মিতা হক: নিরন্তরের পথিক । দীপংকর গৌতম

  
    

মিতা আপা। মানে মিতা হক। ছায়ানটের শিক্ষক মিতা আপা। যুবদার (অকাল প্রয়াত খালেদ খানের নাম ছিলো যুবরাজ। আমরা যুবদা’ বলে ডাকতাম) স্ত্রী মিতা আপা। বিনয়ী, সহজ প্রানোচ্ছ্বল গানের পাখি মিতা আপা। গোপালগঞ্জে থাকতেই তার গানের ভক্ত ছিলাম। ছাত্র ইউনিয়ন করার সুবাদে একবার সম্মেলনে প্রথম সামনে থেকে গান শুনেছিলাম। বিস্মিত হয়েছিলাম তার গায়কী দেখে। তিনি যেভাবে শুরু করেছিলেন শেষও একইভাবে করেছিলাম। তার গান গাওয়ার সময় মনে হয়েছিলো তার আশপাশের প্রকৃতিও যেন উচ্চকিত সুরে গাইছে। তার গান শুনে মুগ্ধতায় ডুবেছিলাম। তারপরে ঢাকায় আসলাম। বিভিন্ন জায়গায় তার গান শুনেছি। তখন যুবদা উদীচী করতেন। উদীচীতে আসতেন। তাদের আড্ডায় আমিও সামিল হতাম। তারপরে আমি ছায়ানটে ভর্তি হই। আমাদের উদীচী ও ছায়নটের কয়েকজন মিতা আপার সুরতীর্থে যেতেন। সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে ধানমণ্ডি ৪ এর বাসায় যাওয়া শুরু। আসলে আশির দশকে শান্তিনিকেতন থেকে এসে একদল শিল্পী যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চার প্রচল ধারা ভেঙ্গেছিলেন। বিশুদ্ধ সঙ্গীত চর্চা ও রবীন্দ্রচর্চার সেই ধারার একজন ছিলেন মিতা হক। তার আচার-ব্যবহার, সরলতা ছিলো অবাক হওয়ার মতো। তার সাধনভজন সবই ছিলো মুগ্ধতায় ভরা। লোক দেখানো কিছুই ছিলো না। গান অন্তপ্রান মানুষটি অসুস্থ হয়ে ধীরে ধীরে লোকক্ষুর অন্তরাল থেকে সোজা নিরন্তরের পথে।

আমৃত্যু একজন বাঙালি ছিলেন মিতা হক।

মিতা হক নেই। গত ১১ এপ্রিলের সকালবেলার রোদ্দুর যতোটা পশ্চিমে হেলছিলো ততোটাই শোক যেন আছড়ে পড়ছিলো। কলকাতা, আসাম ত্রিপুরার অনলাইনগুলো ভরে উঠছিলো শোক সংবাদে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মুহূর্তেই আচড়ে পড়ছিলো শোক। বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো বিস্মিত হচ্ছিলো স্বজন-শুভানুধ্যায়ীরা। তবুও মৃত্যুই অমোঘ এই সত্যতা নিয়ে ছুটে চলছিলো তার লাশবাহী গাড়ী। কি দু:সহ শোক জগদ্দল পাথরের মতো গড়িয়ে যাচ্ছে। একর পর এক প্রতভিাধর মানুষগুলো চলে যাচ্ছে। বেলা ১১টায় মিতা হকের মরদেহ তার স্মৃতিভরা ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনে ভবনে নিলে যে শোকের নদী উছলে উঠে তা দেখার মতো না। বহুদিনের ঘনিষ্ট সহযোগী-শিক্ষার্থী, স্বজন, শুভানুধ্যায়ীরা ফুল দিয়ে মিতা হককে শেষ শ্রদ্ধা জানান। এ সময় সমস্বরে তাঁরা গেয়ে ওঠেন, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে’, ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ ও ‘পথে চলে যেতে যেতে’ গানগুলো। তারপরে লাশবাহী গাড়ী ছুটে যায়কেরানীগঞ্জের বড় মনোহারিয়ায়। যে গ্রামে ছড়িয়ে আছে তার অজস্র স্মৃতি। বাবা-মায়ের সঙ্গে কত বেলা কেটেছে এই সরল গ্রামের কোমল আঙিনায়। তার পছন্দের এই ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা গ্রামে মা–বাবার কবরের পাশে শেষ ঘুমে যান তিনি।

অনেকে মিতা হককে বলে থাকেন ওয়াহিদুল হকের কন্যা। এটার যথেষ্ট কারণ ছিলো। ওয়াহিদুল হক বা সনজীদা খাতুন এমন স্নেহভরে তাকে বড় করেছিলেন যে তিনি তাদের আদর্শ মেনেই বড় হয়েছিলেন। তাই অনেকে অনুমান করে এভাবে বলতো। আসলে তা নয়। মিতা হকের বাবা ছিলেন প্রথিতযশা সাংবাদিক রেজাউল হক বাচ্চু। যিনি ওয়াহিদুল হকের ভাই। ওয়াহিদুল হক সনজীদা খাতুনের জীবন দর্শন লালন করে গেছেন তিনি আমৃত্যু যে কারনে তার সঙ্গীত গুরু তার বাবা হয়ে উঠেছিলেন।

ছোট্ট মেয়ে ফারহিন খান জয়িতার সঙ্গে মিতা হক ও তাঁর স্বামী খালেদ খান যুবরাজ।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশুদ্ধ ধারায় যারা সঙ্গীত পরিবেশন করতেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। তাকে নিয়ে সঙ্গীত জগতে একটি কথা প্রচলিত ছিলো। তিনি শিল্পীই না ছিলেন সাধকও। তিনি শুধু গলা দিয়ে গাইতেন না মন-প্রাণ দিয়ে গাইতেন, বুঝে শুনে সবকিছুকে আত্মস্থ করে গাইতেন। গাওয়ার সময় এই জগতে তিনি বিচরন করতেন না। তিনি ছিলেন আপাদ মস্তক একজন শিল্পী –সাধক। যে কারণে তার বাইরের চাকচিক্য ছিলো না, মিডিয়ার পেছনে ছোটার অভ্যাস একদম ছিলো না। নিপাট সরল সহজ একজন সহজিয়া মানুষ। ধানমণ্ডি ৪ নম্বরের বাসায় গেলে তার সহজাত হাসি মুখের প্রথম কথাই থাকতো গান গাও, তার গানও শুনতে চাইলে তিনি খুশীই হতেন। গান গাওয়ার সময় নিজেও যেমন কোন শব্দ শুনতেন না-গানের সাথে একাকার হয়ে যেতেন-চাইতেনও অন্য কারো গান শোনার সময় কেউ কোন শব্দ না করে শিল্পীকে গাওয়ার পরিবশে করে দিতে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন গান পাগল। তাঁর চাচা ওয়াহিদুল হক ছিলেন দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক ও রবীন্দ্র গবেষক। তিনিই মিতা হকের প্রথম শিক্ষক। পরে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান ও সন্জীদা খাতুনের কাছে গান শেখেন তিনি। ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি তবলাশিল্পী মোহাম্মদ হোসেন খানের কাছে গান শেখা শুরু করেন। তারপরে আর থামেন নি।

আমাদের দেশে শিল্পী নেহাত কম নয়। সুর ও সঙ্গীতের সাধক কজন সেটা হাতের কর গুনে বলা যায়। মিতা হক ছিলেন বিরলপ্রজাতি এক সুরের সাধক। তার চাচা ওয়াহিদুল হকে সাধন ভজনের পথ ধরেই চলছিলেন তিনি। যিনি রবীন্দ্রনাথের দর্শন ধারণ করেছিলেন জীবনের পরতে পরতে। এমন শিল্পবোধের মানুষ, রবীন্দ্র সাধনের এমন আলোকবর্তিকাবাহী নির্মোহ মানুষটিকে আমরা অকালে হারালাম (৫৯ )।

এই শুন্যতা পুরনের নয়। মিতা হক নিজের মতো করে একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে চেয়েছিলেন নাম সুরতীর্থ। একদম বানিজ্যিক নয়। সেখানে অনেক স্কুলের মতো জামা –কাপড় বিক্রি হতো না। বিশুদ্ধ রবীন্দ্রচর্চা শেখানো হতো। শুধু গানই না, রবীন্দ্রনাথকে পড়ানো হতো যাতে ছাত্ররা তাদের অনুভ’তিতে রবীন্দ্রনাথকে ধারন করতে পারে। কিন্তু সুরতীর্থ, ছায়ানট সব কিছু ফেলে তিনি আজ নিরন্তরের পথে।
আমাদের দেশের দেশের রবীন্দ্র চর্চার প্রেক্ষাপটে আমরা দেখি মুক্তিযুদ্ধের পরে অনেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা করেছেন। এরমধ্যে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের তপন মাহমুদ অন্যতম। তারপরে জনপ্রিয় ছিলেন পাপিয়া সারওয়ার, আরো অনেকেই এ চর্চায় ছিলেন আমি সংক্ষেপে বলছি) কিন্তু আশির দশকের শুরুতে রবীন্দ্র সঙ্গীতে যারা জনপ্রিয় হয়ে উঠেন তারা সবাই শান্তি নিকেতন থেকে আসা। এদের মধ্যে ছিলেন রেজওযানা চৌধুরী বন্যা, আমিনুর রহমান নিঝু ও সাদী মেহাম্মদ। এসময় রবীন্দ্র সঙ্গীত যেন নতুন করে প্রাণ পায়। তারপরেই সঙ্গীত জগতে পা রাখেন মিতা হক উদাত্ত ও সুরেলা কণ্ঠ- সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা এক প্রাণভরানো শিল্পীর গান দ্রুত মানুষকে মুগ্ধ করে। খুব স্বল্প সময়ে তিনি শ্রোদের মন জয় করেন। সবচেয়ে লক্ষ্য করার বিষয় ছিলো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রোগামে বললেই তিনি যেতেন। নিরহংকারী শিল্পী হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যত জনপ্রিয়তা,শ্রোতা-ছাত্র, শুভানুধ্যায়ীদের যত ভালোবাসাই তিনি পেয়েছেন তাতে তার মধ্যে কখনও আমিত্ব তৈরী হয়নি। অথচ আমিত্ব তৈরী হওয়ার কি ছিলো না তার?

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন তাঁর মেয়ে ও জামাতা।

মিতা হক বাংলাদেশ বেতারের সর্বোচ্চ গ্রেডের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। ১৯৯০ সালে বিউটি কর্নার থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম ‘আমার মন মানে না’, দুই শতাধিক রবীন্দ্রসংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন মিতা হক। এককভাবে মুক্তি পেয়েছে তাঁর মোট ২৪টি অ্যালবাম। এর ১৪টি ভারত থেকে ও ১০টি বাংলাদেশ থেকে। তিনি তার সাধন ভজনের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৬ সালে শিল্পকলা পদক লাভ করেন। সংগীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০২০ সালে একুশে পদক প্রদান করে। কিন্তু নিরহংকতারী এই শিল্পী খুব ভেঙে পড়েন তার স্বামী খালেদ খান অসুস্থ হলেই। তার জীরনী শক্তি ক্ষীন হয়ে আসে খালেদ খানের মৃত্যুর পর। ক্রমশই যেন তিনি ফুরিয়ে যাচ্ছিলেন। খালেদ খানের মৃত্যুর পর প্রানবান এই মানুষটি যেন পুষ্পবৃক্ষের মতো শুকিয়ে যাচ্ছিলেন। ধীরে ধীরে কিডনীর অসুখ বাড়তে থাকে। তারপর করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুর্বল হয়ে যান। আবার হাসপাতালে নিলে তিনি আর ফেরেন নি। মৃত্যু মানুষকে নিতে পারে কিন্তু নি:শেষ করতে পারে না। তার মৃত্যুর পরে সামাজিক গণমাধ্যম থেকে পত্র-পত্রিকা অনলাইন দেখে তাই মনে হয়েছে।

জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, মৃত্যুকে কে মনে রাখে? কীর্তিনাশা খুড়ে খুড়ে কাটে বারোমাস। তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত লিখেছিলেন, বিংশ শতাব্দিতে মৃত্যুর আয়ু বড়জোর এক বছর- কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত, পঞ্চকবির গান তার শ্রেতা-ছাত্র শুভানুধ্যায়ী এই শিল্পীকে সহজে ভুলবে এমন সহজ কাজ তিনি করেননি। মিতা হকের জন্ম ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায়। বাবা ছিলেন প্রথিতযশা সাংবাদিক রেজাউল হক বাচ্চু। যিনি ওয়াহিদুল হকের ভাই। গ্রামের বাড়ি কেরানীগঞ্জের মনোহারিয়ায়। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন শিল্পী ফারহিন খান জয়িতাকে। জয়িতা সঙ্গীত প্রতিভা বিচ্ছুরিত হোক যার মধ্যে বেঁচে থাকবেন শিল্পী দম্পতি খালেদ খান ও মিতা হক। তিনি নেই তবু কানে প্রতিধ্বণিত হয়-তুমি যে সুরে আগুন ছড়িয়ে দিলে মোর প্রাণে…

দীপংকর গৌতম
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
ঢাকা, বাংলাদেশ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments