কথাসাহিত্যিক, কবি, চিত্রী হেরমান হেস জগদ্বিখ্যাত তাঁর সিদ্ধার্থ উপন্যাসের কল্যাণে, যদিও ডেমিয়ান, স্টেপেনউল্ফ, বিনেথ দি উইল, কিংবা তাঁর নার্সিসাস অ্যান্ড গোল্ডমান্ড-এর তুলনায় সিদ্ধার্থ অনেকটাই সোজাসাপটা একহারা গড়নের লেখা। তাঁর বাবা জোহানেস হেস-এর ভারতে ক্রিস্টিয়ান মিশনারিতে কাজের সুবাদে শৈশবেই হেরমান হেসের মধ্যে ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী অমীমাংসা একটি বড় ধরনের প্রভাব ও অন্বেষাবৃত্তি তৈরি করে। পরবর্তীতে ধর্মতাত্ত্বিক জ্ঞান প্রথার সঙ্গে তিনি মোকাবেলা করেন ব্যক্তির উন্মোচনের মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া। হেস ধর্মীয় বোধের সঙ্গে শিল্পচৈতন্যের একটি সুসমঞ্জস ভারসাম্য গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে যান। তাঁর শিল্পজারণ ও নিজস্ব থিওলজিকেল ছটফটানির ফলিত রূপ তাঁর এই কবিতা ও চিত্রকর্ম।
হেরমান হেস ১৮৭৭ সনের ২রা জুলাই জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন, আর মৃত্যুবরণ করেন ১৯৬২ সনের ৯ই আগস্ট সুইজারল্যাণ্ডে।
কবি
নিশি আকাশের অগণন তারার ধুলা ঝরে পড়ে আমার ওপর
পাষাণ ভেঙে ছোটা জলের নহর আমাকে সুরের ইন্দ্রজালে বাঁধে- কেবল এই ভঙ্গুর ব্যথিত আমাকে!
আমাকেই ডাকে বর্ণেবর্ণে রচিত মেঘেদের মুসাফির
আলগোছে উড়েউড়ে যায় খোয়াবের আঞ্চল।
বসতভিটা নেই, নেই খামার বাড়ি
আমি পাই নি অরণ্যের অধিকার- আমার হাতে না আছে
শিকারের বনভূমি- অন্তর্লোকে যা আছে আমার,
তা কেবলই আমার।
পাহাড়ের পৈথান থেকে ছুটে আসা স্রোতস্বিনী ঝরনা লহরি
উদ্যতসঙ্গীন সমুদ্র সফেন,
পাখির পাখায় মুদ্রিত কল্লোলিত শিশুকাল-
সবই আমার- অনুরক্ত সন্ধ্যার বিষন্ন বিলোড়ন।
আর হৃদয়পাত সবই আমার জন্য- যে দৃশ্যের গভীর গোপনে
প্রেমের সুবাস বুনেছি।
দেবতার মন্দির আমার, ফেলে আসা ললিত কানন-
সব আমারই জন্য- স্বর্গের মিম্বরখচিত অনাগত কাল
অবধারিতভাবে আমার ধাম।
আমিই নির্ধারণ করি, সম্মুখবাদী প্রাণের মিনতি ও উৎসার,
প্রেম আনে মানুষ নিধির গৃহীত অভিজ্ঞান।
সকলে হুল্লোড়ে, শোরগোলে মজে-
কৃষিজীবী, নিকারী ও সওদাগর,
নাবিক আর রাখাল, আর বাগানী মিলে আঁকে রংধনু পরাগ
উদযাপন করে তারা অনাগত তোরণ।
কবি এক জাগে- একা ব্যথা শিহরণ!
নীলকণ্ঠ উজাগর পাখি- নির্ঘুম টলমল
মেন্দি গাছের সবুজ পাতা ভিতরে অনল।
কবর ভরে যায় তার, ফুলে ওঠে পুষ্পের পদভারে
উপরে কলরব- নিচে বাগানবাড়ি ক্ষরণের সম্ভারে!
English version: The Poet.
ইংরেজি তরজমা: জেইমস রাইট
ভার
দিনগুলো কী-যে ভারী!
একটুকরো আগুন নাই যে আমাকে একটু উষ্ণতা দিতে পারে
আমার সঙ্গে একবার হেসে উঠবার সূর্যও নিখোঁজ।
সবই অসংস্কৃত ইটপাথর
যা-কিছু দেখি বেবাক নিষ্প্রাণ দয়াহীন,
যারে ভালবেসেছি সে-ও একই গর্তের শিয়াল;
আকাশের ঝিকমিক তারাও যেন তারা নয়- পোতানো মুড়ি।
যে-মুহূর্তে আমার মন বুঝে উঠতে পারে- ভালবাসা মরে
সেই ক্ষণ থেকেই চিত্রটি এমন স্থির।
English version: How heavy the days…
ইংরেজি তরজমা: জেইমস রাইট
ঘাসের বিছানায়
এই যে ঘাসের ঘটনা এভাবে ঘটছে-
সামনে হাওয়ার তবকে তবকে ছড়ানো ফুলের নির্ঘুম
কেমন এক ধুসরতা, স্নেহবতী নীল, নীলের প্রপাত
সে-কী কেবল দেবতার উৎসার- তার প্রাণের বয়ান?
দূর পাহাড়ে কী এক অভিমান
নীলের উঁচু সিথানে গরিমায় মাথা রেখে ঘুমায়-
এ-কী কেবলই শাসিত প্রকৃতির অন্তর্ঘাত, অচল গোঙানি?
আর কতো শত গ্লানি, কতো যে মালিন্য আকার
স্বপ্ন ছিনতাই, ক্ষরণ, ক্ষরণ- ভেঙে পড়া হৃদকৌটা।
ক্ষীণজীবী ঊনাকার সামান্য পোকার নৃত্য বৈঠক,
পাখির একাকী বিরহ ডাক তোমাকে দেয় শান্তির দুইদণ্ড
বাতাসের প্রসন্ন পালক তোমাকে ছোঁয়ায় আনমনা সুমধুর।
আমাকে একটু একা থাকতে দাও- একা।
আজ সব মাত্রাতিরিক, সীমা লঙ্ঘনকারী
দহন, অন্তর্দহন!
আর থামিও না- সবটুকু বিষ তাহলে মন্থিত হোক,
সবকিছু ভেঙে পড়ুক, যা-কিছু থাকে সবই ছিন্নভিন্ন হোক।
থাক, কেবল সামান্য ক্ষণের অতলটুকু থাক-
এই গ্রীস্মের সুমধুর একফালি ঘন্টা।
আসুক বৈঁচি ফুলের একচিলতে সুবাস।
না, নিও না-
আমার প্রাণের গহীনে আনন্দ মজমা তুলে নিও না!
English Version: Lying in grass.
ইংরেজি তরজমা: জেইমস রাইট
হেরমান হেস’র নিজের আঁকা ছবি দিয়ে অলংকরণ করেছেন হৃদয় চৌধুরী।
বদরুজ্জামান আলমগীর: কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক। ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।