১৯১৭ সালের ৮ মার্চ, সোভিয়েত নারীরা ভোটাধিকার অর্জন করলেন। এ ঘটনাকে স্মরণ করে সোভিয়েত সরকার দিনটিকে জাতীয় ছুটি ঘোষণা করে। তারও ৫৮ বছর পর, ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ এই দিনটিকে বিশ্ব নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তাই মার্চ মাস নারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস।
কিন্তু আমরা কি জানি, ইতিহাসের একটি নৃশংস ও ন্যাক্কাড়জনক হত্যাকান্ড ঘটেছিল এই মার্চ মাসেই। ৪১৫ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে একজন নারীকে হত্যা করার মাধ্যমে পৃথিবীকে বহু বছর পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর সেই নারী হলেন ‘হাইপেশিয়া’। কে এই হাইপেশিয়া কেন আর কিভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল, তা সপারই জানা উচিত। কারণ হাইপেশিয়া হলো সাহসিকতার প্রতীক। তিনি নারীদের জন্য এমন একটি উদাহরণ, যা হাজার বছর পূর্বে জানিয়ে গেছেন, একজন নারী একজন পরিপূর্ণ মানুষ। যার নিজস্ব একটা সত্তা আছে, আছে চিন্তা করার ও মতামত দেবার অধিকার।
হাইপেশিয়া ৩৬০ খ্রিস্টাব্দে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ এবং দার্শনিক। হাইপেশিয়ার বাবা থিওন, তিনি নিজেও ছিলেন একজন গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং আলেকজান্দ্রিয়া জাদুঘরের পরিচালক। বাবার হাত ধরে হাইপেশিয়ার শিক্ষাগ্রহণ। বাবার অনুপ্রেরণাই হাইপেশিয়াকে জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করেছিল। যে সময়টাতে সমাজ নারীদেরকে ঘরের আসবাবপত্র হিসেবে গণ্য করত, তখন হাইপেশিয়ার বাবা তাঁকে শিক্ষাদীক্ষায় একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। হাইপেশিয়া হয়ে উঠেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার প্রধান গণিতবিদ তথা পৃথিবীর প্রথম নারী গনিতজ্ঞ। হাইপেশিয়া শুধু বুদ্ধিমত্তায় চৌকশ ছিলেন তা নয়, রূপেও ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। তাঁর সমাজের অনেকেই তাঁকে বিয়ে করার জন্য আগ্রহী থাকলেও, স্বাধীনচেতা হাইপেশিয়া তাতে ভ্রক্ষেপ করেননি। বরং তিনি বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণায় ছিলেন মগ্ন।
তিনি একজন প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা সেই সময়ের অনেক পুরুষ শিক্ষকদের জন্যও ঈর্ষণীয়ছিল। আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারে প্রতিদিন তিনি দর্শন ও দার্শনিক গবেষণা নিয়ে বক্তৃতা দিতেন। তিনি বক্তা হিসেবে এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, দূর দুরান্ত থেকে ছাত্ররা তাঁর কথা শুনতে চলে আসত। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার দর্শন বিষয়ক প্রধান প্রতিষ্ঠানে স্কুল অফ ফিলসফিতে একমাত্র নারী সদস্য ছিলেন। তিনি বরাবরই নিজেকে একজন নারী নয় বরং একজন মানুষ হিসেবে পরিচিতি করতেই সচেষ্ট ছিলেন। তাই তিনি পুরুষ সদস্যদের পাশাপাশি কাউকে তোয়াক্কা না করে, একই রকম ইউনিফর্ম পড়ে সেখানে উপস্থিত হতেন, যা শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য নির্ধারিত ছিল। তিনি তাঁর বিচক্ষনতা ও জ্ঞানের কারণে একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে শহরের অন্যান্য পণ্ডিত ব্যক্তিদের কাছে সম্মানিত ছিলেন।
হাইপেশিয়া জন্মগতভাবে প্যাগান (পৌত্তলিক ধর্ম) ধর্মালম্বী, তিনি ছিলেন মুক্তচিন্তার মানুষ। আলেকজান্দ্রিয়ায় তখন প্যাগান ধর্মের দৌরাত্মের পাশাপাশি খৃষ্ট ধর্মের উথ্থান ঘটছিল। এবং ধর্মীয় রেষারেষি বৃদ্ধি পাচ্ছিল । কিন্তু হাইপেশিয়া সকল ধর্মের মানুষদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান বা নিম্নবর্নের মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করতেন না। এমনকি দাসরাও তাঁর কাছ থেকে জ্ঞানঅর্জনে বঞ্চিত হতেন না।
শিক্ষকতার পাশাপাশি হাইপেশিয়া দর্শন, নক্ষত্র মণ্ডলী ও জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে গবেষণা করতেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে অন্যতম হলো দায়োফ্যান্তাস রচিত ‘Arithmetica’ বইয়ের উপর আলোচনা। এছাড়া তিনি ‘Apolonias’এর কৌনিক ছেদ বইয়ের উপর আলোচনা লিখেন, টলেমীর কাজের উপর আলোচনা করেন ‘Astronomical Canon’ শিরোনামে। হাইপেশিয়া তাঁর বাবার সাথেও যৌথভাবে বেশ কিছু গবেষণার কাজ করেন। আবিস্কারের দু’টির জন্য হাইপেশিয়া ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন তার একটি হলো ‘Astrolabe’ – যেটি গ্রহ-নক্ষত্ররাজির দৈনন্দিন ঘূর্ণন গণনা আর মহাজাগতিক নানা সমস্যা সমাধানে ব্যবহৃত হয়। আরেকটি হলো– ‘Hydroscope’এর আবিস্কার, যা দিয়ে তরল পদার্থের আপেক্ষিক গুরুত্ব মাপা যায়।
দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তাঁর অধিকাংশ কাজই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কারণ, হাইপেশিয়া এমন এক সময়ে বাস করেছিলেন যখন দর্শন এবং ধর্ম সমন্ধে দ্রুত ধারনার পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল। উগ্র খৃষ্ঠান ধর্মালম্বীরা রাজ্য ও ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। যার ফলশ্রুতিতে আলেকজান্দ্রিয়া চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উগ্র খৃষ্টান ও প্যাগান ধর্মালম্বীদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়। প্যাগানদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো একে একে গীর্জায় পরিণত হতে থাকে। সেই সময় হাইপেশিয়া দাঁড়িয়েছিলেন এই প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তিগুলোর মধ্যখানে। প্যাগান শাসকশ্রেণি হাইপেশিয়ারমতামত ছাড়া কোন পদক্ষেপ নিতেন না। মৌলবাদীদের কাছে হাইপেশিয়া এই মেধা, জ্ঞান, স্বাধীনচেতা মনোভাব অসহনীয় হয়ে উঠল। তারা হাইপেশিয়াকে তাঁর সকল কাজকর্ম ও গবেষণা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়।
কিন্তু হাইপেশিয়া তো হেরে যাবার জন্য জন্মগ্রহণ করেননি। সে তাদের সকল নির্দেশ অমান্য করে তাঁর শিক্ষা ও গবেষণা চালিয়ে যান। আর এটাই হাইপেশিয়ার জন্য কাল হয়। মৌলবাদীরা আলেকজান্দ্রিয়া দখলের সাথে সাথে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারটি পুড়িয়ে দেয়। যেখানে বহু মূল্যবান বই ও বহু গবেষণার নথিপত্র চিরকালের মত হারিয়ে যায়। তাতেও তাদের রোষ কমে না। তারা হাইপেশিয়াকে চার্চে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথমে নগ্ন করে চামড়া চিরে ফেলে। এখানেই শেষ নয়। তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত হলে, তাঁর মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়। ইতিহাসের অন্যতম বীভৎস ও নিন্দনীয় হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয় ৪১৫ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসে। হাইপেশিয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আলেকজান্দ্রিয়াতে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে বহু বছরের জন্য।
হাইপেশিয়াকে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু তাঁর কাজ, তাঁর দর্শনকে মুছে ফেলতে পারেনি। তাঁর জীবন দর্শন নারীদেরকে সাহসী হয়ে গড়ে উঠতে অনুপ্রেরণা জোগাবে, আজীবন। তাঁর মতো বিদুষী ও দৃঢ়চেতা নারীর জন্ম হোক প্রতিটি দেশে, প্রতিটি ঘরে, আনাচে-কানাচে। হাইপেশিয়ার প্রতি নিরন্তর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।
অনীলা পারভীন : সরকারি কর্মকর্তা, অস্ট্রেলিয়া।