মিরার নীল শাড়ি
ইসমত আরা প্রিয়া
সন্ধা থেকে মিরা অনেক ব্যস্ত। কাল কি রঙের শাড়ি পড়বে, হাতে কেমন চুড়ি পড়লে তাকে মানাবে এ নিয়ে তার টেনশন। বিয়ে নিয়ে সবারই কম বেশি টেনশন থাকে কিন্তু মিরার ক্ষেত্রে একটু আলাদা। কারন তার মা নেই। মা থাকলে হয়তো মিরাকে আজ পালিয়ে বিয়ে করতে যেতে হতোনা।
মেয়েদের সব থেকে বড় সাপোর্ট তার মা।
মিরাকে শোভন সকাল এগারোটার সময় কাজী অফিসের সামনে থাকতে বলেছে। বিয়ের সাক্ষী হিসেবে থাকবে শোভনের দুই বন্ধু শফিক আর মাসুম। মিরা শোভনকে শাদা পাঞ্জাবি পরে আসতে বলেছে এবং সাথে মিরার জন্য নীল শাড়ি আনতে বলেছে। মোতালেব সাহেব বারান্দায় বসে সিগারেট টানছেন। এই দিয়ে মোতালেব সাহেব মিরাকে তিন বার ডাকলেন। মিরা তার বাবার ডাকে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। মিরা এখনো নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, কারন সে জানে তার বাবার কাছে গেলে, তিনি এখন খেজুরে আলাপ নিয়ে বসবে কারন তার বাবা মোতালেব সাহেব তার অফিসের কলিগের ছেলের সাথে মিরার বিয়ে ঠিক করেছেন। ছেলের নাম রিফাত আশফাক। ছেলে অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। মাস গেলে মোটা অংকের বেতন পায়। এছাড়া ছেলে বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান। মোতালেব সাহেবের একদম সোনার হরিন পাওয়ার মতো বিষয়।
মোতালেব সাহেব বারান্দায় চেয়ারে বসে পা দুলাচ্ছেন। এর মধ্যে মিরা বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো।
বাবা ডাকছিলে আমাকে?
হ্যা মা, তোর সাথে কিছু কথা ছিলো।
কাল রিফাতের বাবার সাথে কথা বললাম ওরা সামনের সপ্তাহে শনিবার শুভ কাজ ঠিক করেছেন, সব ঠিকঠাক থাকলে আগামি শনিবার শুভ কাজটা হয়ে যাবে।
মিরা চুপ করে দাড়িয়ে আছে।
আমি জানি মা আজ তোর মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবথেকে খারাপ বাবা আমি, কিন্তু একদিন তুই ঠিই বুঝবি, তোর জন্য আমি কোনো ভুল ডিসিশন নিইনি রে মা।
মিরা কিছু না বলে চলে এলো। মিরার এখন সব থেকে বিরক্ত লাগছে তার বাবাকে। কারন তিনি শোভনের বিষয়টি জানার পরেও, এই বিয়েতে রাজি হয়েছেন।
মিরা শোভনকে খুব ভালোবাসে। দরিদ্র পরিবারের ছেলে শোভন। শোভনেরর বাবা একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। গত দুই বছর যাবত আর তিনি নেই। বাস দূর্ঘটনায় তিনি মার যান। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে তার পরিবারের অবস্থা কেমন!
শোভন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।টিউশুনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালায় এবং তাকে তার পরিবারের খরচ বহন করতে হচ্ছে আজ দুই বছর।
শোভনের ছোট দুই বোন তমা আর তিশা এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। সকল খরচের ভার শোভনকেই নিতে হয়।
আজ সকাল থেকে শোভন খুব হাসিখুশি। মিরার কথা মতো শোভন শাদা পাঞ্জাবি পরে কাজী অফিসের দিকে রওনা হয়েছে। তার দুই বন্ধু শফিক আর মাসুম অনেক আগেই পৌঁছে গেছে।
শোভনের চোখে এখন শুধুই একটা রঙিন স্বপ্ন। বিয়ে করে মিরাকে তার মায়ের কাছে গ্রামের বাড়িতে রেখে আসবে। তারপর একটা চাকরি পেলে মা, মিরা আর ছোট বোনদের নিয়ে এক সাথে থাকবে।
এখন সবকিছু ঠিকঠাক। অপেক্ষা কেবল সময়ের।
শোভন বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। আকাশে খুব মেঘ যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে বলে মনে হচ্ছে। অথচ মিরা!
মিরা অনেকক্ষণ ধরে হসপিটালের আই সি ইউ এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মোতালেব সাহেবকে আই সি ইউতে রাখা হয়েছে। ডাক্তার কিছুক্ষণ আগে বলে গেছেন কোনো রকমের টেনশন জড়িত কথা তার সামনে না বলতে।
এইবার যদি তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় তাহলে তাকে আর বাঁচানো যাবেনা।
মিরা মোতালেব সাহেবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, অনেক দিন পর বাবার সাথে মিরার খুব প্রাণ খুলে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। মিরা বাবার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, বাবা তোমার রিফাত সাহেব কে বলবে, আমার জন্য বিয়েতে নীল রংয়ের শাড়ি আনতে। অনেক দিন পর মিরা তার বাবার মুখে স্বস্তির হাসি দেখলো।
মিরা ভাবছে মাঝে মাঝে অনেক বড় বড় ত্যাগের মধ্যে দিয়ে জীবনের চলার পথ খুঁজে নিতে হয়।
বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, শোভন বৃষ্টির মধ্যেই হাটছে। শাদা পাঞ্জাবি ভিজে গা দেখা যাচ্ছে। ছেলেটি কখনো কাঁদেনা, আর ছেলেদের কখোনো কাঁদতে নেই, তবুও শোভন বৃষ্টির মধ্য ভিজতে ভিজতে কাঁদছে।
শোভনের হাতের নীল শাড়িটা ভিজে গেছে। শোভন জানে, এই শাড়িটা পরে মিরা কোনো দিন ও আর তার সামনে এসে বলবে না যে, দেখোতো আমার শাড়ির কুঁচি গুলো ঠিক আছে কিনা!
শোভন জানে, একদিন হয়তো মিরাও সবটা ভুলে যাবে। দুজনের কারোরই হয়তো আর কখনো কারো প্রতি কোনো টান থাকবেনা, থাকার মধ্যে রয়ে যাবে কেবল স্পর্শ।
কেউ এক জনমেও কাউকে ছুঁয়ে দিতে পারেনা।
আবার কেউ কেউ ছুঁয়ে দিয়ে যায় এক মুহুর্তেই।