গল্প
মেঘ হারানো গ্রাম
মোহাম্মদ মারজিউল হক
বর্ষাকালে তিস্তার বুক ফুলে উঠে। বুক ফুলে উঠে পানিতে। সে পানিতে নৌকা ভাসিয়ে মাঝি স্বস্তি পায়। পাল তুলে দিয়ে গান ধরে, “মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে… আমি আর বাইতে পারলাম না…”। ভেসে ভেসে মাঝির দিন কেটে যায়। মাঝির বউ ঘর সংসারের কাজ করে। হঠাৎ কাজের ফাঁকে স্বামীর কথা মনে পড়লে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে আকাশ দেখে। আকাশ কালো দেখলে মনে মনে প্রার্থনা করে, “আল্লা, এখন যেন পানি না আয়। তেনারে সুস্থভাবে ফিরায়ে দেও”। তাও যদি বৃষ্টি চলে আসে তাহলে মাঝির বউয়ের ছটফটানি বেড়ে যায় কয়েকগুন। বার বার বিড়বিড় করে বলে, “পানি যে আরো জোরে আইলো! আল্লা, তেনারে সুস্থভাবে ফিরায়ে দেও, এই ফরিয়াদ জানাই”।
বদলায় ঋতু, বদলায় জীবনধারা, বদলায় প্রার্থনা।
বছর ঘুরে একসময় গ্রীষ্ম আসে। সূর্য তখন অতিষ্ঠ করে তুলে জনজীবন। শুধু তিস্তা না বাংলাদেশের সব নদীর বুক বিঘৎ বিঘৎ নেমে যায়। তিস্তাকে তখন দেখায় শঙ্করদহ গ্রামের সবচেয়ে বৃদ্ধ মহিলা, মরিয়মন্নেসার মতোই হাড্ডিসার, থুথ্থরে ও মৃতপ্রায়।
তিস্তা নদীর সেই মাঝির বউ এবার প্রার্থনা করে, “আল্লা, পানি দেও। গরমে থাকন যায় না। কতদিন ধইরা তিনি নদীর পানিত নৌকা ভাসান না। নদীর যে অবস্থা! পানি তো সব শ্যাষ! আল্লা, তাড়াতাড়ি পানি দেও”।
শঙ্করদহ গ্রামের বেশিরভাগ কৃষক বছরে নামাজ পড়ে শুধু চার মাস। যে দুই মাস মিলে গ্রীষ্মকাল, সেই দুই মাস আর যে দুই মাস মিলে বর্ষাকাল সেই দুই মাস। সারা গ্রীষ্মকাল তারা জায়নামাজে মাথা ঠুঁকে। মেঘ চায়, বৃষ্টি চায়। বর্ষাকালে পানি বাড়তে বাড়তে যখন জেলেপাড়ার গণেশ মাঝির বাড়ি ছুঁই ছুঁই তখন মসজিদে কৃষকদের আনাগোনা বাড়ে। জায়নামাজের ব্যবহার আবার শুরু হয় তোড়জোড়ের সাথে। কৃষকেরা মাঠে কাজে নামে টুপি মাথায়।
অনেক কৃষক অবশ্য বেশ ধার্মিক! সারাবছরই তারা থাকে ইবাদত বন্দেগী নিয়ে; ঋতু মানে না।
শুধু কি এই কৃষক, জেলে আর মাঝি? আরো কত কিছিমের মানুষ যে আছে শঙ্করদহতে তা বলে শেষ করা মুশকিল।
গ্রামের সবচেয়ে পশ্চিমদিকটা হলো হিন্দুপাড়া। সেখানকার দিনগুলো কাটে অন্যভাবে। বারো মাসে তেরো পার্বন। সন্ধ্যে হলে প্রত্যেক বাড়িতে একে একে বেজে ওঠে শঙ্খ।
দু’বছর আগে কী না কী নিয়ে দুই ধর্মের মানুষের মাঝে লেগে গেলো মারামারি। হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি হঠাৎই ঠুনকো এক কারণে রুপ নিলো শত্রুতার। পুলিশ এলো পরদিন। ততক্ষণে কত যে মায়ের বুক খালি হলো, তার হিসেব কেউ রাখেনি। গৃহস্থ বাড়ির বউ তিস্তার পাড়ে লুটিয়ে পড়ে কাঁদলো। শাঁখা বালা ভেঙে সিঁদুর মুছে ফেললো সেই তিস্তার পানি দিয়ে।
তারপর প্রশাসন আলোচনায় বসলো। অবশেষে একই গ্রামে নির্বাচিত হলো দুই মোড়ল। মুসলমান পাড়ার মোড়ল হলো সগীর উদ্দীন মিয়া। আর হিন্দু পাড়ার মোড়ল বিষ্ণু চাটুজ্যে। সেই থেকে শঙ্করদহ গ্রাম নামটা লেখা হয় শুধু কাগজপত্রে। গ্রামবাসীর কাছে এর দুই অংশ; দুই নাম: মুসলমান পাড়া আর হিন্দু পাড়া।
হিন্দু পাড়ার মধ্যে যে ছোট্ট বাজারটা পড়েছে তা হলো হিন্দু বাজার। হিন্দু বাজারে প্রতিদিন মানুষ জমে। বেঁচা কেনা জমে। কেউ সবজি কেনে, কেউ আলতা সিঁদুর কেনে, কেউ কেনে চাল-ডাল। আরো কত কী যে বেঁচা কেনা হয়!
বাজারের এক কোণে ছোটমতো একটা মিষ্টির দোকান অক্ষয়বাবুর। ক্যাশবাক্সের সামনে বসে ঝিমাতে ঝিমাতে দিন পার করেন। কাস্টমার আসে না। যেখানে মানুষের ভাতেই টান পড়ে, সেখানে আবার কার বাড়িতে মিষ্টির হাঁড়ি ঢুকবে?
অন্য সময় হলে তাও দু একজন কাস্টমার জুটে যায়। এখন তাও জুটবে না। এবছর খরা হয়েছে। প্রচন্ড খরায় মাটির বুক ফেঁটে চৌচির। ভাতের পাশাপাশি পানিরও টান পড়েছে। যে তিস্তার বুক ভরা পানি থাকে বাদলার দিনে, সে তিস্তার আজ পেট পড়ে গেছে। গ্রামে মেঘ করেনা অনেকদিন।
অক্ষয়বাবুর স্ত্রী বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন। তার এখন আপন বলতে এক মেয়েই শুধু আছে। মেয়েটার নাম পদ্মাবতী। সে স্কুলে যায়। শঙ্করদহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। বরাবরই ক্লাসে প্রথম হয়।
মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে অক্ষয়বাবুর বেশ আগ্রহ আছে। গ্রামের কত মানুষ বললো, “ও অক্ষয়, মাইয়াটারে যে ইসকুলে পাঠাও! কী বিত্তান্ত? ওত বড় মাইয়া বিয়া দেও না কেন? গ্রামের বেবাক মাইনসে কানাকানি করে”।
মানুষের কথায় অক্ষয়বাবু কান দেন না। তিনি চান, পদ্মাবতী ডাক্তার হবে।
এদিকে আজ সকাল থেকে মাইকিং হচ্ছে। গ্রামে জমজমাট এক বিয়ে হবে। না, এই মঙ্গার সময় কোনো মানুষের বিয়ে হবে না। বিয়ে হবে ব্যাঙের। বিষ্ণু চাটুজ্যে নিজ খরচে বিয়ে দেবেন। এই অঞ্চলে বহুকাল ধরে এই প্রথা চলে আসছে। যেবার যেবার বৃষ্টি হয় না, মঙ্গা দেখা দেয়, প্রতিবার ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করা হয়। হিন্দুপাড়ার বাসিন্দারা মনে করে, ব্যাঙের বিয়ে দিলে বৃষ্টি আসে। প্রতিবার তো এই ব্যাঙের বিয়ের কারণেই পুরো গ্রামটা খরার হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে।
ব্যাঙের খবর মুসলিম পাড়ায় যেতে সময় লাগলো না। সন্ধ্যা যখন আঁধারে নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে ব্যস্ত ভীষণ, সেই সময়টা। জামে মসজিদের ইমাম সাহেবের বাসায় বসে কথাটা তোলে মোড়ল সগীর উদ্দীন মিয়া। গলা একস্তর নামিয়ে ইমাম সাহেবকে বললেন, “হুজুর, আপনে কইলে আইজ রাইতের আন্ধারে ঐ বিষ্ণুর কাল্লা কাইটা নামায় দেই”।
ইমাম সাহেব তাঁর লাল দাঁড়িতে চিরুনীর মতো করে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, “শোনো মিয়াবাই, পাক কুরআনে এসেছে, `তোমার দ্বীন তোমার কাছে, আমার দ্বীন আমার কাছে’। এতবছর ধইরা হিন্দুপাড়ার বেবাক মাইনসে ব্যাঙ্গের বিবাহ দেয়। এইটা তাদের বিশ্বাস। আর তাছাড়া এতবছর থাইকা যখন তোমার কোনো সমস্যা হয় নাই তখন এইবার কী হইলো?”।
সগীর মিয়া চেয়ার টেনে নিয়ে ইমাম সাহেবের আরো খানিকটা কাছে গিয়ে বসলেন। আগের মতোই নামানো গলায় বললেন, “হুজুর, ব্যাপারটা বুইঝেন বালা কইরা। প্রেত্যেকবার ব্যাঙের বিবাহ দেয় গেরামের মাইনসে। আর এইবার মঙ্গা হইছে বেশি। এইবার বিবাহ দিবো ব্যাটা বিষ্ণু মোড়ল। দশ গেরামের লোক আইবো বিবাহ দেখতে। পেপারে ছাপা হইবো। মাইনসে ভাববো, ব্যাঙের বিবাহ দিলে সত্য সত্যই বুঝি বৃষ্টি আয়। তারপর কী হইবো? আস্তে আস্তে একগেরাম দুইগেরাম কইরা বেবাক গেরামে এই রীতি প্রচলন হইয়া যাইবো। ছি ছি ছি… কী লজ্জা! আমরা থাকতে কুফরি নাফরমানি দিয়া দেশটা ভইরা যাইবো!”
ইমাম সাহেব কী ভেবে যেন উদভ্রান্ত হলেন। ইতস্তত করে বললেন, “ইয়ে_ মানে_ আমার মনে সন্দ হয়, এইরকম কিছু হইবো না। আর যাই হউক, মানুষ মারন যাইবো না। আল্লাহ মাফ করো…”
সগীর মিয়া চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। দূরে তাকালেন; অন্ধকারের দিকে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, “কিছু না হইলে তো বালাউ। আল্লাহ যেন তাই করে”
মুসলিম পাড়ায় এ বিষয়ে আর সমবেত আলোচনা হয় না। যা হয় সন্তর্পনে, নিভৃতে। পুরুষ মানুষেরা যখন কাজ শেষে ঘরে ফেরে তখন এটা ওটা কথা বলতে বলতে হয়তো একবার ব্যাঙের বিয়ের কথাটাও তোলে গৃহবধু। এর বেশি আলোচনা হয় না।
হিন্দু পাড়ার মানুষেরা আঙ্গুলে তারিখ গোনে। খরায় পুড়ো গ্রামটা উজার হয়ে গেলো। মুসলিম পাড়ার সাথেই তিস্তা। একটু হলেও পানি তারা পায়। হিন্দু পাড়ার মানুষেরা তা পায় না। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। যেদিন ব্যাঙের বিয়ে হবে সেদিন কত খাবার মিলবে কে জানে! পোলাও, কোরমা, খাসির মাংসের রেজালা, গরুর মাংসের ব্যঞ্জন! আহ, কত দিন ধরে সুস্বাদু খাবার খায় না কেউ! সবাই আঙ্গুল গোনে। আঙ্গুল গোনে না শুধু পদ্মাবতী। ময়না পাখির খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে পদ্মাবতী বলে, “ও ময়না, ব্যাঙ্গের বিয়া হইবো। শুনছোস নি? হায় কুসংস্কার! যদি আমি বিয়াটা ভাঙ্গায়া দিতে পারতাম! বিয়ে ভাঙ্গার পরে যখন পানি আইতো তখন বেবাক মাইনসেরে কইতাম, `দেখছো, ব্যাঙ্গের বিয়া তো হইলো না। তাও পানি আইলো! আসলে ব্যাঙ্গের বিয়া দিয়া কিচ্ছু হয় না। আসল হইলো আবহাওয়া’ “।
ময়না পাখিটা কী বুঝে কে জানে। ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ডাকতে থাকে, “পদ্মাবতী… পদ্মাবতী”।
অক্ষয়বাবু পদ্মাবতীকে নিয়ে চিন্তায় আছেন খুব। মেয়েটা কী না কী করে বসে! বিয়েয় ব্যাঘাত হলে মোড়ল তো তাদের গ্রামছাড়া করবেন। তখন এই মা মরা মেয়েকে নিয়ে কোন গ্রামে, কোন নদীর তীরে ঘর বাঁধবেন তিনি? আর বাজারের ঐ ছোট্ট মিষ্টির দোকানটা?
পদ্মাবতী বোঝে না। বারবার বাবার কাছে এসে বলে, “আব্বা, বিয়াটা ভাঙ্গন যায় না?”
রাতে ঘুম আসে না অক্ষয়বাবুর। বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ান তিনি। আহারে, মাটি ফেঁটে একাকার গেছে! বৃষ্টি আসলে কী শান্তিটাই না হবে!
২.
পদ্মাবতী দৌঁড়ে এসে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো। তার নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “ও মাসি, আপনেরে ডাক পারে”।
বিষ্ণু চাটুজ্যের বড় বউ মাধবী চাটুজ্যে ঠাকুরঘরে বসে ছিলেন। তার সামনে ছিলো মেয়ে কুনো ব্যাঙ। মানে বিয়ের কনে। সেদিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই তিনি বললেন, “কে ডাক পারে?”
“বাবুর্চি। কইলো জরুরী দরকার।”
“কিন্তু, কন্যা যে একলা। কন্যারে একলা রাইখা কেমনে যাই?”
“মাসি, চিন্তা কইরেন না। আমি আছি। আপনে যান।”
মাধবী পুরোটা আশ্বস্ত হতে পারলেন না। তবুও তিনি বললেন, “আইচ্ছা। খেয়াল রাখিস।”
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। শাড়ির আচলটা মাথায় তুলে দিলেন। তারপর কী যেন বিড়বিড় করতে করতে বের হয়ে গেলেন।
সবকিছু পরিকল্পনা মতোই এগুচ্ছে। পদ্মাবতীর পরিকল্পনা অনুযায়ী, ব্যাঙটাকে এখন ঠাকুরঘরের জানালা দিয়ে বের করে দিতে হবে। প্রচন্ড এই খরার সময় গ্রামবাসী আর কোনো ব্যাঙ পাবে না। কাজেই বিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর যখন ব্যাঙের বিয়ে না হওয়ার পরেও মেঘ আসবে গ্রামে; নামবে বৃষ্টি, তখন পদ্মাবতীর সবার সামনে সত্য কথাটা জানাবে। তার সাথে জানাবে, কেন বৃষ্টি হয়, কখন বৃষ্টি হয়, বৃষ্টির সাথে ব্যাঙের বিয়ের অসামঞ্জস্যতা ইত্যাদি ইত্যাদি।
পদ্মাবতী প্রথমে ঠাকুরঘরে রাখা দেবীমূর্তিকে প্রনাম করলো। তারপর ব্যাঙটাকে তুলে নিয়ে জানালা দিয়ে বের করে দিলো। এমন সময় একটা ভাঙ্গা ভাসমান কন্ঠ পদ্মাবতীর কানে এলো। কেউ একজন বললো, “ও পদ্মা!…”
একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো পদ্মাবতীর শিরদাঁড়ায়। সে পেছনে ফিরলো।
আধঘণ্টার মধ্যে একটা মিটিং বসলো চাটুজ্যের বাড়ির দাওয়ায়। দাওয়ার ওপরে বসে বসে ঘড়ঘড় করে হুক্কা টানেন বিষ্ণু চাটুজ্যে। গ্রামবাসীরা সব সামনের উঠানে বসে থাকে। কারো মুখে কোনো কথা সয় না। শুধু খানিকক্ষণ পরপর অক্ষয়বাবু মেয়েদের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদেন। গ্রামবাসীরা আড়চোখে তার দিকে তাকায়। কেউ কেউ কানাকানি করে।
চাটুজ্যে বিরক্ত হয়ে বললো, “আহ! কান্দাকাঁটি কইরা লাভ নাই। আমার ফতোয়া মানতে হইবো। অক্ষণ বাড়িত যাও। কাইল তোমার মাইয়ার বিয়া হইবোই হইবো।”
গ্রামবাসীরা কিছুক্ষণ কানাকানি করলো। হিন্দু বাজারের ত্রিপল বিক্রেতা অশোক খানিকটা গলা উঁচিয়ে বললেন, “জ্বে, ঠিক। একজনের জন্য পুরা গেরামবাসী কষ্ট পাইবো, এইটা হইতে পারে না। কন্যারে যখন পদ্মায় খেদাইছে তখন ব্যাঙ্গের সাথে বিয়া ঐ পদ্মারই হইবো।”
গাছের আড়াল থেকে কয়েকজন ছোট ছেলে মেয়ে সভা দেখছিলো। ব্যাঙের সাথে পদ্মাবতীর বিয়ে হবে শুনে তারা ছুঁট লাগালো। খবরটা পদ্মাবতীর কানে পৌঁছে দিতে হবে তো। কত বড় সর্বনাশ হতে চলেছে মেয়েটার!
যে পাশটায় মহিলারা বসে ছিলো সেখানে বেশ একটা কোলাহল শুরু হলো। একজন মহিলা দাঁড়িয়ে বললেন, “চাটুজ্যে মশাই, এইরম কাজ করিয়েন না। একটা মাইয়ার জীবন নষ্ট কইরা লাভ কী?”
তার কথায় অধিকাংশ মহিলাই সায় দিলো। বিষ্ণু মোড়ল হুক্কা টানা বন্ধ করে দিয়ে চোখ কটমট করে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “এইডা কার বউ?”
একজন লোক দাঁড়িয়ে বললো, “জ্বে_ আমার।”
মোড়ল হুক্কা টানতে টানতে বললেন, “অক্ষণ তুমি বউ নিয়া বাড়িত যাও। নাইলে থাপ্পর দিয়া তোমার দাঁত ফালায়ে দেবো।”
৩.
মুসলিম পাড়ার মোড়ল সগীর উদ্দীন মিয়া, তার কাজের ছেলে কালু, জামে মসজিদের ইমাম সাহেব আর মুসলিম পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোখলেসুজ্জামান হিন্দু পাড়ায় প্রবেশ করলেন। ইমাম সাহেব রাস্তায় হঠাৎ থেমে গিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, “মিয়াবাই হকল, আমরা আল্লাহ পাকের কাছে সাহাইয্য চাই। তিনি বড়ই দয়ালু। আসেন, আমরা হাঁটতে হাঁটতে দোয়া ইয়নুস পাঠ করি। এই দোয়া পাঠ করিয়া ইউনুস নবি মাছের পেট থাইকা নাযাত পাইছিলেন।”
কালু ঘাঁড় চুলকোতে চুলকোতে বললো, “হুজুর, দোয়া ইউনুস তো স্মরণে নাই। এখন কী করি?”
“মসজিদে আইস মুখস্ত করায়ে দিমু। আপাতত কালেমা তায়্যেবা পড়।”
কালু মাথা নেড়ে সায় দিয়েই মুখ বিড়বিড় করতে লাগলো। সবাই আবার হাঁটতে শুরু করলো। সগীর মিয়ার আর যেনো তর সয় না। এতদিন পর তিনি বিষ্ণুকে বেকায়দায় ফেলবেন। ভাবতেই গা-টা যেন আনন্দে শিউরে উঠছে!
রাত বেশ ভালোই হয়েছে। টর্চের আলোকে রাতের অন্ধকার নির্মমভাবে গিলে খাচ্ছে! হাঁটতে হাঁটতে ইমাম সাহেব ভাবতে থাকে, আল্লাহ পাক রহম করো। ছোডো একটা মাইয়ার জীবনডা নষ্ট কইরা দিও না।
আর প্রধান শিক্ষক মোখলেসুজ্জামান ভাবতে থাকে, ইশ! কত টেলেন্ট একটা মেয়ে! তার আজ এই হাল!
তারা যখন গ্রামের সবচেয়ে পুরনো বট গাছটা অতিক্রম করলো তখনই ভেসে এলো কান্নার শব্দটা। সবাই পথ চলা থামিয়ে দিয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। তারপর একসাথে দৌঁড়তে শুরু করলো। দৌঁড়তে দৌঁড়তে একসময় তারা দেখলো একটা বিরাট জটলা। সেখান থেকেই ভেসে আসছে কান্নার শব্দ।
সগীর মিয়া জটলা ঠেলে মূল ঘটনাস্থলের দিকে এগোতে থাকলেন। পেছন পেছন এগোতে থাকলো অন্য তিনজন। টুপি পড়া মুসলমানদের দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলো অনেকেই। হিন্দু পাড়ায় মুসলমান!
এগোতে এগোতে একসময় সগীর উদ্দীন থমকে দাঁড়ালেন। থমকে দাঁড়ালো অন্যরাও। ইমাম সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নালিল্লাহি রাজিউন”।
একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেলো। অনেক দেরি হয়ে গেছে। মাটিতে শুয়ে পড়েছে পদ্মাবতীর দেহ! শুধু দেহ; আত্মা নয়!
পদ্মাবতীর গলায় মোটা দড়ির চাপে সদ্য সৃষ্টি হওয়া লাল একটা দাগ। অক্ষয়বাবু হাত পা আঁছড়ে আঁছড়ে কাঁদেন। এক বিন্দু জল জমা হয় ইমাম সাহেবের চোখের কোণেও। তিনি পারেননি বিয়েটা আটকাতে। অঘটন ঘটে গেছে।
আরো একবার দমকা হাওয়া বয়ে গেলো। হাওয়ার সাথে ভেসে যেতে থাকলো সন্তানহারা এক বাবার কান্না। ভেসে যেতে থাকলো দূরে; অন্ধকারের রাজ্যে। অক্ষয়বার বাবুর বুকের ভেতরের শূণ্যতা যেন মহাশূণ্যকেও হার মানাবে!
আকাশ ডেকে উঠলো। মেঘ এলো গ্রামে। এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা, তিন ফোঁটা…. তারপর মুষলধারে একটানা। বৃষ্টি পড়লো এতক্ষণে!
অক্ষয়বাবু কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার দিয়ে বললেন, “ওরে সর্বনাশা পানি রে, আইলি কেন এত দেরি কইরা? কেন আইলি দেরি কইরা? কেন আইলি?”
তারপর হঠাৎ টালমাটাল ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, “গেরামবাসী, ব্যাঙ্গের বিয়া তো হয় নাই। তাইলে বৃষ্টি আইলো কেন? বৃষ্টি আইলো কেন?”
কথাটা বলেই তিনি মাটিতে বসে আবারো কাঁদতে লাগলেন। আচানক বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খাঁচার ময়না পাখিটা ডেকে উঠলো, “পদ্মাবতী… পদ্মাবতী…”