১৯৯১ সালের আগস্টে গর্বাচেভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেন রুশ হার্ডলাইনাররা। গর্ভাচেভের সংস্কার কর্মসূচির বিপরীতে তারা রুশ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রাখার পক্ষে ছিলেন। সংস্কার-পূর্ববর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নে ফেরার লক্ষ্যে আগস্টে তারা গর্বাচেভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। এরপর থেকে কার্যত অচল হয়ে পড়ে সোভিয়েত-ব্যবস্থা। ওই মাসেরই শেষের দিকে গর্ভাচেভ পদত্যাগ করেন।
বিবিসির প্রতিবেদককে গর্বাচেভ বলেন, ‘আমাদের অজান্তেই একটি বিশ্বাসঘাতকতা সম্পন্ন হয়েছিল। একেবারেই আমার অজান্তে।’ গর্ভাচেভ বিবিসির প্রতিবেদককে বলেন, ‘কেবলমাত্র একটি সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে তারা একটা পুরো বাড়ি পুড়িয়েছিল।’ এই হলো প্রয়াত গর্বাচেভের ভাষ্য । যা ইতিহাস কখনো ভুলবে না ।
যদি অতীতে ফিরে যাই ,তখন আমরা যৌবনের শেষ প্রান্তে। তাসের ঘরের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির ভোল পাল্টানোর প্রতিযোগিতা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এখনকার প্রজন্ম ভাবতেও পারবে না কেমন ছিল তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এখন অনেকে মনে করেন রাজনীতির দরকার নাই। রাজনীতি মানে কলহ মারামারি। কথা অসত্য নয়। কিন্তু সভ্যদেশগুলো কি আসলে রাজনীতিহীন? না রাজনীতি বাদে কোন দেশ চলে? মূলতঃ পুঁজি ও বাজার সবকিছু গিলে নিয়ে তরুণ তরুণীদের এমন এক হাল করেছে যে এরা না ঘুমায় না জাগে না ভাবে। নেশায় বুঁদের মতো সারাক্ষণ নেট দুনিয়ার নাগরিকদের কাছে পৃথিবী কি নিরাপদ থাকতে পারে? না তা সম্ভব?
এই বাস্তবতার জন্য দায়ীদের অন্যতম ছিলেন গতকাল প্রয়াত মিখাইল গর্বাচেভ। সে কাহিনি যারা জানেন তারা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি দেশের এখনকার চালু বাংলা দৈনিকের সম্পাদক সহ অনেক বিশিষ্ট জন তখন হঠাৎ ভোল পাল্টে কি লিখেছিলেন, কেন লিখেছিলেন। পরবর্তীকালে এদের চেহারা স্পষ্ট হবার আগেও অনেকে বুঝতে পারেননি এই গ্লাসনস্ত বা পেরেস্ত্রোইকা বিষয়গুলো কি। ঠাট্টা করে অগ্রজেরা এ দুটোকে বলতেন, গ্লাসনষ্ট ও পরস্ত্রীকা। মজার ব্যাপার এই, যারা রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়নে বৃষ্টি হলেই ঢাকায় ছাতা মাথায় দিতেন তারাই উল্টে গেলেন রাতারাতি। বলাবাহুল্য মিখাইল গর্বাচেভ হয়ে উঠলেন নয়া হিরো।
এ কথা বেমালুম ভুলে গেলাম সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করা অসম্ভব ছিল। বিশেষত আমেরিকা, চীন ও পাকিস্তানের সাথে জুটে যাওয়া পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশ তখন যুদ্ধে পাকিদের পক্ষে। আর যাই হোক পাকিস্তান বিরোধী কোন এ্যকশন বা ভোটে যাবে না তারা। সোভিয়েত ইউনিয়নই বাঁচিয়ে রেখেছিল আশা। একাধিক বার ভেটো না দিলে নিরাপত্তা পরিষদে ভুট্টার আগ্রাসন সামলানো যেতো না।

গর্বাচেভের কারণে ধস নামা রাজনীতিতে দেশে সমাজতন্ত্র ও আদর্শের মাঠেও চললো নতুন খেলা। শক্তিশালী বাম নামে পরিচিত ভারতের রাজনৈতিক দল সি,পি,আই এখন উধাও। কোথাও নেই তারা। বাংলাদেশে সোভিয়েত পন্থীরা মোটামুটি ভালো অবস্থানে থাকার পরও গর্বাচেভের কারণে দিশেহারা হয়ে পার্টি অফিসের কাগজপত্র আসবাবপত্র দুই ভাগে ভাগ করেছিল। তখন বেঁচে থাকা সাংবাদিক লেখক ওয়াহিদুল হক লিখেছিলেন, ভাগ্যিস মানুষ এক পায়ে বসে মল মূত্র ত্যাগ করতে জানে না। নয়তো কমোডও দু ভাগে ভাগ করতো এরা।
গর্বাচেভের সমঝোতা ও আঁতাতের পর সে দেশে লেনিনের মূর্তি ভাঙার উল্লাস দেখেছি। ঐতিহাসিক লেনিনগ্রাদের নাম বদলে দেয়া হলো। কিন্তু গর্বাচেভ বেশীদিন টিকলেন না। বরিস ইয়েলেৎসিন নামের এক উন্মাদের ঠাঁই হয়েছিল রাশিয়ার সিংহাসনে। এই নির্মম বাস্তবতা আমেরিকা সহ ইউরোপকে খুশী করলেও দুনিয়ায় ভারসাম্য হারিয়ে গেলো। একক শক্তি ও বাধাহীন হবার পর আমেরিকা দেশে দেশে যে যুদ্ধ ও অন্যায় করেছে তা সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকলে কখনো করতে পারতো না। মারা যেতেন না সাদ্দাম হোসেন। মধ্যপ্রাচ্য সহ বহু দেশে সোভিয়েত পতন হয়ে উঠেছিল অভিশাপ।
দেশেও দেখলাম সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা ওড়ানো সাংবাদিক, দলীয় বুলেটিনের সম্পাদক এখন লীগের নামে পদ পদবীর দালাল। ব্যক্তি বন্দনা আর পায়ে ধরে খেতাব নেয়ার জন্য মরিয়া এই লোককে দেখে খাঁটি আওয়ামী লীগারেরা এখন শংকিত থাকেন। সমাজতন্ত্রের কথিত ফেরিওয়ালাদের কপাল খুলে দিয়ে গেছেন গর্বাচেভ।দেশে দেশে বহু পরিবর্তন ও বদলে যাওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গর্বাচেভ নোবেল পেয়েছিলেন বটে একই সাথে তাঁকে পিৎজা বিক্রির বিজ্ঞাপনেও ব্যবহার করেছিল পুঁজিবাদ। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে কি লাভ বা ক্ষতি করেছেন সেটা এখন অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু এখনো কি রাশিয়া যুদ্ধ করছে না? ইউক্রেনে রুশ হামলা কি পুরনো ঘটনা? যার মানে এই, সময়ও পশ্চিমাদের চাওয়া মেটানোর কারণেই অকস্মাৎ হিরো হয়ে উঠেছিলেন মিখাইল গর্বাচেভ।
বিপুলা পৃথিবীর কতটুকু জানি, এ বলে আক্ষেপ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জটিল রাজনৈতিক সমীকরণে কে কোথায় থাকে বলা মুশকিল। তবে এটাও মানতে হবে অবরুদ্ধ, শাসনের ভারে ঘেরাটোপে আবদ্ধ রাশিয়ানদের মুক্তি দিয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু বাস্তবতা কি বলছে?
রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৫ প্রজাতন্ত্রের পরাশক্তি ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক-এর পতনকে ‘অপরাধ’ এবং ‘অভ্যুত্থান’ আখ্যা দিয়েছেন ইউনিয়নের শেষ নেতা মিখাইল গর্ভাচেভ। দাবি করেছেন, তার অজান্তে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটানো হয়েছিল।সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে পরিচিত এই জোট ১৯৯১ সালে ভেঙ্গে পড়ার সময় গর্ভাচেভ ছিলেন অবিভক্ত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। গুরুত্বপূর্ণ সেই অধ্যায় সম্পর্কে মস্কোতে বিবিসির সংবাদদাতা স্টিভেন রোজেনবার্গের সাথে কথা বলেন তিনি।
স্নায়ুযুদ্ধ শেষ করার জন্য সে সময় পশ্চিমাদের বাহবা কুড়িয়েছিলেন গর্ভাচেভ। তাকে দেওয়া হয়েছিল নোবেল শান্তি পুরস্কার। তবে বিবিসি প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ২৫ বছর আগের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ঘটনায় তাকে অনুশোচনায় ভুগতে দেখা যায়।
যখন তাঁর অনুশোচনা ফিরে এসেছিল তখন সময় অনেকদূর গড়িয়ে গেছে । স্নায়ুযুদ্ধের অবসান নামের উৎসবের মাজেজা টের পেয়ে গেছে দুনিয়া । এমন ই হয় । সময় থাকতে যাঁরা অনুশোচনা ভোগ করেন না সময় তাঁদের কাউকে ছেড়ে কথা বলে না । আমি মনে করি ইতিহাস তার গতিপথ নিজেই ঠিক করে নেয় । বাঁকে বাঁকে সে এমন সব মহাজনদের তৈরী করে রাখে যাঁরা সময়ে নায়ক আবার অসময়ে খলনায়ক। গর্ভাচেভ নায়ক না খল নায়ক তার বিচার এখনো হয় নি। যখন হবে বা সময় করে দেবে তখন আর যাই হোক এটাত অন্তত: বলা যাবে না তিনি যা করেছিলেন তা ছিল একশ ভাগ সঠিক। সে সময় কাউবয় হ্যাট মাথায় গর্ভাচেভকে হিরো বানিয়ে তোলা পাশ্চাত্য মিডিবা এখন কি বলে সেটা দেখার বিষয়। ইতিহাস নিশ্চয় ই এটা ও মনে রাখবে যে, তিনি ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক জীবনে ফিরে আসার একটি দুর্ভাগ্যজনক প্রচেষ্টা করেছিলেন। সে সময় অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মাত্র ০.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন । রাজনীতির মারপ্যাঁচ যাই বলুক এই ভদ্রলোক একসময় ত্রাতা বা গণতন্ত্রের প্রবক্তা নামে পরিচিত ছিলেন । যদিও সে ধারণা পরে আর কাজ করে নি। যদি কোন লোকসান হয়ে ধাকে তো হয়েছে আপামর দরিদ্র আর হতাভগ্য জনগোষ্ঠির । যারা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার কুফল আজো ভোগ করছেন।
সবমিলিয়ে ইতিহাসের এক দ্বৈত চরিত্র মিখাইল গর্বাচেভ । একদিকে যিনি হঠাৎ উদ্ভাসিত নায়ক আবার আরেকদিকে ক্রমাগত ডুবে যাওয়া বিতর্কিত রাজনীতিবিদ। তবু এমন মানুষ বারবার জন্মায় না। এটাই সত্য বলে মানি।
অজয় দাশগুপ্ত : MIMA- Parliament of NSW কর্তৃক অস্ট্রেলিয়ায় সেরা কলামিস্ট (বাংলা ) ২০২২ পুরস্কারপ্রাপ্ত।