মেলবোর্নের নন্দন কানন ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ । মিতা চৌধুরী

  
    

একটি দেশ, তার জনগণ ও সমসাময়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপাত ধারণা অনেক মাধ্যমেই হয়তো পাওয়া যায় তবে শিল্পের  মতো আর কিছুতে তা এতো মূর্ত হয়ে ওঠে না। একটা কথা আছে কোনো দেশ বা জাতির সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা, ইতিহাস আর রাজনীতি এই তিনটিরই খুব সহজেই আপনি ধারণা পাবেন তাদের শিল্পচর্চা থেকে। বাংলাদেশের চিত্রকলাও তাই, বলে বাংলাদেশের কথা, এর ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের জনপদের কথা ও তাদের যাপিত জীবন গাঁথা, এর সমসাময়িক ইতিহাসের কথা, এর গৌরব গাঁথা, এর সংগ্রামের কথা । 

.

গত ২৬ অগাস্ট শুক্রবার ডেকিন ইউনিভার্সিটির বারউড ক্যাম্পাসের আর্ট গ্যালেরিতে উদ্বোধন হয়ে গেলো মাসব্যাপী চিত্র প্রদর্শনীর। প্রদর্শনীর শিরোনাম বাংলাদেশের হৃদয় হতে বা ফ্রম দ্য হার্ট অফ বাংলাদেশ  ২৬ আগস্ট ছিল মূলত উদ্বোধনী ও আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য। প্রদর্শনীটি ২৭ আগস্ট থেকে সবার জন্য উন্মুক্ত যা চলবে মাসব্যাপী। উদ্বোধনীতে এই আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা ড. নীরা রহমান ও আতিক রহমানের পাশাপাশি তাঁদের একমাত্র কন্যা আহেলী রহমান একটি ছোট বক্তব্য দেয় যা ছিল বাংলাদেশের প্রতি তার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার কথা, তার বাবা-মায়ের শিল্পানুরাগের কথা। এই প্রদর্শনীটি নিছক কোনো প্রপদর্শনী না, এর পেছনে আছে কিছু মানুষের বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর মহানুভবতার গল্প।

মেলবোর্নবাসি বাংলাদেশী-অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি ড. নীরা রহমান ও আতিক রহমানের অনেকগুলো পরিচয়ের মাঝে আরো একটি পরিচয় হলো তারা শিল্প সংগ্রাহক। বাংলাদেশের হৃদয় হতেশীর্ষক এই প্ৰদৰ্শনীটি মূলত তাদের দীর্ঘ ১৬/১৭ বছরের শিল্প সংগ্রহের অংশ। ড.নীরা রহমান মেলবোর্ন বিশ্বাবিদ্যালয়ের কলা অনুষদের অধ্যাপক আর আতিক রহমান আছেন ইন্টারন্যাশনাল এইড এন্ড ডেভেলপমেন্টের এশিয়া-প্যাসিফিকের দায়িত্বে। ব্যাক্তিগত পরিচয়ের কারণেই এই দম্পতির শিল্প সংগ্রহ ও শিল্পানুরাগের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। তাই যখন জানতে চাইলাম এই প্রদর্শনী উনাদের মূল সংগ্রহের কতটুকুর প্রতিফলন, বললেন, এটা তাঁদের মূল সংগ্রহের চার ভাগের এক ভাগ মাত্র।

ডেকিন ইউনিভার্সিটির আর্ট গ্যালারিতে শিল্পানুরাগী বাঙালিদের সাথে ড. নীরা ও আতিক রহমান।

প্রদর্শনীটি আয়োজন করা হয়েছে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার বিরাজমান কূটনৈতিক সম্পর্কের অর্ধশত বছর পূর্তি উপলক্ষে নীরা ও আতিক রহমানের উদ্দোগ্যে ডেকিন বিস্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ হাইকমিশন অস্ট্রেলিয়া ও অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন বাংলাদেশের সহযোগিতায়। প্রদর্শনী উপলক্ষে ডেকিন বিস্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যাঞ্চেলর প্রফেসর ইয়ান মার্টিন তাঁর শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হলো শিক্ষা ও গবেষণা এবং এর দ্বারা স্থানীয় এবং বিশ্বব্যাপী ইতিবাচক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবকে ছড়িয়ে দেয়া। আর শিল্প সেই পথটা আমাদের জন্য সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ হাইকমিশনার অস্ট্রেলিয়া ও অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনার বাংলাদেশ পৃথক শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছেন এই প্রদর্শনী উপলক্ষে যেখানে দুই পক্ষ থেকেই এই দীর্ঘদিনের পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের গুরুত্ব উল্লেখ করে এই সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ হাইকমিশনার ক্যানবেরা  জনাব মোহাম্মদ সুফিউর রহমান ও অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার ঢাকা মিস্টার জেরেমি ব্রুয়ের এই প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা ড. নীরা রহমান ও আতিক রহমানকে এমন মহতী উদ্যোগের জন্য বিশেষ ধন্যবাদ জানান।

প্রদর্শনীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পোর্ট্রেট করা একটি পেইন্টিং।

এই প্রদর্শনীটি আমার দৃষ্টিতে একটি মাইলফলক ও অসাধারণ ঘটনা। লেখার প্রথমেই উল্লেখ করেছিলাম যে, শিল্প মূলত তার জনপদের কথা বলে, তার স্থানের ও সময়ের কথা বলে। আর সেই জনপদের কথা, সময়ের কথা ও স্থানের কথা যখন অন্য সংস্কৃতির ও জনপদের সঙ্গে পরিচিত হয় তখন সৃষ্টি হয় দুই সংস্কৃতির ও জনপদের মেলবন্ধন। গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের চর্চা, সৃষ্টি হয় সাংস্কৃতিক সৌহার্দের। আর সেই সুযোগটাই সৃষ্টি হয়েছে “বাংলাদেশের হৃদয় হতে” প্রদর্শনীর মাধ্যমে।  

এই প্রদর্শনীটিতে মোট একুশজন সমকালীন বাংলাদেশী চিত্রশিল্পীর একত্রিশটি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, মনিরুল ইসলাম, রফিকুন নবী, জামাল আহমেদ, ফরিদা জামান, কনক চাঁপা চাকমা, বারীন সোম সহ আছে ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কাজও; যা সত্যিই অভিভুত হওয়ার মতো সংগ্রহ।  

এতক্ষন তো এই প্রদর্শনী আয়োজনের উদ্দেশ্য, উদ্যোক্তা ও পেছনের কারিগরদের কথা বললাম; এবার আসি এই প্রদর্শনীর চিত্রকর্মগুলোর বিষয়ে। আমি সুযোগটা নিতে চাই কারণ এই প্রদর্শনীর শিল্পীরা আমার পরিচিতই নন বরং অনেকেই আমার সরাসরি শিক্ষক। শিষ্য হিসেবে তাদের কাজ নিয়ে কিছুটা বলতে পারাটাও পরম সৌভাগ্যের। ড. নীরা রহমান প্রদর্শনীর ক্যাটালগের প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “শিল্প নিছক বিনোদন নয়, এটি বিলাসিতার সামগ্রীও নয়। শিল্প হল সংস্কৃতি। এটি তার জনগণের জন্য কথা বলে, প্রায়শই বিরোধপূর্ণ সময়ের মাঝে একটি শক্তিশালী কন্ঠ হিসেবে উঠে আসে।” একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে আমিও শিল্পকে ড. নীরা রহমানের উদ্ধৃতির মতোই ব্যাখ্যা করি। শিল্প সময়ের কথা বলে, অর্জনের কথা বলে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কথা বলে, শিল্প শুধুই শিল্পের কথাও বলে।

শিল্প চর্চার ধারা ও রীতি পোস্ট-মর্ডানিজমের পরে আর কোনো ইজমে আবদ্ধ নেই। মূলত কনটেম্পোরারি আর্ট বা সমসাময়িক শিল্প এই হলো মধ্য সত্তরের পরের সময়। কনটেম্পোরারি আর্ট মূলত সময়ের কথা বলে, শিল্পীর নিজ অভব্যাক্তির ও আবেগের কথা বলে। পশ্চিমা শিল্প চর্চা আর প্রাচ্যের শিল্প চর্চা ঐতিহাসিকভাবেই দুটো আলাদা ধারা, আর বলাই বাহুল্য এই কনটেম্পোরারি বা সমসাময়িক শিল্প চর্চার যুগেও তাই। তো কেমন আমাদের প্রাচ্যের আরো নিদৃষ্টভাবে বাংলাদেশের সমসাময়িক শিল্পচর্চা?

স্বপরিবারে প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন মিতা চৌধুরী ও তাঁর পরিবার।

বিংশ শতকের শুরুর দিকে সারা দুনিয়ার ভূরাজনৌতিক চিত্র যখন দ্রুত বদলাচ্ছিলো, তখন সেই প্রভাব সমকালীন শিল্পের উপরও প্রভাব ফেলে প্রকটভাবে যার ফলাফল ডাডামুভমেন্ট ও এভান্ট গার্ড‘!  হ্যান্স অর্প বা  মার্শাল ডুসম্প্ বা ত্রিস্তান টিজার বা ওয়েসলি কন্ডেন্সকির মতো শিল্পীরা তখন যে নতুন এক ধারা শুরু করেছিল তারই ধারাবাহিকতায় এক্সপ্রেশনিজম, মর্ডানিজম ও সবশেষ পোস্টমর্ডানিজম। তবে আমরা কনটেম্পোরারি বা সমসাময়িক শিল্প বলতে যা দেখি তার একটা বড় ভাগিদার সেই এভান্ট গার্ড ও ডাডা। ঠিক তেমনি ঔপনিবেশিক  আমলের ইতি ও  দেশভাগের পর বাঙালিতার বাঙালি জাতিসত্তার  স্বকীয় ও স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার যে যুদ্ধে নাম তার প্রতিফলন ঘটতে থাকে এই জনপদের শিল্পচর্চায়। তারই ধারাবাহিকতায় আসে ৭১ ও আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। বাংলাদেশের  জনপদের স্বাধিকারের, সংগ্রামের ও ত্যাগের কাহিনীই হয়ে ওঠে এই অঞ্চলের শিল্পীদের শিল্পচর্চার বিষয়বস্তু, যা এখনো প্রযোজ্য। এই প্ৰদৰ্শনীর বেশিরভাগ শিল্পীই নিজে প্রতক্ষ করেছেন আমাদের স্বাধীনিতা সংগ্রাম, আর শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ ও ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী তো মুক্তিযোদ্ধাই। তাই এই শিল্পীরা শুধু সেই সময়কেই বা অর্জনকেই চিত্রিত করেন না তা তাঁদের ক্যানভাসে তাঁরা সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশের স্বকীয় সমকালীন শিল্পধারা যা পাশ্চাত্য বা প্রাচ্য সবার থেকেই আলাদা।  

এবার  আসি কেন এই প্রদর্শনীটি নিছক একটি প্রদর্শনী নয়। একজন শিল্পীর কাছে যেমন তার শিল্প পরম মমতার ঠিক তেমনি একজন সংগ্রাহকের কাছেও। নীরা ও আতিক রহমান গত ১৫/১৬ বছর ধরে গড়ে তুলেছেন তাঁদের এই সংগ্রহশালা। আর সেই তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্ভার কতটা উদার ও স্বপ্নবাজ হলে সে অন্যের জন্যেও উন্মুক্ত করে দেয়, এটা নিশ্চই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁদের এই সংগ্রহ তাঁরা শুধু নিজেদের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সবার মাঝে।  আর নির্যাস ও প্রাণশক্তি সবাইকে উপভোগ করার বিরল সুযোগ তাঁরা সবার জন্য করে দিলো। আমি এই শিল্পানুরাগী দম্পতিকে তাই জানাতে চাই আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা এই মহান উদ্যোগের জন্য।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নীরা ও আতিক রহমানের মুখের কথা ও উদ্দেশ্য শুনে আমার শুধুই ভূপেন হাজারিকার, “আজ জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়,” গানটা মনে পড়ছিলো। জীবন মানেই ব্যস্ততা, প্রবাসের জীবন মানে সেই ব্যস্ততা আরো বহুগুন ; তারপরেও আশা করবো মেলবোর্নে বসবাসকারী প্রতিটি বাঙালি শত ঝামেলা বা ব্যস্ততা যাই বলিনা কেন তার মাঝেও সময় করে প্রদর্শনীটি নিজে দেখবেন ও তাদের সন্তানদের দেখাবেন। 

.

মিতা চৌধুরী : চিত্রশিল্পী, লেখক, সংগঠক । মেলবোর্ন প্রধান, প্রশান্তিকা। 

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments