আতিকুর রহমান শুভ: সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ১৮১ দিন ধরে প্রথম দফায় গুম তারপর কারাগারে বন্দী রয়েছেন। ডিজিটাল আইনে প্রভাবশালীদের মামলার সূত্রে দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর এই কারাবাস।
৫২ দিন গুম থাকার পরে যেদিন বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে তাঁকে উদ্ধার করা হলো, সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন এই ভেবে যে, তাঁকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব মামলা ছিলো, সেগুলো চললেও জামিনে মুক্ত হয়ে তাকে নির্দোষ প্রমানের সুযোগ দেয়া হবে। সেই আশা করতে করতে কাজলের পরিবারের আরও ১৩০ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। একদিকে করোনা অতিমারির সাথে যুদ্ধ অন্যদিকে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির মুক্তির আশায় দিনাতিপাত চলছে তাদের। সংশ্লিষ্ট সকল জায়গায় ধর্না দিয়েও তাঁর পরিবার জানেনা- আদৌ মুক্তি পাবে কিনা কাজল। সারা দেশের সাধারণ মানুষ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা কাজলের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হলেও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই নীতি নির্ধারকদের। দেশ ও বিদেশের নামকরা (দ্য গার্ডিয়ানসহ) পত্রিকায় কাজলের নি:শর্ত মুক্তি নিয়ে লেখালেখি ও নিবন্ধ প্রকাশও যেনো কাজে আসছেনা। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নরত কাজলের ছেলে মনোরম পলক তাই দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন তার বাবার মুক্তির প্লাকার্ড হাতে যত্রতত্র। অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত বাংলা কাগজ প্রশান্তিকার পক্ষ থেকে পলকের সাথে কথা বলে জানা গেলো বেদনার আরও সব কথকতা।

প্রশান্তিকা: সাংবাদিক কাজলের বিরুদ্ধে মামলার বর্তমান অবস্থা কি?
পলক: বাবার একটি মামলার জামিনের শুনানী ছিলো দুই সপ্তাহ আগে। আদালত তাতে জামিন দেননি। আরও দুটি মামলার জামিন শুনানীর তারিখ এখনও পাওয়া যায়নি। মামলাটি কবে হাইকোর্টে উঠবে- তাও জানিনা আমরা।
প্রশান্তিকা: কতদিন হলো উনি কারাগারে রয়েছেন?
পলক: বাবা নিখোঁজ হন এ বছরের ১০ মার্চে। এরপর ৫২ দিন গুম থাকার পরে ৩মে পুলিশ তাঁকে ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে নিয়ে রেখেছে। অদ্যবধি তিনি কারাগারেই রয়েছেন। অথচ আমাদের করা গুম হওয়ার মামলাটি এখনও নিষ্ক্রিয় রয়েছে।
প্রশান্তিকা: কাজলের বিরুদ্ধে অভিযোগ কি?
পলক: সরকার দলীয় একজন সাংসদ মামলা করেছেন বাবাসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে। বাবা সেখানে ৩ নম্বর আসামী। বাবা ছাড়া আর কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। মামলার প্রধান আসামী মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক। তিনি আগাম জামিন নিয়েছেন বলে শুনেছি।
বাবার বিরুদ্ধে ৫ টা মামলা করা হয়েছিলো। তারমধ্যে একটিতে জামিন হয়েছে। অন্য একটি ৫৪ ধারার ছিলো, সেটা নিষ্পত্তি হয়েছে। প্রধান যে মামলাটি বাবার বিরুদ্ধে- সেটা মানবজমিন পত্রিকার একটি রিপোর্ট বাবা শেয়ার করেছিলেন ফেসবুকে। রিপোর্টটি বাবার নয়, তিনি শুধু শেয়ার দিয়েছিলেন, এটাই ছিলো অপরাধ।

প্রশান্তিকা: ঘটনার পরিক্রমায় বুঝা যাচ্ছে কোন এক ব্যক্তি বা মহল কাজলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ পোষণ করছেন, কেন?
পলক: তা তো বলতে পারব না, কেন এতো ক্ষোভ। শুধু বলতে পারি আমার বাবা ১৮১ দিন ধরে প্রথমে গুম তারপর বন্দী অবস্থায় রয়েছে।
প্রশান্তিকা: শুনলাম, উনি চোখে তেমন দেখছেন না, হাতও একটা অবশ?
পলক: জি একদম দেখছেন না, তা নয়। একটি চোখে খুব কম দেখছেন। দীর্ঘদিন বাবার চোঁখ বেঁধে রেখেছে- সেই কারণে তাঁর এই অবস্থা। আর হাতও বাঁধা ছিলো। বাবা বাম হাতে কোন অনুভূতি পাচ্ছেন না।
প্রশান্তিকা: কাজলকে মুক্ত করতে ক্ষমতাধর কেউ কি পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন?
পলক: না। তবে সাংস্কৃতিক কিছু মানুষ, কয়েকটি মঞ্চ নাটকের দল ও সংগঠন প্রতিবাদ করছেন। কোথাও কোন র্যালি বা প্রতিবাদ সমাবেশ হলে আমিই প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে যাই। কারণ যদি ক্ষমতাধর কারও চোখে পড়ে এবং আমাদের এই কষ্টের কথা জানতে পেরে আমার নির্দোষ বাবাকে ছাড়তে এগিয়ে আসেন। আমরা জানিনা, বাবাকে মুক্ত করতে কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো? সেই কারণে যেখানেই সুযোগ পাই ব্যানার হাতে বাবার মুক্তির জন্য দাঁড়াই।

প্রশান্তিকা: আপনার পরিবারে উপার্জনক্ষম আর কে আছেন? সংসার চলছে কি করে?
পলক: আমার মা চাকুরি করতো। করোনার কারণে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ। এখন আবার কাজ শুরু করেছেন প্রায় এক সপ্তাহ হলো। আমাদের সংসার চলছে না। আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ি। জানিনা কবে আবার পড়াশুনায় ফিরতে পারবো। হয়তো পারবই না আর। বাসায় মা কান্না করেন, ছোট বোন সবসময় বাবার জন্য কাঁদে। আমি কাঁদতে পারিনা। কান্না লুকিয়ে ওদের সাহসের কারণ হই।
মা যখন কান্না করেন, ছোট একটা বারান্দায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকে, বোন যখন অস্থির হয়ে এঘর থেকে ওঘর করেন তখন আমার কিছু করার থাকেনা। আমাদের বাসাটা এতো ছোট যে কোথাও লুকানো যায়না। আমরা সারাদিন একজন আরেকজন থেকে লুকিয়ে থাকি। কে কাকে জিজ্ঞেস করে বসে, বাবা কখন ফিরবে, সেই প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা কেউই হতে চাইনা। কিন্তু প্রশ্ন আছে। প্রশ্নটা আপনাদের করতে চাই: বাবা কখন ফিরবে ? সুস্থ ভাবে ফিরবে তো।
প্রশান্তিকা: কাজল কোথায় কাজ করতেন?
পলক: বাবা মূলত ফটো সাংবাদিক। নিজে দৈনিক পক্ষকাল নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এর আগে নিউ এজ এবং সমকাল পত্রিকাতেও কাজ করেছেন।

প্রশান্তিকা: আপনার সাথে বাবার ক’বার দেখা হয়েছে?
পলক: দুইবার। একবার যশোরে। আরেকবার ২৩ আগস্টে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (পিজি) দূর থেকে দেখেছি। কাছে যেতে পারিনি, পুলিশ কথাও বলতে দেয়নি। সেখানে বাবাকে মাত্র এক ঘন্টার জন্য চেক আপ করতে এনেছিলো। অথচ আমরা শুনেছি তাঁর শারিরীক অবস্থার অবনতি হয়েছে। তিনি ঘন ঘন বমি করছেন। করোনার অযুহাতে তাকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসাও দেয়া হচ্ছে না।
প্রশান্তিকা: বাবাকে পাওয়ার জন্য আপনার শেষ কথা কি?
পলক: আমাদের শেষ আশ্রয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমরা বাবার জন্য প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমার বাবাকে প্রাণে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন প্লিজ। বাবাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিন।