন, আগে কখনও শুনেছি বলে মনে করতে পারছি না। আবার কথাগুলোও বেশী সোজাসাপটা না, কেমন যেন ঘোরানো-প্যাঁচানো। এখন যদি প্রশ্ন করি তো অনেক প্রশ্ন করতে হয়। আর যদি বুঝলাম কি বুঝলাম না চিন্তা না করে কাজে লেগে পড়ি তো সবই ঠিক। আমার মনে হয় এত জ্ঞানগর্ভ কথা বোঝার এখন আমার দরকার নাই। এখন দরকার কাজ করা। আমি কয়েকটা চারা হতে নিলাম। ওদের যে মরমর অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে না উঠে দাঁড়াবে। যা-ই হোক, আমার কাজ আমি করে যাই, দাঁড়ালো কি না-দাঁড়ালো তা পরে চিন্তা করা যাবে। উনি মাটি খুড়ে গর্ত করা শুরু করলে আমিও একটা একটা করে চারা উনার পেছন পেছন গর্তের মধ্যে দিয়ে মাটি দিয়ে ভরাট করে যেতে থাকলাম যেমন উনি দেখিয়েছেন। দুই-তিনটা করার পর উনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে একটু হাসলেন। উনি একটা গর্ত করতে বেশ সময় নিচ্ছেন। গর্তের মত একটা সহজ কাজ করতে কেন এত সময় নিচ্ছে তা বোঝা বেশ মুশকিল। যদিও আমি কোনদিন কাজটা করিনি, তবে দেখে কিন্তু খুব একটা কঠিন কিছু মনে হচ্ছে না। তবে চারা লাগানো এবং মাটি দিয়ে ভরাট করা কিন্তু বেশ কঠিন। যা-ই হোক, আজ আমার কাজের প্রথম দিন। সবই যদি আজ শিখে ফেলি তো পরের শুক্রবার কোন কাজই থাকবে না। পরে না হয় একদিন গর্ত করে দেখবো কেমন লাগে।
অনেকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছি। আমি তো বরাবরই চুপচাপ। কথা বলা যেন আমার কাজ না, শোনা-ই কাজ। ছোট বাচ্চারা অনেক কথা বলে। কিন্তু আমি তো আর ছোট বাচ্চা না। দেখতে ছোট হলেও বড় তো হয়ে গেছি। তাই কথা বলাও কমে গেছে। তিনি আবার শুরু করেন। শোনো মরমর চারা দেখে মনে করো না, ওরা মরে যাবে। আগামী সপ্তায় এসে দেখবে কী সুন্দর লকলক করছে। বাতাসে হেলেদুলে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে। আমার খুব অবাক লাগে জানো! এই মরমর চারা গাছগুলো থেকে একদিন একটা ছোট্ট হলুদ ফুল বাইর হবে। তারপর তা আস্তে আস্তে বড় হবে। আমাদের পুষ্টির যোগান দেবে। বেঁচে থাকবে আমাদের শরীরের অংশ হিসাবে যতদিন আমরা বেঁচে থাকবো।
তাই নাকি? বুড়া বলে কী! ফুলকপি বেঁচে থাকবে আমাদের শরীরে! তাহলে মা আমাকে বাঁচিয়ে রাখার এতো চেষ্টা-তদবির না করে কতগুলো ছেলেপেলেকে খাইয়ে দিলেই পারে? আমি ওদের শরীরে বেঁচে থাকবো!
মাথায় আসলো এবং চট করে মুখ ফুটে ডাক্তার সাহেবকে কথাটা বলে ফেললাম। উনি দেখি একদম থ মেরে কী যেন চিন্তা করতে লাগলেন। আমি কথাটা বলে মনে হলো বেশ বোকামি করে ফেলেছি। উনি কি আমার কথায় রাগ করলেন? বেশ কিছুক্ষণ পর আস্তে করে উনি আবার মুখ খুললেন। বাবু, যে কথাটা তুমি বললে তা সত্যিই আমাকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। আসলে আমরা মানুষ নিজের দরকারে নানা যুক্তি আর থিউরি আবিষ্কার করে নিজেকে সান্ত্বনা দেই, নানাভাবে অন্যকে চুষে খাওয়ার জন্যে। এই ফুলকপি আমি খাব। তার একটা অজুহাত তো আমার দরকার। বুঝলে? মানুষ প্রাণী হিসাবে আমার এতকিছু চিন্তা করার কথা না, কিন্তু সমস্যা হলো আমি মানুষে রূপান্তরিত হয়েছি এবং এখন আমার মানবিক মূল্যবোধকে সেটিসফাই করার জন্যে দরকার নানা উছিলা। এটা শুধু সবজি খাওয়ার জন্যে না। জীবনের প্রত্যেকটা পরতে-পরতে আমরা আমাদের সুবিধামতো অজুহাত খাড়া করি। যা আমাকে মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে রক্ষা করবে বলে মনে করি। কিন্তু সহজ সত্য হলো যে ফুলকপি আমি খেয়ে ফেলছি। আমাকে দানবে খেয়ে ফেলা আর আমি দানবের মত ফুলকপি খেয়ে ফেলার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই।
উনি যখন কথা বলে এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বলে, তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। মনেহয় কী বললো তা হিসাবনিকেশ করে দেখে। তারপর আবার বলে। এই করে করে আমরা আমাদের চারা-লাগানো বেশ এগিয়েছি। ট্রেতে আর বেশী চারা নাই।
কিছুক্ষণের মধ্যে মা আসলো। মাকে দেখে আমার মন খুশিতে চনমন করে উঠলো। নিশ্চয় আমার ডোজ নেয়ার সময় হয়েছে? কিন্তু কিসের কি, মা এসেছে আমাদের ডাকতে নাস্তা খাওয়ার জন্যে। এখন এই মুরব্বির সামনে কেমনে বলি যে মা, নাস্তা দেওয়ার আগে আমাকে এক পেগ দাও, না হলে তো নেশা বলে আর কিছু থাকছে না। আর নেশার ঘোর ছাড়া কি আমি বাঁচি? তুমিই বলো? আমি কিছু বলার আগেই ডাক্তার সাহেব মাথা তুলে মার দিকে না তাকিয়েই বলে নাস্তা এখানে নিয়ে আসো।
বলে কী! লোকটা দেখি সাত্যিকারের চাষা! ও কি আমাকেও চাষাভুষা বানাবে নাকি? হায় হায়, শেষ পর্যন্ত খবিশের দেওয়া ডেফিনেশন অনুযায়ী চাষাভুষা হয়ে যাবো! খবিশতো কথায় কথায় মুন্নিকে বলতো চাষাভুষার মতো ব্যবহার করবি না। মুন্নি একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, চাষাভুষা মানে কী?
খবিশ বলে চাষাভুষা হলো ছোটলোক, যারা যেখানে খুশি খায়, যেখানে খুশি হাগে। এখন আমিও বাইরে বসে খাব। তারপর নিশ্চয় হাগতে বসবো!
কিছুক্ষণের মধ্যে মা আর ডাক্তার সাহেবের বাসার কাজের মেয়েটা মিলে নাস্তা নিয়ে আসলো। আমরা মাদুর পেতে নাস্তা খেতে বসলাম। খেতে বসে কিন্তু বেশ মজা পাচ্ছি। আমি টিভি নাটকে দেখেছি লোকজন বনবাদাড়ে গিয়ে এরকম কাপড় বিছিয়ে খেতে বসে। এটাকে বলে পিকনিক। আমার এখন মনে হচ্ছে আমরাও পিকনিক করছি। আমি খামোখাই খবিশের খিস্তিখেউড় মনে করে মন খারাপ করছিলাম। আসলে খবিশ তো খবিশ! ও কী বুঝবে চাষাবাদের মর্ম! ও তো মানুষ ঠকিয়ে খেতে পছন্দ করে। ঠকবাজের ভড়ং-ই সাঁই। ডাক্তার সাহেব বলেছেন, দেখবে যারা অসৎ, পরজীবি, অন্যকে ঠকিয়ে খেতে পছন্দ করে সমাজে ওদের দাপটে টেকা দায়। ওরা সবকিছুতেই হামবড়েঙ্গা ভাব করে নিজের সমস্ত অপকর্মকে ঢেকে রাখার চেষ্টায় সদা তৎপর। ওদের হাত থেকে দুনিয়াকে মুক্ত করতে না পারলে সত্যিকারের উন্নয়ন কখনও হবে না।
কিন্তু কিভাবে ওদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে তা জিজ্ঞেস করা হয়নি। কথাটা মনে করে উনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। উনি যখন কথা বলেন তখন অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। কিন্তু কথার মধ্যে উনি নিঃশ্বাস নেওয়ারও সুযোগ দেন না। আর কথা শেষ হয়ে গেলে আমি পড়ে যাই মহাধন্দে! কোনটা যে জিজ্ঞেস করবো তা-ই খুঁজে পাই না।
চলবে।