হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে অতীত হাতড়ায় সোহাগ। হাতে স্যালাইন পুশ করা হয়েছে । স্যালাইন চলছে। অক্সিজেনও দিতে হয় মাঝে মধ্যে । তাই অক্সিজেন সিলিন্ডারটা সরানো হয়নি। দিন দুয়েক অজ্ঞান ছিল । জ্ঞান ফিরেছে তাও দু’দিন হলো। কিন্তু এ দু’দিনে বাবার খোঁজ পায়নি সে । মার দেখা যে পাবে না সেতো জানাই। এ জীবনে আর কখনও সে মার মুখটা দেখতে পাবে না ।
মা বাবার কথা মনে হওয়ায় বুক তোলপাড় করে কান্নার মাতম ওঠে! সেকী আর কোনদিন বাবার কাছে ফিরতে পারবে! বাবা কীভাবে তার খোঁজ পাবেন? কিভাবে জানবেন এ্যাক্সিডেন্ট করে সে হাসপাতালে আছে। আর এক সহৃদয় লোক তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছে! তার চিকিৎসা কিভাবে চলছে তাও জানে না সোহাগ। তবে শুনেছে যারা গরীব আর যাদের কোন আত্মীয় স্বজন নেই তাদের জন্য নাকি সরকারের তরফ থেকে একটা চিকিৎসা ফান্ড আছে। সে ফান্ডের পয়সাতেই দু:স্থদের চিকিৎসা হয়। হয়তো সেই পয়সাতেই চিকিৎসা চলছে।
এসব কথা অবশ্য সোহাগ আশেপাশের বেডের পেসেন্ট আর তাদের এ্যাটেনডেন্টদের টুকরো টুকরো কথা থেকে জানতে পেরেছে। এখনও সবকিছু ঠিকভাবে বুঝে ওঠার বা গুছিয়ে ভাবার মতো অবস্থা সোহাগের হয়নি। চিকিৎসকদের কাছে জেনেছে সে মাথায় বেশ বড় একটা আঘাত পেয়েছে। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে সে। বাসের চাকাটা তার মাথাটাকে চূর্ণ করার পরিবর্তে খানিকটা ধাক্কা দিয়ে গেছে! তাতেই এই অবস্থা!
কিছুক্ষণ আগে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গেছে নার্স । বলেছে, চুপ করে ঘুমাবার চেষ্টা করো। ঘুমাবার চেষ্টাই করছে সে। কিন্তু ঘুম যে কিছুতেই আসে না। বর্ষার প্লাবনের মতো ধেয়ে আসে স্মৃতির ঢেউ। বুঝতে শেখার পর থেকেই বাবা মায়ের হাসি মুখ কখনও দেখেনি সোহাগ। কখনও দেখেনি বাবা মাকে একসাথে বেড়াতে যেতে। বরং দু’জনের মাঝে সারাক্ষণই ঝগড়া লেগে থাকত। কখনও কখনও সে ঝগড়া চূড়ান্ত রূপ নিতো । মা ঝগড়া করতে করতে হাঁফিয়ে গিয়ে কেঁদে ফেলতেন একসময়। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতেন, : কী কুক্ষণে যে তোমার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল আর কেন যে আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম! আসলে তোমার ওই চেহারাটাই যতো নষ্টের গোড়া, মাকাল ফল একটা । অকম্মার ঢেঁকি।
: এখন কি আর আমাকে তুমি ভালবাসো না সুমি? তোমার সেই গভীর ভালোবাসা এতো অল্প সময়ে শেষ হয়ে গেল ? কিন্তু আমার অপরাধ কি?
: তোমার অপরাধ কি তা তুমি বোঝ না না? ন্যাকা একটা। মাস গেলে গোনা কয়েকটা টাকা হাতে পাও । মাসের শেষ না হতেই তা ফুরিয়ে যায় । তারপর খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত।
: কিন্তু আমিতো তোমাদের সুখে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। অফিসের পর টিউশনি করছি। আমি নিতান্তই সাধারণ মানুষ । মাস গেলে সামান্য কিছু উপার্জন। এসব কিছুতো জেনে শুনেই তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে।
: ভুল করেছিলাম , মারাত্মক ভুল ! নিজের সর্বনাশ করেছিলাম। আজ তাই সারাক্ষণ মাথার চুল ছিঁড়ছি ।
বাবা মায়ের হাত ধরার চেষ্টা করেছিলেন । ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়েছিলেন মা । বাবা তবুও মার পাশে বসেছিলেন । মা সরে গিয়েছিলেন। বাবা বলেছিলেন,
:তুমি অতো অধৈর্য হয়ো না সুমি । সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি ঠিকই ভাল কিছু করবো। তুমি আমাকে কিছুদিন সময় দাও ।
এবার মা এগিয়ে এসেছিলেন বাবার কাছে, বাবার হাত ধরেছিলেন। আদর মাখা কন্ঠে বলেছিলেন,
: দেখ তোমার জন্য আমার খুবই কষ্ট হয় । সারাদিন চাকুরি, তারপর আবার দু’ দুটো টিউশনি। সকাল হলে খেয়ে না খেয়ে ছোটা । এসবের দরকার নেই। তুমি বাবার ফ্যাক্টরিতে জয়েন করো। সব কষ্ট আমারে নিমিষে মিটে যাবে। রুমার বর জয়েন করেছে। কতো সুখে আছে ওরা। এই তো সেদিন ওরা নেপাল ঘুরে এলো।
:সুমি বুঝতে চেষ্টা করো। তোমার বাবার ফ্যাক্টরিতে জয়েন করলে আমার অর্থের কষ্ট কমবে কিন্তু মানসিক কষ্ট যে হিমালয়ের মতো আমার বুকে চেপে বসবে । আমাকে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে দাও। তোমার কাছে এটুকুই আমার চাওয়া । তোমার মনে নেই সুমি যেনি আমরা বিয়ে করে তোমার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। সেদিন তোমার বাবা কঠোর কন্ঠে র্ভৎসনা করে বলেছিলেন,
: বুঝি, সব বুঝি । আমার মিল কারখানা ফ্যাক্টরি বিষয় সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার জন্য আমার মেয়েটাকে ফুঁসলিয়ে বিয়ে করেছ। আমি সেদিন মাথা উঁচু করে উচ্চকন্ঠে বলেছিলাম, ‘আপনার ভুল ধারণা, আমি অর্থ সম্পত্তির লোভে আপনার মেয়েকে বিয়ে করিনি। বিয়ে করেছি ভালবেসে। আমি আর কোনদিন আপনার বাড়ির চৌহদ্দিতে পা রাখবো না।’ আজ যদি আমি তোমার বাবার ফ্যাক্টরিতে কাজ করি তাহলে আমার সেই উঁচু মাথা হেট হয়ে যাবে।
: থাকো তোমার উঁচু মাথা নিয়ে। আমরা থাকি না খেয়ে ।
: তোমাদের কষ্টে রেখেছি এ কথা ঠিক, কিন্তু না খাইয়ে রাখিনি। এতোটা অবিচার তুমি আমার উপর করো না।
: যা খেয়ে আছি ওকে কি খেয়ে থাকা বলে? আর খাওয়ার খোঁটা দিলে তুমি আমাকে। আর কখনও এ বাড়ির অন্ন আমি মুখে তুলবো না।
মা পাশের ঘরে গিয়ে ধ্রাম করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাবা অসহায়ের মতো রজার দিকে তাকিয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করেছিলেন। তারপর ভয়ে ভয়ে মাকে ডেকেছিলেন কয়েকবার। মা রজা খোলেননি, কথাও বলেননি। নিরূপায় বাবা অনেক রাতে সোহাগকে উঠিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছিলেন । সোহাগ কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না বাবা। মা না খেয়ে আছে, তুমি খাওনি । আমি খাবো না বাবা। বাবা, মাকি আর কখনও দরজা খুলবে না ?
: খুলবে বাবা , অবশ্যই খুলবে । দেখ সকালে আমি অফিসে যাবার আগেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসবে। একটু রাগি মানুষ, কিন্তু মনটা বড় ভাল । বাবা হেসেছিল । আর সেই মুহূর্তে গভীর আবেগে বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল সোহাগ ।
কিন্তু বাবার কথা সত্য হয়নি। সকালে দরজা খোলেনি মা। বাবা অনেক কাকুতি মিনতি করেছে।
: একটু বেরিয়ে এসো সুমি। তুমি বুঝতে পারছ না তুমি না বেরোলে সোহাগকে একা রেখে অফিসে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আর অফিসে না গেলে আমার ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে।
কিন্তু বাবার অনুনয় বিনয় কাকুতি মিনতিতে কোন কাজ হয়নি। অফিস টাইম পার হয়ে গেছে। দোকান থেকে পাউরুটি এনে অনেক কষ্টে ডিম ভেজে সোহাগকে খাইয়েছে বাবা। তারপর হঠাৎ করে সোহাগের দিকে তাকিয়ে বলেছে,
: সোহাগ তোর মার কোন সাড়াশব্দ নেই যে! কিছু হলো না তো! আমার কেমন ভয় করছে। তুই একটু ডাক বাবা।
সোহাগ দরজায় ক্রমাগত ধাক্কা দিয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করেছে,
: মা মাগো তুমি যদি না বের হও আমি কিছু খাবো না। আমি তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে মারা যাবো। তুমি কেমন মা ছেলের কান্নাতেও সাড়া দাও না!
বেশিক্ষণ কাঁদতে হয়নি। বেরিয়ে এসেছে মা। এসে বাঁজপাখির মতো ছোঁ দিয়ে তুলে নিয়েছে সোহাগকে
: কেঁদে কেঁদে কী চেহারা করেছে। না খেয়ে মুখ চোখ আমসি। নিষ্ঠুর বাপ ছেলেটাকে খাওয়ায়নি পর্যন্ত।
সোহাগ বলতে চেয়েছে সে খেয়েছে, বাবা তাকে পরম মমতায় খাইয়েছে রুটি সেঁকে নিজ হাতে। কিন্তু বাবার চোখের ইশারায় বলেনি। ভরা পেটে আর একবার খেতে হয়েছে তাকে।
এমন ঘটনা ঘটেছে প্রায়ই। আর এ সব ঘটনার মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠেছে সোহাগ। সোহাগ তার ওই অতোটুকু বয়সেই বুঝতে পেরেছে বাবা মার বিরোধের একটাই কারণ, অর্থ । তার বাবার অর্থ নেই। আর তার মা অনেক প্রাচুর্যের মধ্য থেকে গোনা টাকার সংসারে এসে খাপ খাওয়াতে পারছে না। খাপ খাওয়ানোর চেষ্টাও করছে না।
বাবা যখন অফিসে থাকতেন তখন মাঝে মাঝে সোহাগের রুমা খালা আসতেন। মূল্যবান শাড়ি গহনা পরে মূল্যবান গাড়ি থেকে নেমে কপাল কুঁচকে ঢুকতেন বাড়িতে।
: কী জঘন্য একটা বাড়িতে থাকিস আপু! দেয়ালগুলো ড্যাম্প , রং–এর বালাই নেই। আর কী কা– বাড়ির দরজায় একটা কলিংবেল লাগাতে কয় টাকা লাগে। আরে সর্বনাশ তুই যে ঘেমে নেয়ে একসার । একটা এসি লাগাতে পারিস না ঘরে।
এরপর একনাগাড়ে কথা বলতে শুরু করতেন রুমা খালা। বিদেশে কোথায় কোথায় বেড়ালেন, খালু কি কি কিনে দিলেন, আমিন জুয়েলার্স থেকে কি কি নতুন গয়না বানালেন এসব। সর্বশেষ যাবার সময় বললেন, এভাবে বাঁচা যায় না,আপু। অন্তত আমাদের বাড়ির মেয়েরা বাঁচতে পারে না। তোর সামনে পুরোটা জীবন পড়ে আছে। তারপর সোহাগের দিকে তাকিয়ে যেন হোঁচট খেয়ে বলতেন, একটা অসুবিধা বাধিয়ে বসেছিস। যাকগে ও কিছূ না। বড়লোকের ঘরে এসব কিছু না। আমার কথাগুলো ভাল করে ভেবে দেখিস আপু। বাবা মা কিন্তু তোর জন্য ভেবে ভেবে অস্থির। তুই ফিরে গেলে সব ভুলে বুকে তুলে নেবে !
কেন জানি রুমা খালাকে একটুও ভালো লাগতো না সোহাগের। যতোক্ষণ থাকতো মাকে শুধু খারাপ পরামর্শই দিতো। ওর মুখে কি ভাল কোন কথা নেই! মিলের কথা, আপসের কথা, ওকি শুধু বিচ্ছেদের কথাই বলতে শিখেছে!
রুমা খালা যেদিন আসতেন সেদিন খালা চলে যাবার পর থেকেই গুম হয়ে বসে াকতেন মা। আর বাবা এলে অকারণেই তার সাে শুরু করতেন ঝগড়া। শেষ ঝগড়া যেদিন হলো আর সেই ঝগড়ার রেশ ধরে মা যেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন সেদিনও রুমা খালা এসেছিলেন । বলেছিলেন,
:বুঝলে আপা, ুলাভাই যে বাবার ফ্যাক্টরিতে জয়েন করছে না এটা তার এক ধরণের গোয়ার্তুমি। সে আসলে বাবা মাকে ছোট করতে চায়। তোমাকে যি সে এই দারিদ্রের মধ্যে রাখে তাহলে সোসাইটিতে বাবা মার কি কোন মান থাকে তুমি বলো? বাবা খুব করে বলে পাঠিয়েছেন দুলাভাইকে ফ্যাক্টরিতে জয়েন করার জন্য। তুমি দুলাভাইকে বুঝিয়ে জয়েন করিয়ে ফেল। আর এ জঘন্য নোংরা স্যাতসেতে বাসাটা ছেড়ে আমারে বাসায় চলে এসো।
সেদিন বাবা অফিস থেকে আসার পর খুব সুন্দর করে চা বানিয়ে নিয়ে এলেন মা । সাথে মুড়ি ভাজা। পরিশ্রান্ত বাবা পরিতৃপ্তিভরে মুড়ি চিবাতে শুরু করেছেন এমন সময় মা বললেন,
: দেখ তুমি আর আপত্তি করো না। বাবা রুমাকে পাঠিয়েছিলেন তোমাকে ফ্যাক্টরিতে জয়েন করার কথা বলতে। বাবা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। কালই জয়েন করো।
:না, কখনই না
: কেন না শুনি, না কেন? কিসের এতো দেমাগ তোমার ।
এরপর শুধু শোনা গেল মার চিৎকার । আর সেই চিৎকারের মধ্যে একসময় বেরিয়ে গেলেন মা । আর ফিরে আসেননি। পরে অবশ্য সোহাগকে নিজের কাছে নেবার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাবা তাকে দেননি। মার চোখ থেকে ছেলেকে আড়াল করার জন্য বাসা বদলেছেন একের পর এক। সোহাগকে চুপিসারে স্কুলে দিয়েছেন যেন তার মা জানতে না পারে। এমন একটি বাসা এ্যাক্সিডেন্টের মাত্র আগের দিন বদলেছে সোহাগরা। তাই বাসার এ্যাড্রেস সে ঠিকমতো বলতে পারছে না। বলতে পারছে না বাবার অফিসের ঠিকানা। বাসা থেকে সামনের দোকানে চানাচুর কিনতে গিয়ে বাসের নিচে পড়েছিল সোহাগ।
সেদিন হাসপাতালে কয়েকজন সাংবাদিক এলো একজন অসুস্থ রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাৎকার নিতে। সোহাগ এখন বেশ সুস্থ। সে হাসপাতালের বেডে বসে টিভি ক্যামেরা আর সাক্ষাৎকার নেয়া দেখল । সাক্ষাৎকার নিয়ে সাংবাদিকরা যখন ফিরে যাচ্ছে তখন সোহাগ তাদের উচ্চস্বরে ডাকল । শুনতে পেয়ে একজন ফিরে তাকাল। ছোট একটা ছেলে ডাকছে দেখে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এলো ।
:একটু বসবেন। শুনবেন আমার কথা। আমার নাম সোহাগ । আমার বাবার নাম রফিকুল ইসলাম। বাবা চাকুরি করেন। কিন্তু বাবার অফিসের আর আমাদের বাসার ঠিকানা আমি জানি না। কিন্তু আমি বাবা মা মানে বাবার কাছে ফিরে যেতে চাই।
সাংবাদিক ছেলেটি তাদের টিমের লোকজনকে ডাকেন। পটাপট তোলা হয় সোহাগের বেশ কয়েকটি ছবি । পরদিন সকালে খবরের কাগজে ছাপা হয় সে ছবি আর সোহাগের খবর ।
দুপুর। নার্স এসে জ্বর দেখে চার্টে কিসব লিখে খাবার পর কি ওষুধ খাবে সেটা বলে দিয়ে গেছে । হাসপাতালের খাবার দিয়ে গেছে । সোহাগের পেটে আজ ভীষণ ক্ষিদে। সে যতো সুস্থ হয়ে উঠছে ততোই তার ক্ষিদে বাড়ছে । হাসপাতালের অন্য রোগিদের প্লেট গ্লাস আছে। নিজস্ব প্লেট গ্লাসে তারা খায়। সোহাগের কিছু নেই। সে হাসপাতালের ট্রেতেই খায়। আজও ট্রে টেনে নিয়ে খেতে বসে সোহাগের মনে পড়ে হাত ধোয়া হয়নি । তাছাড়া বোতলে এক ফোটা পানিও নেই। হাসপাতালের বেশির ভাগ পেসেন্ট মিনারেল ওয়াটার খায়। কিন্তু সোহাগ ট্যাপের পানিই খায়। বাড়িতেও তাই খেত । প্রথম দিকে মা–ই পানি ফুটাতো। মা চলে যাবার পর বাবা রাতে গ্যাসের চুলোর উপর কলসি বসিয়ে রাখতো। শেষরাতে সে কলসি নামাতো যাতে পানিটা ঠান্ডা হয়। অনেক কষ্ট করতেন বাবা। বাবার কথা মনে হওয়ায় চোখে পানি আসে সোহাগের। সাথে সাথে মনে পড়ে মায়ের মুখ । তার বয়সী শিশুরা বাবা মায়ের স্নেহ যত্নে কতো সুখে মানুষ হয়। তার জীবনটা কেন এমন হলো! সেকী আর কখনও পাবে বাবা মাকে একসাথে!
প্রচন্ড ক্ষুধায় পেট মোচড় দিচ্ছে। সোহাগ হাত ধুয়ে বোতলে পানি ভরে নিয়ে আসে। ট্রের ঢাকনা খুলে মন ভাল হয়ে যায় । আজ মাংস দিয়েছে । নিবিষ্ট মনে তরকারি দিয়ে ভাত মেখে ভাতের একটা লোকমা মুখে পুরতে যায়। ঠিক তখনই কে যেন ধরে তার হাত । হারিয়ে যাওয়া কোমল স্পর্শ আর কান্নার শব্দে ফিরে তাকায় সোহাগ। মা!
সোহাগ মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মা একটি একটি করে আঙ্গুর মুখে তুলে দিতে দিতে বলেন,
: কী আমার ভাগ্য! আমার একমাত্র সন্তান খাচ্ছে হাসপাতালের ট্রেতে ভাত । আর আমি খাই প্রতিদিন বাসমতি চালের ভাত । আমি যে কেন ..
মাকে কথা বলতে দেয় না সোহাগ । মায়ের বুকে মুখ ঘঁষে। চুমুতে চুমুতে মায়ের মুখ ভরে দেয়। সে চুমুর তোড়ে কথা হারিয়ে যায় । মা চোখে কান্না নিয়ে হাসেন। আমার পাগল ছেলে!
: তুমি আমাকে ছেড়ে আবার চলে যাবে না তো মা?
:না, কখনই না। আমি ভাবতে পারছিনে তুই বাসের চাকার নিচে পড়লে–। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন ! কিন্তু তোর বাবা লোকটা !
: বাবা খুব ভালো । ঠিক তোমার মতো।
পাশের বেডের এক বৃদ্ধা মহিলা এগিয়ে আসেন।
: কী তোমার মা এলো নাকি! তা মা আপনারা কেমন মানুষ ছেলেটাকে একটু দেখে শুনে রাখতে পারেন না। ও বাসের নিচে পড়ল কীভাবে?
:আমি চানাচুর কিনতে যাচ্ছিলাম দিদা।
:তুমি চানাচুর কিনতে গেলে আর তোমার মা তোমাকে একা যেতে দিল? এ কেমন কথা! তোমার বাবা না হয় তখন অফিসে ছিল কিন্তু তোমার মা? তুমি নিশ্চয়ই মাকে না বলে লুকিয়ে, ঠিক বলিনি মা? আজকালের ছেলেরা যা দুষ্টু! ওর বয়সী আমার একটা নাতি আছে। তাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রেখেও পার পাওয়া যায় না। আপনি তখন রান্নাঘরে ছিলেন নাকি বাথরুমে?
:না মানে
মার কথা শেষ হবার আগেই পেসেন্টের ছেলে তাকে ডাকে ।
:মা ডাক্তার তোমাকে হাঁটাহাঁটি করতে বারণ করেছে। আর তুমি !
: না মানে বাচ্চাটার মা এলোতো এ্যাদ্দিন বাদে তাই একটু গপ্পসপ্প। কী কান্ড দেখ, যা ভেবেছি তাই। মা‘টা কাজে ব্যস্ত ছিল আর সেই ফাঁকে বাচ্চাটা চানাচুর কেনার জন্য রাস্তায় নেমে গেলো।
বিব্রত মা উসখুস করেন। আর সেই অস্বস্তিকর অবস্থাটা কাটানোর জন্য সোহাগকে আরও নিবিড় করে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বৃদ্ধা চলে যায়। কিন্তু জায়গাটা যেন শূন্য হয় না।
জানলা দিয়ে ধেয়ে আসা রোদে দীর্ঘ একটা ছায়া পড়ে। ছায়াটা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় এই মিলন দৃশ্যের সামনে। সোহাগ চোখ তুলে বলে,
: মা বাবা এসেছে । ঝগড়া করো না যেন
: এসে খুব একটা কাজ করেছে। ছোট্ট একটা ছেলে তাকেও দেখে রাখতে পারে না এই তো তোর বাবার মুরোদ।
:এবার থেকে তুমিই দেখে রেখ
সোহাগের পিঠে হাত রাখে বাবা । সে হাত যে পিঠে রাখা মায়ের হাতের উপর পড়েছে তা বেশ বুঝতে পারে সোহাগ।