মিতা চৌধুরী, মেলবোর্ন থেকে: দীর্ঘ লকডাউনের পর অস্ট্রেলিয়ার প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই ধীরে ধীরে ফিরে আসছিলো প্রাণ। করোনাভাইরাসের কারণে আরোপিত কঠিন নিয়ম ও নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে তুলে দেওয়া হচ্ছিলো। ভিক্টোরিয়া রাজ্যেও তাই প্রাণ ফিরে আসতে শুরু করেছিল, স্কুল খুলে দেয়া হয়েছিল ২৬ মে থেকেই। অতিথি হিসেবে ২০ জনকে আমন্ত্রনের অনুমুতি দেয়া হয়েছিল। রেস্তরাঁ, বার, পাব, ক্যাফেগুলো টেকওয়ের পরিবর্তে ২০জন করে ক্রেতা বসতে দেয়ার অনুমতি পায়। জিম, স্কেটবোর্ড পার্ক, পার্ক, সিনেমাও খুলে দেয়া হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই মধ্য জুন থেকে ভিক্টোরিয়া রাজ্যে আবার দেখা দিতে শুরু করে করোনাভাইরাসের প্রকোপ। প্রথম দিকে অল্প কিছু সংক্রমণ হলেও দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

লকডাউন ৩৬টি সাবার্বে
জুনের শেষের দিকে বেশ কিছু সবার্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে সংক্রমণ। এমন অবস্থায় কমিউনিটি সংক্রমণ রোধ করতে ২ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ১০টি পোস্টকোডের আওতায় থাকা ৩৬টি সবার্ব লকডাউন করে দেয়া হয়। এই পোস্টকোড ও সবার্বগুলো হলো:
৩০১২: ব্রুকলিন, কিংসভিল মাডিস্টোন, টটেনহ্যাম, ওয়েস্ট ফুটস্ক্রে।
৩০২১: আলবানভাল, কেলবা, কিংস পার্ক, সেন্ট আলবান্স।
৩০৩২: আস্ক ভ্যালি, হাইপয়েন্ট সিটি, মারিংবোর্ন, ট্রেভনকর।
৩০৩৮: কেইলর ডাউনস, কেইলর লজ, টাইলর্স ল্যাকস, ওয়াটারগার্ডেন।
৩০৪২: এয়ারপোর্ট ওয়েস্ট, কেইলর পার্ক, নিদ্রিয়া।
৩০৪৬: গ্লেনরয়, হ্যাডফিল্ড, ওয়াক পার্ক।
৩০৪৭: ব্রডম্যাডোওস, ডালাস, জাকানা।
৩০৫৫: ব্রান্সউইক সাউথ, ব্রান্সউইক ওয়েস্ট, মনে ভ্যালি, মোরেলেন্ড ওয়েস্ট।
৩০৬০: ফকনার।
৩০৬৪: ক্র্যাগীবার্ন, ডননিব্রোক, মিকেলহাম, রোক্সবার্গ পার্ক, কালকালো।
এইসব সবার্বের বসবাসকারী ব্যাক্তিরা এই সবার্বের বাইরে যাওয়া ও অন্য সবার্বের লোকজন এই সাবার্বে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ করা হয় ২৯জুলাই পর্যন্ত। শুধুমাত্র ৪টি প্রয়োজনে এই সাবার্বে বসবাসকারীরা বাইরে যাওয়ার জন্য যোগ্য আর তা হচ্ছে কাজ বা পড়াশুনা, নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার, ডাক্তার ও শারীরিক অনুশীলন।
ভিক্টোরিয়া ও নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের সীমান্ত বন্ধ
হঠাৎ করে ছড়িয়ে পড়া এই করানোর সংক্রমণে উদ্বিগ্ন হয়ে পরে নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকার। আর তাই এই সংক্রমণ রোধে ৭জুলাই নিউ সাউথ ওয়েলস তাদের সীমান্ত ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। তারই ধারাবাহিকতায় ৮জুলাই রাত ১১:৫৯ মিনিট থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় সীমান্ত। যদিও এই সিদ্ধান্তের কারণে সীমান্তে বসবাসকারী বহু অধিবাসী এক অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়। নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকার থেকে ঘোষণা দেয়া হয় যারা চাকুরী বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে সীমান্ত পারাপার হয়ে থাকেন তাদের বিশেষ অনুমতিপত্র দেয়া হবে। এই বিশেষ অনুমতির জন্য অনলাইনেই আবেদন করা যাবে বলে নিউ সাউথ ওয়েলস সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়। কোন ব্যক্তি যেন এই সীমান্ত বিধিনিষেধ অমান্য করতে না পারে বা অসুদুপায়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারে সেই বিষয়ে কঠোর নজরদারি আরোপ করা হয় আর এই লক্ষে মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখক রাজ্য পুলিশ ও অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্স ফোর্সের সদস্য। নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকার হুঁশিয়ারি করে বলেন যদি কেউ এই নিয়ম অমান্য করে সীমান্ত অতিক্রম করে তবে সে ১১ হাজার ডলার ফাইন বা ৬ মাসের কারাভোগ করবে।

হার্ড লকডাউনে ৯টি পাবলিক হাউসিং ভবন
মেলবোর্নের ৯টি পাবলিক হাউসিং ভবন গত ৪জুলাই হার্ড লকডাউনে যায় ৫ দিনের জন্য। এই ৯টি ভননে প্রায় ৩ হাজার লোকের বসবাস, এবং আশঙ্কা করা হয় এই ৯টি ভবন থেকে কমিউনিটি সংক্রামণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিলো, আর তাই গত শনিবার ৪জুলাই ভিক্টোরিয়ান প্রিমিয়ার ড্যান এন্ড্রুস এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই তাৎক্ষণিক হার্ড লকডাউনের ঘোষণা দেন। এই ৯টি ভবনে থাকা বাসিন্দারা ৪জুলাই থেকে কোনো প্রয়োজনেই বাইরে যেতে পারবেনা বলে জানানো হয়, একমাত্র ওই ভবনে থাকা কোন অধিবাসী যদি ভবনের বাইরে থেকে থাকেন তবে তাকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিলো। এছাড়া অন্য যেকোনো প্রয়োজন সরকারি তরফ থেকে সমাধান বা সরবরাহ করা হচ্ছিলো। প্রিমিয়ার ড্যান এন্ড্রুস বলেন, এই ৫ দিনে ৯টি ভবনে থাকা প্রতিটি ব্যক্তি ও পরিবারের করোনা টেস্ট করা হবে এবং এর পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে এই ৯টি ভবনের বিষয়ে। এই কাজ সুষ্ঠ ও সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য মোতায়েন করা হয় ৫হাজার রাজ্য পুলিশ, অর্থাৎ প্রতি ৬জন ব্যক্তির জন্য নিয়োজিত হয় ১জন পুলিশ সদস্য। এই কাজ পরিচালনার জন্য ভিক্টোরিয়ান পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি আরো নিয়োগ করা হয় নার্স, সামাজিক কর্মী ও প্যারামেডিক। যদিও হিউমান রাইটস ও অন্যান্য কিছু সংস্থা সরকারের এই উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করে আসছে শুরু থেকেই।
৬ সপ্তাহের লকডাউন মেলবোর্নে
সবরকম চেষ্টার পরেও কমিউনিটি সংক্রমণ কমে আসছিলো না। প্রথম পর্যায়ে লকডাউন দেয়া ৩৬ সবার্বে। এর বাইরেও দ্রুত ছড়াতে থাকে করোনার সংক্রমণ। উল্লেখ্য, মেলবোর্নের পশ্চিমে অবস্থিত উইন্ডহ্যাম সিটি কাউন্সিলের আল তাকোয়া কলেজ থেকেই ছড়িয়ে পরই বেশ কিছু সংক্রমণ। ৯ জুলাইয়ের সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী শুধুমাত্র এই কলেজ থেকেই ১১৩ টি সংক্রমণ নিশ্চিত করা হয়। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ও সংক্রমণ রোধ সরকার গত ৭জুলাই আবারো ৬ সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা দেয়, যা ৮ জুলাই রাত ১১:৫৯ মিনিট থেকে কার্যকর হয়। তবে এইবারের লকডাউন শুধু মেট্রোপলিটন মেলবোর্ন ও মিচেল শায়ার এর জন্য প্রযোজ্য। রিজিওনাল ভিক্টোরিয়া ও গ্রেটার জিলং এই লকডাউনের আওতার বাইরে। ভিক্টোরিয়াতে বর্তমানে স্কুলগুলো শীতকালীন বন্ধ চলছিল, আর তাই এই শীতকালীন বন্ধ আরো ১ সপ্তাহের জন্য বর্ধিত করা হয়। তবে সে সকং ছাত্রছাত্রী ইয়ার ১২ ও ১১ বা ইয়ার ১০ এর যে সকল ছাত্রছাত্রী ভিসিই সাবজেক্ট নিয়েছে তারা আগামী ১৩ জুলাই থেকে যথারীতি স্কুলে উপস্থিত হবে।
সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী ভিক্টোরিয়াতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২৯৪২ যার ১৬৫ টি গত ২৪ ঘন্টায় ঘটেছে।