মেলবোর্নে ঘুরুঞ্চির রঙিন বসন্ত

  
    

মেলবোর্ন থেকে মিতা চৌধুরী : মেলবোর্নের নিস্তরঙ্গ জীবনে বসন্ত এসেছে আশীর্বাদের মতন। শীতের জুবুথুবু জীবনে, বসন্ত নিয়ে আসে আল্টো রোদের পরশ; সেই উষ্ণতায় জেগে উঠেছে প্রকৃতি। বাড়ির আঙিনায় রডোড্রেনড্রন, ম্যাগনোলিয়া আর  ক্যামেলিয়া ফুলের হেসে উঠে। পথে-প্রান্তরে ফুলের সৌন্দর্য ও পাখির কলরবে হয় মুখরিত, উৎসবের আমেজে সেজে উঠে প্রকৃতি।

দক্ষিণ গোলার্ধের দেশ এই অস্ট্রেলিয়া যা মূলত ঘিরে আছে  ভারত, দক্ষিণ ও প্রশান্ত এই তিনটি মহাসাগর দিয়ে। এর আয়তন বিশাল ৭.৬৮৮ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার; এত বিশাল ভূখণ্ডের আবহাওয়ায় স্থানভেদে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও মূলত এটি চার ঋতুর দেশ। আর দক্ষিণ গোলার্ধের অবস্থানের কারণে উত্তরগোলার্ধের ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে এর কোনোই মিল নেই। উত্তর গোলার্ধে যখন ডিসেম্বর-জানুয়ারি  মাস মানে কনকনে শীত বা স্থানভেদে তুষারপাত তখন আমাদের এই দক্ষিণ গোলার্ধের দেশে প্রচন্ড গরমের দাবদাহ যা কখনো কখনো দাবানলে রুপ নেয়। আবার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে যখন উত্তর গোলার্ধে শীতের আগমনী শুনতে পাওয়া যায় পাতা ঝরা  শরৎ বা স্থানভেদে ফল (অটাম) এর উপস্থিতির মাঝে তখন তীব্র ঠান্ডার শেষে এখানে গাছে গাছে দেখা মেলে নতুন সবুজ কচি পাতার, পাখির কলতানে তখন মুখরিত হতে থাকে চারদিক। প্যাচপেচে বৃষ্টি আর দীর্ঘ শীতল রাতের পরে এই সময় বাড়তে থাকে দিনের দৈর্ঘ, ঝলমলে সূর্যের আলোয় চারদিক ভরে উঠে প্রাণ প্রাচুর্যে।

শিল্পী সারিতা রাহাত সংগীত পরিবেশন করছেন । ছবি: মিতা চৌধুরী
অস্ট্রেলিয়ায় চলছে বসন্তকাল, এই সময়টাতে প্রকৃতিও যেন সবখানে রং বিলাচ্ছে। সেই রঙে রঙিন হয়ে ওঠে মানুষের মন। প্রকৃতির সেই রঙিন উৎসবের সঙ্গে রংমেলাতেই  গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ নীল আকাশের নিচে হয়ে গেলো ঘুরুঞ্চি পত্রিকার দক্ষিণ গোলার্ধের বসন্ত বরণ। বেলা ২:৩০-এ চিত্রশিল্পী মিতা চৌধুরীর সঞ্চালনায় এই আদিভূমির আদিবাসীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে শুরু হয় এই বসন্ত বরণ। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী মেলবোর্নের পূর্বাংশের বেরিক এলাকার উইলসন বোটানিক্যাল পার্কে সেদিন বসেছিল বসন্ত আর প্রকৃতিপ্রেমীদের এক মিলনমেলা।

 

নারীরা ছিলেন বাসন্তী রঙের শাড়িতে। শীতের টালমাটাল আবহাওয়ার কারণে মেলবোর্নের খোলা আকাশের নীলে অনুষ্ঠান আয়োজন খানিকটা ঝুঁকির, তবে সেদিন প্রকৃতি নিরাশ করে নি আয়োজকদের। সুনীল আকাশের ছিলোনা কালোমেঘের ঘনঘটা। ঝকঝকে রোদের ঝলকানিতে ঝলমলিয়ে উঠেছিল বসন্ত প্রেমীদের হৃদয়।

বেরিক পার্কের এম্ফিথিয়েটারটি একটা উঁচু পাহাড়ের কোলে। পাহাড়ের গা কেটে করা হয়েছে আসন। আর চারধারে ছিলো লেক, বনানী। সেখানেই দুপুরের পরঅনুষ্ঠানস্থলে আসতে থাকেন বসন্তপ্রেমীরা। বসন্ত মুখর আজি, দক্ষিণ সমীরণে মর্মর গুঞ্জনে, বনে বনে বিহ্বল বাণী ওঠে বাজি’…নজরুলের এ গানে বসন্তের বন্দনায় সুরঝংকার তুলেছিলেন, শিল্পী সারিকা রাহাত। বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে’… বাউলসম্রাট আবদুল করিম শাহের এগানে দর্শকদের মাতান শিল্পী ওয়াহিদজুয়েল। তিনি আরো গাইলেন, ‘প্রেমও সেল বিন্ধিল বুকে, মরি হায় হায়’…। অনুষ্ঠানে আরো গান করেন, জেসমিন শিউলি, রাজীব রহমান, তৃষ্ণা রহমান ও কামরুন নিপা।

মিতা চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বাদ পড়েনি শিশুরা। বিদেশ বিভুঁয়ে বাংলা ভাষার চর্চা যেখানে দুরুহ সেখানে মাতৃভাষায় গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তারা। শিশুশিল্পী শিঞ্জন জামানের গলায় রসিক আমার মন বান্ধিয়া পিঞ্জর বানাইছেগানে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শকরা। এছাড়াও শিশুশিল্পী গুনগুন, নীলগুন, তানিশার গানে মুগ্ধ হন সকলে। এছাড়াও, স্বরচিত কবিতা আবৃতি করে শোনান ড. সাদিক আক্তার।

বসন্ত উৎসবে আগত প্রকৃতিপ্রেমীদের একাংশ । ছবি : মিতা চৌধুরী

পাহাড়ে গায়ে গা এলিয়ে রোদ পোহাতে থাকা ভিন্নদেশিরাও ছিলেন অনুষ্ঠানে দর্শক। ভাষা না বুঝলেও সুরমুর্ছনায় তারাও সমান তালে তাল মিলেছেন এই উৎসবে । অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শত কিলোমিটার দূর থেকেও এসেছিলেন কয়েকটি বাঙালি পরিবার। তারা বলছিলেন, কেবল উৎসবের টানে আর সবার সাথে খানিক নির্মল চিত্ত বিনোদনের জন‍্য সবকাজ ফেলে এসেছিলেন বেরিকের বসন্ত উৎসবে।

অনুষ্ঠানে ঘুরুঞ্চির প্রধান সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ আগত অতিথিদের ধন‍্যবাদ জানান। স্বাগত ভাষণে মানসিক বিকাশে ভ্রমণের গুরুত্ব তুলে ধরেন তিনি। অনুষ্ঠানে অন‍্যান‍্যের মধ‍্যে উপস্থিত ছিলেন, একাত্তর টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মাহবুব স্মারক।

মেলবোর্নের ঘোরাঘুরির সংগঠন ঘুরুঞ্চির প্রতিষ্ঠা ২০২০ সালে। শুরুতে অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক ভ্রমণ ম‍্যাগাজিন হলেও, অল্প দিনের মধ‍্যেই তা হয়ে ওঠে সারাপৃথিবীর বাঙালি ভ্রমণ পিপাসুদের প্রিয় পত্রিকা। বর্তমানে সাত মহাদেশ থেকে সৌখিন বাঙালি ভ্রমণকারী তাদের ভ্রমণ কাহিনী লিখছেন ঘুরুঞ্চিতে। প্রতি মাসেই শতপাতার রঙিন সেই পত্রিকায় চোখ বুলান সহস্রাধিক মানুষ।

প্রকাশনাতেই সীমাবদ্ধ নয় ঘুরুঞ্চি। প্রতিমাসে মেলবোর্নের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে ঘোরাঘুরির আয়োজন করে সংগঠনটি। পরিবারের শিশুরাসহ সকলে যোগদেন তাতে। এই আয়োজনের মধ‍্যদিয়ে তারা প্রকৃতির কাছাকাছি আসেন। তেমনি সুযোগ পান অস্ট্রেলিয়ার বিরল প্রজাতির পশু, পাখি, ফুল দেখার।

এছাড়া নানা বিষয়ে নিয়মিত অনলাইন সেমিনারের আয়োজনও করে ঘুরুঞ্চি। যাতে যোগদেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ভ্রমণ পিপাসু মানুষ, যা শুনে উদ্বুদ্ধ হন নবীন ব্রহ্মচারীরা।

পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের বাঙালি ভ্রমণ পিপাসু মানুষ চাইলে যুক্ত হতে পারেন, ঘুরুঞ্চির এই উদ‍্যোগের সাথে। পাঠাতে পারেন ভ্রমণ বিষয়ে লেখা, যুক্ত হতে পারেন

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments