আমরা এমন এক দেশের মানুষ যেখানে মাকে সবার ওপরে জায়গা দেয়া হয়। এখনো বেশীরভাগ পরিবারে মায়েরা সংসার সামলাতে গিয়ে বাইরে কাজ করতে পারেন না,বা করেন না। হয়তো সে অর্থে তাঁরা উপার্জনে নাই। কিন্তু তাঁদের কাজ আর সংসারের দায়িত্ব যে কি বিশাল আর কতটা ফলপ্রদ সেটা বলারও দরকার পড়ে না। তাই তাঁরাই ঘরে ঘরে কর্ত্রী। শুধু কর্ত্রী বললে ভুল বলা হবে আপদে বিপদে আমার মত অনেকের পরিবারে তাঁরাই ভরসা। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে মা যা বলতেন সেটাই ছিলো চূড়ান্ত। ব্যাংক অফিসার পিতা কাজ আর টাকা এনে বুঝিয়ে দেয়াতেই খালাস। কারো অসুখ হলে রাত জাগা শিয়রে বসে থাকা থেকে কে কখন কি খাবে কখন কার কত টাকা লাগবে সবকিছু ছিলো মায়ের নখদর্পণে। মায়েরা যে পরিবারে চায় বা ইচ্ছুক সে পরিবারের সন্তানরাই মেধাবী আর শিক্ষিত হয়ে ওঠে। মা এবং নারী সংসারে এক অভিন্ন সত্তা।
সংসারের কাজগুলোকে যারা মনে করেন কোন কাজ না তাদের জন্য একটা গল্প বলি। আমরা যারা অষ্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন নিয়ে আসি বা যারা কোন একসময় নাগরিক হবার সুযোগ পায় তাদের একটা টেষ্ট দিতে হয়। এখন কি নিয়ম জানি না কুড়ি বছর আগে আমাদের সময় মৌখিক ভাবেও টেষ্ট দিতে হতো। যার পোশাকী নাম ইন্টারভিউ। সে যাত্রায় আমার এক বাঙালি মেধাবী বন্ধু ইন্টারভিউয়ের পর ঢাহা ফেইল। তাকে আবার যেতে হবে টেষ্ট দিতে। সে জানতে চেয়েছিল কসুর কোথায়? কি এমন ভুল বলেছে যার জন্য তাকে নাগরিকত্বের টেষ্টে ফেল করতে হলো। ওদিকের সাদা মানুষটা হাসতে হাসতে বলেছিল, তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম তোমার স্ত্রী কি করেন? তুমি তার দিকে তাকিয়ে নিস্পৃহভাবে উত্তর দিলে : কিছুই না আমার দুই সন্তানের দেখভাল করে। এই উত্তরটা মারাত্মক। তোমার কোন ধারণা নেই মা’র কাজ কতো কঠিন আর তার শ্রমফল যোগ করলে তোমার বেতনের বেশী বৈ কম হবে না। এই কারনে তুমি পাশ করো নি। আমরা হয়তো ভাবি খালি আমরাই মাকে শ্রদ্ধা করি, ভুল। এসব দেশে আমাদের মতো আবেগ বা ভাবাবেগের কমতি মনে হলেও এরা মা কে আমাদের চাইতে কম ভালোবাসে না।
একটা বিষয়ে আমরা গর্ববোধ করি এই বলে যে আমাদের কোন মা দিবস লাগে না। আমরা মা দিবসে বন্দী না। এটা কথা হিসেবে ঠিক। কিন্তু আমাদের নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনকে পাশাপাশি রাখলেই আপনি বুঝবেন কেন দিবস দরকারী। কর্মপ্রবাহের জীবনে পাশ্চাত্যে একটা দিন বের করাও কঠিন। তাই সপ্তাহান্তের একটি দিনে বছরে একবার মা কে মনে করার এই রীতিতে বানিজ্যবুদ্ধি থাক আর যাই থাক মানুষকে মনে করিয়ে দেয়া হয়, ভুলে যেওনা আজকের দিনটি শুধু তোমার মায়ের জন্য।

একবার ভাবুন তো রেডিও টিভি সংবাদপত্র থেকে সর্বত্র মা দিবসের জমজমাট আয়োজন আছে বলেই আপনার সন্তান আজ ঘরে বসে আপনাকে তার হাতে আঁকা ছবি দিয়ে চমকে দিচ্ছে। আপনি যা ভাবেননি তেমন কোন আয়োজন করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। জীবনে এমন কিছু জিনিষ বা শখ আছে নানা কারণে সংসারের দায় মেটাতে গিয়ে পূর্ণ হয়নি তেমন একটি উপহার দিয়ে আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কতটা ভালোবাসার আপনি।
মাকে নিয়ে যতগুলো গল্প আছে তার ভেতরে বহুল পঠিত এই গল্পটি এখনো সেরা:ভাবী স্বামীকে একটাবারের জন্য পরীক্ষা করে নিতে চাইলো সে। তাই মেয়েটি বলল তাঁর প্রেমিককে, তুমি তো আমায় বেশি ভালোবাসো না। তুমি তো তোমার মাকেই ভালোবাসো। ছেলেটি আকাশ থেকে পড়ে বলল, না গো। আমি মাকেও ভালোবাসি আবার তোমাকেও খুব ভালোবাসি। কিন্তু মেয়েটির শুধু এই কথাতে মন গলবে কীভাবে! তাই সে সরাসরি বলল, আমাকে তুমি বোঝাও যে, তুমি তোমার মায়ের থেকেও আমাকে বেশি ভালোবাসো।ছেলেটি পড়ল বেজায় ফাঁপড়ে। সে বলল, আচ্ছা বাবা, বলো তোমার জন্য কী করতে হবে? মেয়েটি তখন বলল, তুমি তোমার মায়ের হৃৎপিণ্ডটা কেটে নিয়ে এসে আমার হাতে দাও। তাহলেই বুঝবো যে, তুমি তোমার মাকে নয়, আমাকেই বেশি ভালোবাসো। ছেলেটি যে তখন প্রেমে পাগল। বলল, আচ্ছা, তুমি যখন চাইছো, তাহলে তাই হবে। তাই ছেলেটি চলল তাঁর বাড়িতে। আর ছুরি বসিয়ে দিল মায়ের বুকে। মারা গেল ছেলেটির মা। ছেলেটি তখন মায়ের হৃৎপিণ্ড খুবলে নিয়ে বেরিয়ে আসতে গেল ঘর থেকে। যাতে তাঁর প্রেমিকাকে সে এবার বিয়ে করতে পারে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় ছেলেটি দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেল। আর তাঁর হাত থেকে মায়ের হৃৎপিণ্ডটা ছিটকে পড়ে গেল দূরে। ছেলেটি সামলে নিয়ে উঠতে উঠতে শুনতে পেল, ওই হৃৎপিণ্ডটা বলছে, ‘আহা রে খোকা তোর লাগেনি তো?’
গল্পটা কি আসলেই খালি আবেগ প্রসূত? এই যে কঠিন করোনার দিন। সারা দুনিয়া করোনার ভয়ে কাবু। কেউ কারো কাছে যায় না। কারো পাশ ঘেঁষে না। সে সময়কালেও কি কোন মা আছেন যিনি সন্তানকে দুধ পান করান না? এমন কোন মা আছেন যার সন্তান অসুস্হ বোধ করলে পালিয়ে গেছেন? বরং আমরা খবরে দেখেছি সবাই চলে গেলেও করোনা রুগীকে ছেড়ে যাননি মা। মা তো এমনই যাকে আপনি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারেন। আমরা যারা বয়সকালে মাতৃহারা তারা যেমন এখন শুধু খুঁজে বেড়াই যারা জন্মের সময় বা শৈশবে মা হারা তারাও কিন্তু তাই। বাংলা সাহিত্য শিল্পের প্রধান মানুষ রবীন্দ্রনাথ। তিনিও শৈশবে মাকে হারিয়েছিলেন। তাঁর কবিতা ছড়ায় বারংবার মায়ের জন্য কান্না বেদনা আর না দেখার আকুতি এসেছে ঘুরে ফিরে। তিনি কী সাবলীল ভাবে লিখেছেন: মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে তুমি যাচ্ছো পালকীতে মা চড়ে…. পুরো কবিতাটায় শিশুর বীরত্বের দুটো কারণ । প্রথমত মানে নির্ভয়ে রাখা আর মা কেই দেখানো সে কতবড় হয়ে গেছে। এই বিষয়টা চিরন্তণ। আর কেউ কোনকালে আপনার কোন অর্জণ বা পরাজয় নি:শর্ত ভাবে নেবে না। একজনই নিতে পারেন তিনি মা।
মা শুধু সন্তানের জন্মদাত্রী ভাবাও ভুল। দুনিয়ার বহুদেশকে সেসব দেশের মাতা মনে করা হয়। শ্রীলংকার জাতীয় সঙ্গীতেও মাতা শ্রীলংকা বলে গান গায় তারা। আমরাও মনে করি আমাদের দেশ মায়ের মতো। তাই তো মায়ের টানে সেই বৃটিশ আমল থেকে হাজার হাজার মানুষ আত্মদান করে অমর হয়েছেন। কবির ভাষায়, তোমার পরে ঠেকাই মাথার দেশ যদি মা না হয়তো আর কে জননী হতে পারে?
মায়ের সবচাইতে সুন্দর দৃশ্য আমার মতে দুটি। একটি যখন তরুণী মা দূরন্ত শিশুটিকে একহাতে খাবার মুখে দিয়ে আর এক হাতে জুতোর ফিতে বেঁধে সংসার সমাজে লড়াই করতে পাঠান আরেকটি হলো দিবাবসানে যখন ক্লান্ত মুখটি দূর থেকে সন্তানকে আসতে দেখে অনাবিল আনন্দে ভরে ওঠে আলোর দ্যুতিতে।
জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক অবিচল দোলনার নাম মা। ম্যাক্সিম গোর্কী থেকে আজকের সাহিত্যে শিল্পে গানে কবিতায় ছবিতে এর চাইতে পবিত্র কোন কিছুর সন্ধান নাই। মা দিবসে সব মাকে জানাই শ্রদ্ধা ভালোবাসা আর প্রীতি।
অজয় দাশগুপ্ত
লেখক ও কলামিস্ট
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।