আততায়ীর জবানবন্দি
আহমেদ শরীফ শুভ
কথা ছিলো তিনি লোকান্তরে গেলে মিশে যাবেন আমাদের ঘাসে ও মাটিতে, নদী ও পর্বতে; হয়তোবা কোথাও খুঁজে পাবো তার ক্লোন। আদতে হয়নি তেমন কিছু। ‘এক মুজিব লোকান্তরে লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে’ – নিছকই কথার কথা, শ্লোগানের উত্তাপ। যদিও তাঁর ছবি ঘরে ঘরে শোভা পায়, একটিও মুজিব আসেনি আর এই অভাগা বাংলায়।
রাতের আঁধারে যারা লাল করেছিলো বত্রিশের সিঁড়ি, যদিও হায়েনা, মানুষের বেশে তারা ছিলো গুটিকয়। আমরা তো প্রতিদিন তাঁর খুনে লাল করে দেই পদ্মা ধলেশ্বরী। আজ কোটিতে গোনা আমরাও কি হায়েনার কম, মানুষের পরিচয়? ওরা নেমেছিলো রাতের আঁধারে গোপন বর্ণচোরা। আমরা হলাম দক্ষ খুনি দিনের আলোয় ছুরি হাতে সব উৎসবে মাতোয়ারা। সুনিপুণ দক্ষতায় আমরা তাঁকে প্রতিদিন হত্যা করি অবলীলায়। বত্রিশের সিঁড়িতে নয়, সারা বাংলার শ্যামলীমায়।
আগষ্টের পনের কোন দিন নয়, প্রতীক কেবল। আমরা তাঁকে হত্যা করি প্রতিদিন শীতলক্ষার তীরে, জুমের পাহাড়ে। আমরা তাঁকে হত্যা করি রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে, মতিঝিলে শেয়ার বাজারে, সাঁওতাল পল্লীতে। তাঁর রক্তাক্ত দেহ মুখ থুবরে পড়ে থাকে রাষ্ট্রধর্মের অভিভাবকত্বে থাকা ধর্মনিরপেক্ষতার গোঁজামিলের সংবিধানে। তাঁকে আমরা হত্যা করি রাজনীতির ক্রমবর্ধমান বিরাজনীতিকরণে। এই ছাপ্পান্ন হজার বর্গ মাইলে প্রতিদিনই আসে পনেরই আগষ্ট, প্রতিদিনই তাঁর হত্যা দিবস।
আমরা তাঁকে প্রতিদিন হত্যা করি বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায়, প্রান্তজনের নাভিঃশ্বাসে। ষোল কোটি প্রকাশ্য ঘাতক তাঁর বুকে ছুরি চালিয়ে দেই ক্রমবর্ধমান সামাজিক বৈষম্যে, সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিস্তারে, দুর্বলের দুর্বলতর যাত্রাপথে। আমাদের ঘাসে ও মাটিতে, হাওড়ে ও বিলে তাঁর ঘ্রাণ ক্রমেই ম্লান হয়ে আসে চাটুকার আর ‘চাটার দলে’র লুটপাটের মহোৎসবে। আমরা তাঁকে প্রতিদিন হত্যা করি সংখ্যার বিভাজনে, নদী আগ্রাসনে। তাঁর কফিনে পেরেক ঠুকি শিক্ষাব্যবস্থার অসুস্থ বানিজ্যিকিকরণে, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ আর স্বাস্থ্যসেবা সাম্রাজ্যবাদের পদতলে অসহায় আত্মসমর্পণে।
ব্যক্তি মুজিবকে আদর্শের মুজিব থেকে বিযুক্ত করে তাঁর মিনিয়েচার ছবি অহর্নিশ ঝুলিয়ে রাখি নিজেদের আত্মপ্রচারের পোষ্টারে। কোথাও মুজিবের ক্লোন নেই, ঘরে ঘরে আছে তাঁর ছবি, আবক্ষ ভাষ্কর্য মহাসড়কের মোড়ে।
আমাদের ঘরে ঘরে মুজিবের ছবি। অন্তরে মোশতাক, তাহের ঠাকুর।