১৯৭১ সাল। রক্তক্ষয়ী ৯ মাসের যুদ্ধে বীর বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে মুক্ত করেছিলেন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আমরা হারিয়েছি ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম ও আত্মত্যাগ এবং অসংখ্য বুদ্ধিজীবির প্রাণ। ঘৃণাভরে ধিক্কার জানাই পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর ঘাতকদের। বিজয়ের এই মাসে আমরা প্রশান্তিকায় শ্রদ্ধা জানাই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি মাত্র ২০ বছর বেঁচে থাকা দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত তাজা প্রাণ শহীদ রুমীকে।
শাফী ইমাম রুমী
পুরো নাম শাফী ইমাম রুমী হলেও তিনি পরিচিত ছিলেন শুধু রুমী নামে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বড় পুত্র রুমী ছিলেন একাত্তরে একজন গেরিলা যোদ্ধা। একাত্তরে ঘাতকেরা নির্মম ভাবে রুমীকে হত্যা ও গুম করে। ৩০ আগস্ট ১৯৭১ থেকে রুমী বা রুমীর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। হয়তো বধ্যভূমিতে নাম জানা বা না জানা অসংখ্য দেশপ্রেমিকের লাশের মধ্যে রুমীর দেহও ছিলো। ছেলে শহীদ হওয়ার কারনেই জাতি তাঁর মাকে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বলে ডাকেন।
জন্ম: ১৯৫১ সালের ২৯ মার্চে সিলেটে। বাবা শরীফ ইমাম ও মা জাহানারা ইমাম। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে রুমীর জন্ম।
শিক্ষা: ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন রুমী। আইএসসি পরীক্ষার ভালো রেজাল্ট করে ১৯৭১ সালের মার্চে রুমী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। নিজের ইচ্ছেয় অনুমতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টে ক্লাস করতেন। আমেরিকার ইলিনয় ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে চান্স পেয়েও যুদ্ধের কারনে যাননি। দেশের সেই ক্রান্তিলগ্নে লেখাপড়া করে মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়াটা রুমীর কাছে বড্ড ‘সেকেলে’ মনে হয়েছিলো। মায়ের কাছে তাই সে বিদেশে পড়তে যাওয়ার বদলে অনুমতি ভিক্ষা করে যুদ্ধে যাওয়ার। তিনি ছিলেন তুখোড় তার্কিক।
১৯৭১: মায়ের অনুমতি নিয়ে যোগ দেন গেরিলা যুদ্ধে। একবার ধানমণ্ডি রোডের অপারেশনের পর রুমী তার সহকর্মীদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট রাতে তিনি বেশকিছু গেরিলা যোদ্ধার সাথে তার নিজের বাড়িতে কাটান এবং ওই রাতেই গেরিলা বন্ধুরাসহ রুমী পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। হানাদার বাহিনী আলবদর রাজাকারদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বেশ কিছুসংখ্যক যোদ্ধাকে গ্রেফতার করেন যার মধ্যে ছিলেন আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারাক, আজাদ ও জুয়েল। রুমীর সাথে তার বাবা শরীফ এবং ভাই জামীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের স্থানে রুমীকে ভাই ও বাবাসহ একঘরে আনলে রুমী সবাইকে তার যুদ্ধে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করতে বলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, পাক বাহিনী তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন এবং এর সব দায়-দায়িত্ব তিনি নিজেই নিতে চান। নিজের ঘাড়ে সব দায় নিয়ে বাবা ও ভাইকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা রুমীই করেছিলেন। এরপর ৩০ আগস্টের পর রুমী ও তার সহযোদ্ধা বদী এবং চুল্লুকে আর পাওয়া যায়নি।

জননীর একাত্তরের দিনগুলিতে রুমী: জাহানারা ইমামের গুরুত্বপূর্ণ বই ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটিতে তাঁর সন্তান রুমীই প্রধান চরিত্র হিসেবে দেখা দেয়।ট্রেনিং নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন রুমী, যোগ দেন গেরিলাযুদ্ধে। জাহানারা ইমাম লিখলেন, “রূপকথার চেয়েও রোমাঞ্চকর’সব কাহিনী; রক্ত পানি করা ট্রেনিং, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রূষার জন্য হাসপাতাল স্থাপন, তাদের অপারেশনের রোমহর্ষক বর্ণনা। পাক আর্মিদের চোখের পলকে ধরাশায়ী করে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া, কিংবা সেতু, পাওয়ার স্টেশন ইত্যাদি উড়িয়ে দেওয়ার গল্প শুনে গর্বিত হয়ে উঠি সেই সব গেরিলাদের জন্য যারা জানে, ‘কোন স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না; চায় রক্তস্নাত শহীদ।”
আগস্টের শেষের দিকে জননী লিখলেন, “রাজাকারদের গোপন তথ্যের ভিত্তিতে রুমী-জামী-শরীফদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তার হয় আরও অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে। উদ্ধার হয় বিপুল অস্ত্রশস্ত্র। সবার উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। এক সময় শরীফ-জামী-অন্যান্যরা বাড়ি ফিরে এলেও রুমী আর ফিরে আসে না।
জননী লিখে যান, ‘আকাশের বুকেও অনেক ব্যথা। তার কিন্তু আমার মতো চেপে রাখার দায় নেই।’
মৃত্যু: নিখোঁজ দিন ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্টকেই রুমীর মৃত্যুদিন হিসেবে পালন করা হয়।
আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা রইল শহীদ রুমী, তাঁর মা শহীদ জননী এবং তাঁর পরিবারের প্রতি।