মাসিমার চোখের জল ভাসালো বিষাদে! । প্রতীক ইজাজ

  
    

বাড়ির পাশে শ্মশানে গিয়েছিলাম সেদিন। কলেবরে অনেক বড় হয়েছে। মা কালির মুখচ্ছবিতে আঁকা হয়েছে প্রবেশদ্বার। ভেতরে কালিমন্দির, পূজোর ঘর, শবদেহ পোড়ার ইলেকট্রিক চুল্লি। বহুবছরের পুরনো সিঁড়ি, সেই আগের মতোই নেমে আছে করতোয়ায়।

শৈশব কৈশোরে এই শ্মশান ঘাট ছিল আমাদের মুখর আড্ডার প্রিয় জায়গা। বিকেলে মসজিদে কায়দা-আমপারা-কোরান পড়া শেষ করে আমরা দলবেঁধে যেতাম ঘাটে। আড্ডা দিতাম, হইচই করতাম। শ্যাওলা পড়া সিড়িতে বসে পা ডুবিয়ে রাখতাম করতোয়ার জলে। বিকেল পার হতো, সন্ধ্যা আসতো। ভুতের মতো তাকিয়ে থাকা বটগাছকে বিদায় দিয়ে আমরা পা বাড়াতাম বাড়ির দিকে।

রিপনরা দত্তবাড়ি থাকতো। ওদের ওখানে বড় পুজো মন্ডপ ছিল। তখন কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা। দুর্গাপূজার সময় রিপনদের সঙ্গে সমান পাল্লা দিয়ে আমরাও লেগে যেতাম মন্দির সজ্জায়। ঘটে মা দেবিকে তোলা অবধি বিরাম ছিল না আমাদের। তারপর ষষ্ঠী থেকে দশমী, দেবি বিসর্জন- জাতপাত ভুলে আমরা মিশে যেতাম দুর্গাৎসবে।

সে শৈশব কৈশোরের কথা। প্রতি দুর্গাপূজায় আমরা ছুটি পেতাম নিত্যকার পড়ালেখার রুটিন থেকে। বাবাকে পাড়ার লোকে বলতো ‘মুরব্বি’। তিনি নাকি ওয়াক্ত নামাজে প্রথম কাতারে না থাকলে স্বয়ং ইমাম সাহেবও নামাজ কবুলে ভরসা পেতেন না। সেই বাবাই পূজার তিনদিন দৈনিক ১০ টাকা করে দিতেন আমাদের। পরে অবশ্য সেটা ৩০ পর্যন্ত উঠেছিল। আমরা ওই টাকা নিয়ে মালতীনগর পূজো মন্ডপে যেতাম। পূজা দেখতাম। সুতোয় টানা মাটির সাইকেল, হাতি, টমটম গাড়ি কিনতাম। চিনির ছাচ, নকুল, বাতাসা, কদমা কিনতাম। সন্ধ্যায় চোখেমুখে ধুলোমেখে, ওইসব খেলনার রাস্তায় মুখর শব্দ তুলে বাড়ি ফিরতাম। মা অপেক্ষা করতো। কি কিনেছি- দেখতো। টুপ করে একটা বাতাসা মুখে পুড়ে বলতো, পটে রেখে দে, আস্তে আস্তে খাবি। বাসার সবাইকে দিতে হবে।

শ্যামলের বাবা মারা গেল। মনটা খারাপ। রায়ের বাজারে ওদের বাসা। কে ভাঙবে ওর মায়ের হাতের শাঁখা। কার এমন সাধ্যি চোখের জলে এমন কঠিন কাজ করার! শেষঅবধি দায়িত্বটা আমার ওপর বর্তালো। শিল দিয়ে শাঁখা ভাঙলাম। বুক জুড়ে কান্না। মাসিমার চোখের জল আমাকে ভাসিয়ে নিলো বিষাদে। শবদেহ নিয়ে শ্মশানে গেলাম। সারারাত শ্মশানে পুড়লো দেহ। ভোরের দিকে জলে ভাসলো দেহপোড়া ছাই। আমার কানে তখন কেবলই ওর বাবার শাসনবাণী- লেখাপড়া না করলে কি করে খাবি তোরা!

আমাদের এমন অনেক বন্ধু স্বজন আছে, আমরা জানতাম না ওর বা তাঁর ধর্ম কি! ও কি হিন্দু, নাকি মুসলমান। চলতে চলতে কোন একদিন হঠাৎ যদি কেউ জিজ্ঞেস করতো, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। যেমন- সঞ্জীব’দা। আমাদের ভোরের কাগজের সঞ্জীব চৌধুরী। তার মরদেহ যেদিন টিএসসিতে আনা হলো, যেতে যেতে রাসেল ভাই জিজ্ঞেস করেছিলো- সঞ্জীব’দা হিন্দু, না মুসলমান। আমি বলতে পারিনি। পরে যখন শ্মশানে দাহ করার জন্য নিয়ে গেল, জানলাম জাত, ধর্ম।

আমরা এভাবেই বেড়ে উঠেছি, বড় হয়েছি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন অসংখ্য গল্প জীবনে, জীবনযাপনের পরতে পরতে, আমাদের চারপাশে। আমরা ধর্ম ও জাতকে আলাদা করতে শিখিনি। পূজো-অর্চনা, ঈদ-শবেবরাত, আমরা উৎসব করেছি, একসাথে একাত্ম হয়ে উদযাপন করেছি, এখনো করি।

আমরা শিখেছি সব ধর্ম জাতিকে সম্মান করতে। মসজিদ মন্দির গীর্জা- সবই উপাসনালয়। সেখানে প্রার্থনায় বসলে প্রশান্তি আসে মনে, পাপবোধ জাগ্রত হয়, শোধরানোর তাগিদ আসে ভেতর থেকে। আমরা শুদ্ধ হই, শুদ্ধাচার পাপপঙ্কিলমুক্ত জীবন গঠনে ব্রত হই।

কুমিল্লায় মন্দিরে কোরআন শরীফ পাওয়ার একটি তথ্যকে কেন্দ্র করে সারাদেশে মন্দিরে মন্দিরে, দুর্গাপূজার উৎসবে, যে হামলার খবর আসছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে শঙ্কা জাগছে, তা সত্যিই বেদনার। আমাদের সম্প্রীতি নষ্টের এ এক অশুভ পায়তারা।

কেউ কি বুকে হাত দিয়ে হলফ করে বলতে পারবেন, এদেশে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত, হাটে বাজারে, রাস্তায় মাঠে, হিন্দু-মুসলমান একসাথে এক টেবিলে বসে আড্ডা দেন না? একে অপরের বাড়িতে যান না, খান না? একের বিপদে অন্যে এগিয়ে আসেন না? আপনার বন্ধু স্বজনের তালিকায় হিন্দু বা মুসলমান নাম নেই- একথা কি কেউ বলতে পারবেন? তাহলে গুটিকয় ধর্মান্ধ বা অশুভ মানুষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের এই অপচেষ্টা, কেন মেনে নেন? কেন এসব উস্কানির প্রতিরোধ করেন না? মনে রাখবেন, সব ধর্মেই মানুষের কল্যানের কথা বলা হয়েছে; অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল হতে বলেছে।

আমি আমার চারপাশে কাউকে ধর্ম বা জাতের দিক দিয়ে বিবেচনা করি না, মনেও আসে না। প্রত্যেককে দেখি বন্ধু, স্বজন, নাগরিক হিসেবে। আমার কাছে সব ধর্ম ও জাতের মানুষ সমান, সম্মানের। সবাইকে সমান ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। সব ধর্মের ধর্মাচারণকে সমানভাবে দেখি, দেখতে শিখেছি। আমি জানি, অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দেশে ঘর ও ঘরের বাইরে সব ধর্ম ও জাতের মানুষই আমার স্বজন।

কেউ মুসলমানকে অবজ্ঞা করলে আমি যেমন কষ্ট পাই; তেমনি হিন্দু বা অন্য ধর্মের কাউকে হেয় করলেও আমার কষ্ট হয়। আমি যখন মন্দিরে যাই, পূজো দেখি, ধুপের ধোয়া নাকে আসে; পরম বিশ্বাস নিয়ে ওরা যখন দেবতার পায়ে নিজেকে সঁপে দেয়; আমি মঙ্গল কামনা করি, কল্যান চাই।  আবার কাউকে যখন মসজিদে দেখি, নিজে যাই, সেজদায় নত হই; পরর প্রশান্তিতে ভরে ওঠে মন। আজান যেমন মধুর লাগে; তেমনি দূর থেকে ভেসে আসা শঙ্খধ্বনি আমাকে মুগ্ধ করে। আমি কোনভাবেই কোনকিছুতেই হিন্দু মুসলমান বা অন্য ধর্মের কোন আচার-আচরণ, বিশ্বাস- অবহেলা অবজ্ঞা করি না। আমি শেষতক মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি।

মানুষ বুঝুক, বোধোদয় হোক। রাজনীতি বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, মানুষকে বিভক্ত না করুক। ধর্মের জাতপাত তুলে, মানুষ মানুষকে ভুল না বুঝুক। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দেশে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প আর না ছড়াক। সব ধর্মের সব মানুষ আমরা সমস্বরে বলি- আমরা বাঙালি, বাংলাদেশি। আমাদের মতো, এমন সম্প্রীতির ইতিহাস, পৃথিবীতে আর কোথায় আছে, বলুন! কোথায় ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে, এত প্রগাঢ় সুশীতল ভালবাসা!

প্রতীক ইজাজ
সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
ঢাকা।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments