মেঘের পরে রোদ্দুর – এস এম জাকির হোসেন

  
    

শেষরাত থেকে মুষলধারে ঝরছে। গুড়ুম! গুড়ুম! বাজ পড়ার শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো অমিয়র। ঘড়িতে তখন রাত তিনটা। তারপর থেকে এপাশ ওপাশ করেই বাকি সময়টা পার করলো সে। ইদানীং ঘুমের বেশ সমস্যা হচ্ছে তার। অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা। শূন্য ঘরে সময়টা যেন আর কাটে না, দু’টো ছায়ামূর্তি অনবরত তার চারপাশে হেঁটে বেড়ায়- এ-ঘর থেকে ও-ঘরে। অমিয় থম মেরে বসে থাকে। কিছুক্ষণ টিভি দেখে, তারপর শুতে শুতে রাত একটা। শুলেই কি ঘুম আসে! কখনও রাত আড়াইটা কিংবা তিনটা বেজে যায় আবার কোন কোন রাত হয়তো নির্ঘুমই কাটে।

ভারী বৃষ্টি কিছুটা কমে এলেও একেবারে থেমে যায়নি, তবে অফিসে তো যেতেই হবে। অমিয় প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটায় বাসা থেকে বের হয়। আজও তৈরি হয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো, তারপর নিচে নেমে এলো। বাসার সামনে হাঁটু সমান পানি। রাস্তায় দু-একটা রিকশা দেখা গেলেও যেতে রাজি হচ্ছিলো না কেউ। আজকাল রিকশাওয়ালাদের যে কী হয়েছ! কোথাও যেতে চায় না। বৃষ্টি আর রাস্তায় পানি না থাকলে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত হেঁটেই যাওয়া যেতো, কিন্তু এখন হেঁটে গেলে ভিজতে হবে। আবার অপেক্ষা।

আধঘন্টা অপেক্ষার পর অবশেষে একটা রিকশা পাওয়া গেল। বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখলো লোকে লোকারণ্য। বাস, ট্যাক্সি বা সিএনজি কিছুই নেই। মেজাজটা আরও খিঁচড়ে গেল। এমনিতেই সারাদিনই শহর জুড়ে যানজট, তার ওপর আজ বৃষ্টি হওয়ায় অবস্থা আরও খারাপ। দিনদিন আমাদের শহরটা যেন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে!

দেড়ঘণ্টা যুদ্ধ করে অমিয় অবশেষে অফিসে পৌঁছালো। অফিসে এক গাদা কাজ জমে আছে, লাঞ্চের আগেই শেষ করতে হবে। বিকাল তিনটায় এমডিসহ বনানীতে একটা মিটিং আছে। অমিয় চায়ে চুমুক দিতে দিতে কাজে ডুবে গেলো। হঠাৎ এমডি’র রুমে ডাক পড়লো তার-

– অমিয়, আজকের মিটিং এর সময়টা পিছিয়েছে। বিকাল পাঁচটায়। প্রয়োজনীয় পেপারস সহ তৈরি থেকো।

– জ্বী স্যার।

নিজের টেবিলে এসে ধপ করে বসে পড়লো অমিয়। মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেলো। আজ ঠিক করে রেখেছিল রূপার সাথে দেখা করতে যাবে, হলো না। বিকাল পাঁচটায় মিটিং শুরু হলে কখন যে শেষ হবে কে জানে! এক সপ্তাহ হল রূপা বাসা ছেঁড়ে চলে গেছে। মোবাইল বন্ধ, বাসার ল্যান্ড ফোনে ফোন করলে রিসিভ করে না। ভীষণ ক্ষেপেছে। বাসায় গিয়ে যে দেখা করবে তারও উপায় নেই। পুরা সপ্তাহজুড়ে অফিসে এত কাজের চাপ যে রাত এগারোটার আগে অফিস থেকে বেরুতেই পারেনি। চাকরিটা এবার সত্যিই ছাড়তে হবে দেখছি! আগে সংসার বাঁচাও, পরে চাকরি।

এমনিতে খুব শান্ত মেয়ে রূপা, কিন্তু রেগে গেলে ওকে সামলানো বেশ মুশকিল। এই যে বাসা ছেড়ে চলে গেছে, নিজে থেকে না আসলে ওকে ফেরানো সম্ভব নয়। যে করেই হোক রূপার মান ভাঙাতে হবে। তবে অমিয় জানে যে রূপা ওর উপর বেশীদিন রাগ করে থাকতে পারবে না। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময় ছয় বছর সম্পর্কের পর অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পেড়িয়ে রূপাদের পরিবারের সবার অমতেই ওদের এই বিয়ে। অনেকদিন থেকেই এই চাকরিটা ছাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলো রূপা, কিন্তু চাইলেই কি ছাড়া যায়? এই ট্রেডে যেখানেই চাকরি করুক, কাজের চাপ থাকবেই। অনেক বোঝালেও রূপা কখনই এই ব্যাপারগুলো বুঝতে চায় না।

বনানীতে মিটিং শেষ হতে রাত আটটা বেজে গেল। এখন আবার অফিসে ফিরে জার্মানিতে পুরা মিটিং এর ডিটেইল রিপোর্ট করে তবে বাসায় ফিরতে হবে। রাত কয়টা বাজবে কে জানে! রাস্তায় বেরিয়েই আবার সেই জ্যামের মুখে পড়লো। বনানী থেকে মহাখালী ফ্লাই ওভার দিয়ে ফার্মগেট হয়ে ধানমণ্ডি আসতে একঘণ্টা লেগে গেল। সব কাজ শেষ করে রাত এগারটায় অফিস থেকে বের হল। বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় বারোটা।

একা বাসায় কিছুই ভাল লাগে না অমিয়র। ভিতরটা বড় ফাঁকা লাগে। আজ এক সপ্তাহ ধরে মেয়েটাকে দেখে না। অমিয়র তিন বছরের মেয়ে আদৃতা। যত রাতই হোক, বাবা না ফেরা পর্যন্ত তার জেগে থাকা চাই-ই। অমিয় বাসায় ঢুকতেই কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সারাদিন মায়ের সাথে থাকেলেও ঘুমের সময়টাতে যেন বাবাকে না হলে তার চলে না। এ ক’দিন ধরে মেয়েটাকে না দেখে অমিয়র ভীষণ মন খারাপ হয়। বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো।

ঘুম ভাঙলো বেলা এগারোটায়। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো। আজ রূপার ওখানে যেতে হবে। যে করেই হোক বুঝিয়ে শুনিয়ে ওকে ফিরিয়ে আনতে হবে। বসকে বলে ছুটি নিয়েছে আজ। গোসল করে রেডি হয়ে বের হতে হতে প্রায় বারোটা বেজে গেলো। এই সময় রাস্তায় তেমন যানজট থাকে না। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে এসে ওর ভুল ভেঙ্গে গেলো। প্রচুর লোকের ভিড়, সেই তুলনায় বাসের সংখ্যা কম। পিড়াপিড়ি করে বাসে ওঠার চেয়ে একটা রিকশায় উঠে পড়লো অমিয়। রিকশায় চড়তেই ওর বেশী ভালো লাগে। একটা স্বাধীন স্বাধীন ভাব, বাতাস খেতে খেতে যেদিকে খুশি যাও, নিজের মত করে। আসাদ গেট এসে রিকশাটা ছেড়ে দিতে হলো, এই রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ। একটা খালি সিএনজি অটোরিকশা দেখে এগিয়ে গেলো-

– শান্তিনগর যাবে?

– যামু, দুই’শ টাকা লাগবো।

– দুই’শ টাকা কেন, তোমার মিটার নাই?

– মিটারে যাই না। অমিয়কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেল সিএনজিওয়ালা। যেন মিটারের কথা বলে সে মহা অন্যায় করে ফেলেছে।

আবার অপেক্ষা। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একজন দেড়শ টাকায় যেতে রাজি হল। আমিয় দেরি না করে উঠে পড়লো। শান্তিনগর মোড়ে এসে মিষ্টি ও কিছু ফল কিনে এগিয়ে চললো শ্বশুরালয়ের দিকে। দশ তলা ভবনের ষষ্ঠ তলায় সোবহান সাহেবের ফ্ল্যাট। অমিয়র অবশ্য খুব একটা আসা হয় না এখানে। বিয়ের পাঁচ বছর হলেও সোবহান সাহেব এখনো মন থেকে মেনে নিতে পারেননি অমিয়কে। অমিয়ও অবশ্য প্রয়োজন ছাড়া পা মাড়ায় না এদিকটায়।

– এক্সকিউজ মি! কোন ফ্ল্যাটে যাবেন? গেটের ভিতরে ঢুকতেই সিকিউরিটির লোকটা জিজ্ঞেস করলো। আগেরবার অমিয় এই লোকটিকে দেখেনি, সম্ভবত নতুন এসেছে।

– বি-৫
– আপানার নাম?

– অমিয়।

– একটু দাঁড়ান প্লিজ। সিকিউরিটি রুমে চলে গেলো লোকটি। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললো- যান। সম্ভবত ফোনে কথা বলে উপর থেকে সম্মতি নিয়ে এসেছে।

অমিয় লিফটে চলে আসলো। এই ব্যাপারগুলো ওর কাছে বিরক্তিকর লাগে। শ্বশুরবাড়ি আসতে যদি এত ফরমালিটিজ পালন করতে হয় তাহলে তো বিরক্তি আসারই কথা! ষষ্ঠ তলায় এসে কলিং বেল দিয়ে আবার বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা। অল্পবয়সী একটি ছেলে দরজা খুলে দিয়ে চলে গেলো। অমিয় অনেকক্ষণ বসে আছে ড্রয়িং রুমে। প্রায় পনেরো মিনিট পর আসলো রূপা। কিছুক্ষণ নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো। চেহারায় রাগ-অভিমান কোন কিছুরই প্রকাশ নেই।

– কেমন আছো?

– ভাল। অমিয়র দিকে না ফিরেই উত্তর দিলো রূপা।

কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। হঠাৎ অমিয়র দিকে ফিরে রূপা জিজ্ঞেস করলো,

– কেন এসেছো?

অমিয় হাসলো।

– আসবো না! বউ-বাচ্চা যেখানে আছে, ইচ্ছে না থাকলেও তো আমায় সেখানে আসতে হবে।

– বউ-বাচ্চা দিয়ে তোমার কি হবে? আমাদের নিয়ে কোন ভাবনা আছে তোমার?

– কী বলছো! তোমাদের নিয়ে আমি ভাবি না! তোমরা ছাড়া আর কে আছে আমার?

– আমাদের নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না, তুমি তোমার অফিস নিয়েই থাকো।

– তোমার ফোনটা অফ রেখেছ কেন?

– ইচ্ছে করেই। ফোন ব্যবহার করতে আমার ভাললাগে না।

– আমি প্রতিদিন কতবার তোমাকে ফোন দিয়েছি! বন্ধ পেয়েছি। তোমাদের ল্যান্ডফোনও ধরোনি।

– বলেছি না ফোনে কথা বলতে ভাললাগে না!

– আদৃতা কোথায়?

– নিপার সাথে বাইরে গেছে।

– রূপা, বাসায় চলো।

– না, আমি যাবো না, তুমি চলে যাও। বলেই ভিতরে চলে গেলো রূপা।

কিছুক্ষণ একা একা ড্রয়িং রুমে বসে থাকার পর বেরিয়ে পড়লো অমিয়।

একটু পরে রূপা ড্রয়িং রুমে এসে দেখলো অমিয় নেই। নিশ্চয়ই চলে গেছে! মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। কেন এত রূঢ় ব্যবহার করলো সে? জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, নেই! ব্যস্ত রাস্তায় মানুষের ভিড়ে চোখে পড়ার কথাও না। এই দুপুরবেলা ও না খেয়েই চলে গেল! মনে মনে ভাবলো- এই বাসায় কোনদিন ঠিকমতো আদর-যত্ন পায়নি ও। এ কারণেই পারতপক্ষে এদিকটায় আসতে চায় না। বাইরে যতই রাগ দেখাক, রূপা জানে অমিয়কে ও কতটা ভালবাসে!

দুপুরের কাঠফাঁটা রোদ্দুরে আবার রাস্তায় নামলো অমিয়। শান্তিনগর ছাড়িয়ে কাকরাইলের দিকে হাঁটতে থাকলো। বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজি, রিকশা, ভ্যানে রাস্তা গিজ গিজ করছে। যানজটে মানুযের জীবনযাত্রা দিনকে-দিন কঠিন হয়ে উঠছে। প্রচণ্ড গরমে অস্থির, এর মধ্যেই ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে বসে থাকা! বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ ছুটে চলেছে শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। বড় বড় অফিসের ব্যস্ত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া দিনমজুর পর্যন্ত। সবাই ছুটছে জীবিকার তাগিদে।

কাকরাইল মোড়ে এসে অমিয় ভাবতে লাগলো কোথায় যাওয়া যায়! ঠিক এই মুহূর্তে ওর কোন কাজ নেই। কাজ না থাকাও একটা সমস্যা। ফাঁকা বাসায় একা একা সময়ও কাটবে না। কিছু না ভেবেই একটা রিকশায় উঠে পড়লো।

রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করলো- কই যাইবেন?

– মতিঝিলের দিকে চলেন।

রিকশা ধীরে ধীরে এগুতে থাকে। রিকশাওয়ালা লোকটা বেশ বয়স্ক। রুগ্ন শরীর, বয়সের ভারে নূয়ে পড়েছে। প্রচন্ড গরমে দরদর করে ঘামছে।

– চাচা, আপনার বাড়িতে কে কে আছে?

– আমি আর আমার স্ত্রী।

– ছেলেমেয়ে নাই?

– তিনডা পোলা আছে, তারা যার যার সংসার নিয়া আছে।

– আপনারে দেখে না?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বৃদ্ধ বললো- না-রে বাবা। হেগো মা বিছনায় পইরা আছে, তা-ই একবার খোঁজ নেয় না! হেরা নাকি নিজেরাই চলতে পারে না, আমগো দেখবো ক্যামতে!

অমিয় আর কথা বাড়ায় না। খারাপ লাগে। কত বিচিত্র মানুষের জীবন! পলওয়েল মার্কেট পার হয়ে এলে রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান দেখে রিকশা থামাতে বললো। নিজে একটা বেনসন ধরিয়ে বৃদ্ধকে বললো- আপনি কি খাবেন খান। বৃদ্ধ লোকটি একটি রুটি আর এক কাপ চা নিলো।

চলেন এবার যাই; বলে আবার রিকশায় উঠে পড়লো অমিয়। রিকশা আস্তে আস্তে এগিয়ে চলছে মতিঝিলের দিকে। কিছুদূর এগুতেই ফোনটা বেজে ওঠলো। পকেট থেকে বের করতেই দেখলো- রূপা।

– হ্যালো!

– হ্যা, বলো।

– তুমি চলে গেলে কেন?

– তুমি কি থাকতে বলেছিলে?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে রূপা বলল- তাই বলে দুপুরবেলা এভাবে চলে যাবে?

– তুমিই তো চলে আসতে বললে!

– সেটা তো রাগ করে বলেছি, একবার আম্মুর সাথে দেখাও করবে না!

– অনেকক্ষণ বসেছিলাম। ভাল লাগছিলো না তাই চলে এলাম।

– এখন কোথায়?

– মতিঝিল, তুমি কি বাসায় যাবে?

– না।
ওপাশে আর কোন শব্দ নেই। অমিয় মনে মনে হাসলো; বরফ তাহলে গলতে শুরু করেছে!

রিকশা মতিঝিলের কাছাকাছি চলে আসলো। অমিয় সেনাকল্যাণ ভবনের সামনে নেমে পড়লো। মনে মনে ভাবলো- ফারুক ভাইকে কি এখন পাওয়া যাবে! দেখিই না যেয়ে একবার।

অনেকদিন পর ফারুক ভাইয়ের অফিসে আসলো অমিয়। প্রায় দু’বছর হবে। অফিসটা নতুন করে ডেকোরেশন করা, আগের থেকে অনেক সুন্দর। ফারুক ভাইকে অফিসেই পাওয়া গেলো। অমিয়কে দেখে বেশ অবাকই হলেন ফারুক ভাই।

– আরে! আমাদের অমি বাবু যে! তুমি তো আজকাল ডুমুরের ফুল হয়ে গেছো।

– না ফারুক ভাই, প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকি, তাই আসা হয় না। কেমন আছেন?

– আমি ভাল আছি। আমাকে কখনো খারাপ থাকতে দেখেছো?

অমিয় হাসলো।

– তা, তোমার খবর কি? ফারুক ভাই জিজ্ঞেস করলেন।

– ভাল। আপনার অফিসটা আগের থেকে অনেক সুন্দর করে সাজিয়েছেন।

– এই তো মাস ছয়েক আগে নতুন করে ডেকোরেশন করিয়েছি। বাইরে চকচকে না হলে ক্লায়েন্টরা আসতে চায় না।

– এখন বেশ ভাল লাগছে।

– রূপা কেমন আছে? তোমার মেয়েটা?

– ভাল।

– কি খাবে?

– অনেকদিন এদিকটায় আসা হয়না, ঘরোয়ার বিরানী খাওয়া যেতে পারে।

অমিয়র মনে পড়ে এই অফিসে বসে কতদিন ঘরোয়ার বিরানী, খিচুড়ি খেয়েছে! ফারুক ভাইয়ের অফিস ছিলো ওদের নিয়মিত আড্ডাখানা। অমিয়, মুবিন, সৈকত, মারুফ; সেই দুপুর থেকে শুরু করে রাত দশটা পর্যন্ত এখানেই আড্ডা চলতো ওদের। আজ একেকজন একেকদিকে চলে গেছে! চাকরি, ব্যবসা, সংসার নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মুবিন জাপানে সেটেল্ড হয়েছে।

ফারুক ভাইয়ের সাথে ইউনিভার্সিটিতে পরিচয়। অমিয়র তিন বছরের সিনিয়র, খুব মনখোলা মানুষ। মহসিন হলে একই রুমে থাকতো। খুব স্নেহ করতেন অমিয়কে, আদর করে বাবু বলে ডাকতেন। ভার্সিটি থেকে বের হয়ে ফারুক ভাই ব্যবসায় নেমে গেলেন। অমিয় সহ আরো কয়েকজনের কাছে তখন এই অফিসটা হয়ে গিয়েছিল ওদের আড্ডা দেয়ার কেন্দ্রস্থল। অমিয়র বিয়ের সময়ও অনেক সাহায্য করেছেন ফারুক ভাই। সে সময় উনি এগিয়ে না এলে হয়তো ওদের বিয়েটাই হতো না!

সাতটা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে ফারুক ভাইয়ের অফিস থেকে বের হলো অমিয়। অনেকদিন পর সন্ধ্যায় এদিকে আসলো সে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। অমিয় তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে মানুষের ঘরে ফেরার ব্যস্ততা। সবাই ব্যস্ত। অফিস-ফেরত মানুষের দল, ফুটপাতের দোকানদার, ভিক্ষুক- সবাই। অমিয়র কোন তাড়া নেই, তার জন্যে অপেক্ষা করে নেই কেউ। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটলো কিছুক্ষণ। সোডিয়াম লাইটের হালকা আলোয় অদ্ভুদ লাগছে শহরটিকে। সে হেঁটে চলেছে স্টেডিয়াম অঞ্চলের দিকে আর দেখছে বিচিত্র মানুষদের। এই আলো-আধাঁরিতে অনেক সময় মানুষ চেনা যায়।

কিছুক্ষণ পর মোহাম্মদপুরগামী একটি বাসে উঠে পড়লো অমিয়। পিঁপড়ার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাস। মৎস্য ভবনের মোড়ে এসে একেবারে স্থির হয়ে গেলো। প্রায় এক ঘন্টা লাগলো শাহবাগ পর্যন্ত পৌঁছুতে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজায় চাবি ঢুকাতে যাবে, এমন সময় ভেতর থেকে দরজা খুলে গেলো। ওপাশে দাঁড়িয়ে রূপা।

– কখন এসেছো?

– বিকেলে।

– দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো আদৃতা।

– বাবা, তুমি আমার কাছে আসোনি কেন? জানো! আমি তোমার জন্য কেঁদেছি।

– এই তো এসেছি বাবা, আমি তো তোমার কাছেই এসেছি।

মেয়েকে আদর করতে করতে অমিয় দেখলো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রূপা। অমিয় কাছে এসে দাঁড়ালো। রূপার মুখটা ওর দিকে ঘুরাতেই দেখলো- চোখ দু’টো চিক চিক করছে। দু’হাতে চোখ মুছিয়ে দিলো।

অমিয় হাসতে হাসতেই বললো- কী, আমায় ছেড়ে আর দূরে থাকবে?

নিঃশব্দে মাথা নাড়ালো রূপা।

অমিয় রূপাকে বুকে টেনে নিলো। অমিয়র বুকে মাথা রেখে রুপা খুঁজে পেলো নির্ভরতা।

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments