মির্জা গালিবকে ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক মানুষদের অন্যতম মনে করি:জাভেদ হুসেন

  
    

আতিকুর রহমান শুভ: তাঁর নিজের ভাষায় ‘আমি জন্মেছি কুমিল্লা শহরে।ব্যবস্থাপনায় একাডেমিক পড়ালেখা। সোভিয়েত পরবর্তী সক্রিয় মার্কসীয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি। জগত সংসার ইতিহাস মানুষের সভ্যতা ̶  এই সব নিয়ে নিজের বোঝাপড়ায় যা কিছু আসে, যারা এক্ষেত্রে আমাকে সহযোগিতা করেন, তাঁদের সঙ্গে বাকিদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি নিজে লিখে’। আমরা জানি তিনি লেখালেখি করেন, অনুবাদ করেন। তিনি যতোটা সুন্দর করে লেখেন ঠিক ততোটা সুন্দর করে বলেনও। অনেকদিন ধরে তাঁকে শুনছি ও পড়ছি। লালন, রবীন্দ্রনাথ, মান্টো, গালিব, এঙ্গেলস এমনকি কেরানীগঞ্জের খালেক দেওয়ানও বাদ যায়নি তাঁর বিষয় থেকে।
অপরিসীম মুগ্ধতা থেকেই প্রশান্তিকার পক্ষ থেকে কথা বলেছি গুণী এই মানুষ জাভেদ হুসেনের সাথে। পড়ুন সেই আলাপের কিছু অংশ।

প্রশান্তিকা: আপনার নিজের সম্পর্কে জানতে চাই।
জাভেদ হুসেন: আমি জন্মেছি কুমিল্লা শহরে। ১৯৭৬ সালে। বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবস্থাপনায় একাডেমিক পড়ালেখা আমার। সোভিয়েত পরবর্তী সক্রিয় মার্কসীয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি। আবৃত্তি সংগঠন, অনেক ধরণের পাঠচক্র, পত্রিকা বের করা এইসবের মধ্য দিয়ে বয়স বেড়েছে। আমি সাধারণের চাইতে ভালো পাঠক। জগত সংসার ইতিহাস মানুষের সভ্যতা ̶  এই সব নিয়ে নিজের বোঝাপড়ায় যা কিছু আসে, যারা এক্ষেত্রে আমাকে সহযোগিতা করেন, তাঁদের সঙ্গে বাকিদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি নিজে লিখে।

গালিবের কবিতা উর্দুভাষীদের কাছেই ছিলো জটিল-জাভেদ হুসেন।

প্রশান্তিকা: এবার বইমেলা সহ এপর্যন্ত কোন কোন বই বের হলো আপনার? নতুন বই সম্পর্কে জানতে চাই।
জাভেদ: এবার মেলায় দুটো বই আসছে। একটা বের হয়ে গেছে। মির্জা গালিবের গজল। এতে সাড়ে পাঁচশত শের বা পংতির অনুবাদ আছে। সঙ্গে মূল কবিতা বাংলা বর্ণে দেয়া আছে সাথে। এই প্রথম বারের মতো মির্জা গালিবের ফারসি কিছু কবিতার অনুবাদ পাবেন বাংলা পাঠকেরা। গালিবের কবিতা খোদ উর্দুভাষীদের কাছেই জটিল বলে খ্যাত। কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে তিনিই আবার উর্দু কাব্যে সবচাইতে জনপ্রিয় কবি। অন্য ভাষার মানুষের কাছেও তিনি একাই বলতে গেলে উর্দু কবিতার প্রতিনিধিত্ব করেন। এই অদ্ভুত বৈপরিত্বের কারণ কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন পাঠক এই সংকলন থেকে। ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক মানুষদের একজন বলে তাঁকে মনে করি। সেই বিষয়ে সামনে লেখবার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

দ্বিতীয় বইটি হচ্ছে বাংলাদেশের উর্দু কবি আহমদ ইলিয়াসের নির্বাচিত কবিতা। তিনি ১৯৫০ সালে কলকাতা থেকে আজকের বাংলাদেশে আসেন। প্রবাদতূল্য কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের ঘণিষ্ঠ ছিলেন। ফয়েজের কাব্যধারার ধারাবাহিকতায় কবিতা লিখেছেন। আজন্ম প্রগতিশীল রাজনীতির লোক। সর্বভারতীয় প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের যে ক’জন বেঁচে আছেন তার মধ্যে তিনি একজন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। দেশভাগের পর যে উর্দু সাহিত্য গড়ে উঠেছে ইলিয়াস তার ধারাবাহিকতা। দেশভাগ বা পার্টিশন লিটারেচরের একটি সংযুক্তি বলা যায় তাকে।

প্রশান্তিকা: একটি বক্তব্যে আপনি বলেছেন, বৈষ্ণব ও রবীন্দ্রনাথ বাঙ্গালী জাতির অগ্রনায়ক আর এই কারনে আপনার নিজের বাঙ্গালী জীবনও সার্থক। ব্যাখ্যা চাই।
জাভেদ: সব সময়ই বলি যে বাংলা কবিতা বিশ্ব সাহিত্যে যে সংযোজন দাবি করতে পারে এর অন্যত্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বৈষ্ণব পদাবলি। রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষীদের একটি ধারার আধুনিক কালপর্বে এসে পরিণতি পেয়েছে। এতো বিপুলভাবে আর কেউ একা এতো বড় হয়ে বাংলা সাহিত্যে আসেননি। এই বিস্তৃতি আর বিপুলতা এখনো অনেককে অসহায় করে দেয়। কেউ নতুন সুরে তাঁকে গাইছেন, কেউ সেই নতুনে অস্বস্তি বোধ করে বিরক্ত হচ্ছেন। মোদ্দা কথায়, তিনি এখনো বিপুলভাবে সজীব। এর জন্য আমাদের নিজেদের বর্তমানের স্থবিরতাকে দায়ি করবো না কি তাঁর বিপুলত্বকে  ̶  সেই আলোচনা হলে একটা উত্তর পাওয়া যেতে পারে।

আর বৈষ্ণব পদাবলি নিয়ে এটা বলি এ কারণে যে বাংলার ভাবনার মূল বৈশিষ্ট মানুষ সংলগ্নতা। আমাদের দর্শনও মানুষকে ঘিরে বেড়ে উঠেছে। অধিকাংশ ভাষার কাব্যে ভাবনার সুক্ষতা তুলে ধরতে মানুষ পার হয়ে কোন পরমের আশ্রয় নিতে হয়েছে। কিন্তু পদাবলি নেহাত মানুষকে আশ্রয় করেই এমন সুক্ষ্ণ অনুভূতির জগত গড়ে তুলেছে যে এতে বিস্ময়ের অবধি পাওয়া যায় না।

প্রশান্তিকা: আপনি যখন কোন বক্তব্য রাখেন তখন অসংখ্য রেফারেন্সও দিতে পারেন, শুধু তাই নয়, ওগুলো কখনও ফার্সী, উর্দু বা হিন্দি হলেও অনর্গল বলতে পারেন। রেফারেন্স বা শের মনে রাখা বা বৈচিত্র ভাষার দখলটা কিভাবে হলো আপনার?
জাভেদ: এতে নিজের অজান্তে প্রবল ক্লেশ সহ্য করে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন কিছু উল্লেখ করতে পারি না। ভাষাগুলোর মাঝে এক সংযোগ থাকে। মানে একই ভাষাগোষ্ঠির মাঝে। যখন এই সংযোগগুলো খুঁজে পাওয়া শুরু হয় তখন এমন আবিষ্কারের আনন্দ আপনাকে পেয়ে বসবে যে আপনি টেরই পাবেন না কখন পথ পার হয়ে যাচ্ছেন। এই পথে সেই আনন্দই একমাত্র সম্বল। জবরদস্তিতে কোন লাভ হবে না। আর বিভিন্ন রেফারেন্স বা কবিতা মনে থাকে। আমি কখনো একটা লাইনও মুখস্থ করিনি। যা ভাল লাগে, বিস্মিত শিহরিত করে, তা আপনিই মনে থেকে যায়। তেমন ভালো কবিতার লাইন, কোন অনুচ্ছেদের গঠন, শব্দ প্রয়োগ, শব্দের ক্রমে এমন নিখুঁত হয় যে এর দিকে একটু মনোযোগ দিয়ে তাকালেই বুঝবেন এর অন্যথা হলেই এর সৌন্দর্যের কিছুই বাকি থাকবে না। এটা বুঝতে পারলে সেটা ভুলে যাওয়ার সুযোগ থাকে না।

জাভেদ হুসেনের কয়েকটি গ্রন্থ

প্রশান্তিকা: অনেকেই জাভেদ হুসেনের বই পড়তে ভালোবাসেন, জাভেদ নিজে কার বই পড়েন?
জাভেদ: এখন মনে হয় আর আলাদা করে বই পড়ি না, বিষয় পড়ি। একদম আটপৌরে সহজ জীবনের মধ্য দিয়ে কেমন করে অনেক বড় অনূভব চমকে দিতে পারে তা শুধু একজনের লেখায় পড়লে আটকে যেতে হবে। বিভূতিভূষণ থেকে তারাপদ রায়ে, সঙ্গে অবনীন্দনাথ ঠাকুরের বুড়ো বাংলায় … আরো কোথায় যে একে পাওয়া যাবে, আরো কতো যে এমন লেখা হবে ̶  কে জানে! আমি গোয়েন্দা কাহিনীর ভক্ত। শার্লক হোমস আমার খুব প্রিয়। কমপ্লিট হোমস আমার কাছে ৮ রকমের সংস্করণ আছে। আর যে কোন রকমের আত্মজীবনী আমার খুব প্রিয়। যত পুরোনো ততো ভালো। আগের মানুষদের জীবনকে একটা মিশন মনে করার প্রবণতা ছিলো। এটা আমাকে আকর্ষণ করে। আর প্রিয় হচ্ছে ভুতের গল্প। সব চেয়ে বেশি বোধহয় এটাই পড়েছি। লেখার মধ্যে দিয়ে হাঁসানো যত সহজ, ভয় পাওয়ানো ততই কঠিন। কালে কালে যে কত রকমে সেই চেষ্টা করা হয়েছে, সেটা পড়তে আনন্দ পাই। ইতিহাসের বই আমার প্রিয়। বিশেষ করে অতীতের জীবনের প্রাত্যহিক কথা যাতে আছে। পদার্থবিদ্যায় সৃষ্টিতত্ত্ব, গণিতে অসীমের ধারণা  ̶  এগুলো আমার মারাত্মক আগ্রহের পাঠ।

প্রশান্তিকা: আলাপটা আরও দীর্ঘায়িত করা যেতো, কিন্তু আপনার ব্যস্ত সময়ের কথা ভেবে এখানেই ইতি টানছি। আপনাকে প্রশান্ত পাড়ের বাংলা কাগজ প্রশান্তিকার পক্ষ থেকে অজস্র ধন্যবাদ।
জাভেদ: আবার কখনো আড্ডা হবে নিশ্চয়ই। আপনাকে ও প্রশান্তিকার পুরো দল এবং পাঠকদের ধন্যবাদ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments