মেলবোর্নে চলছে শিল্পী মিতা চৌধুরীর একক প্রদর্শনী

  
    

প্রশান্তিকা রিপোর্ট: মেলবোর্ন প্রবাসী শিল্পী হাসিনা চৌধুরী মিতার একক শিল্প প্রদর্শনী চলছে আরএমএইটি ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট সাইট গ্যালেরিতে। গত ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে ৭ মে পর্যন্ত। ইতোমধ্যে অসংখ্য শিল্পানুরাগী দর্শক তাঁর প্রদর্শনীটি দেখেছেন। সরেজমিনে গিয়ে এই প্রতিবেদক জানতে পারে মিতা চৌধুরী’র মা শীর্ষক প্রদর্শনীটি অনেক দর্শক পছন্দ করেছেন এবং এখনও অসংখ্য দর্শনার্থী প্রতিদিন ভিজিট করছেন।

প্রদর্শনীতে দর্শনার্থীদের সঙ্গে শিল্পী মিতা চৌধুরী

মিতা চৌধুরী বলেন, একটি সংস্কৃতিকমনা পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠার কারণেই তার ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি জন্মায় প্রবল আগ্রহ। আর তাই উচ্চমাধ্যমিকের পর ভর্তি হাসিনা চৌধুরী মিতা হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগে। সেখান থেকে স্নাতক শেষ করে পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। বর্তমানে মেলবোর্নেই করছেন শিল্প চর্চা এবং আরএমএইটি ইউনিভার্সিটি মেলবোর্নে ফাইন আর্ট (পেইন্টিং) বিভাগে ব্যাচেলর করছেন। পরিবারের সবাই ছবি আকার প্রতি আগ্রহী থাকলেও ছবি আঁকা বা শিল্পকে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে কেউই বেছে নেননি। মা চেয়েছিলেন মেয়ে পড়ুক ডাক্তারি বা মেডিক্যাল সাইন্স, আর তাই ভর্তিও করা হলো মেডিক্যাল ভর্তি কোচিংএ। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের প্রাথমিক আপত্তি সত্ত্বেও গোঁ ধরে চারুকলাতেই ভর্তি হন। আমরা জানতে চেয়েছিলাম পরিবারের থেকে কি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের কারণে চারুকলার প্রতি অনাগ্রহী ছিলেন? উত্তরে মিতা জানালেন, “আসলে আমরা বেড়ে উঠেছি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে, আর তাই আমার মায়ের আশংকা ছিল বাংলাদেশের অর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে স্রেফ শিল্পী হিসাবে জীবিকা নির্বাহটা প্রতিকুল ও চ্যালেন্জিং। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ও নিশ্চিত আয়ের মাধ্যম আসলে বেশি প্রাধান্য পায়। বাস্তবিকভাবে শিল্পকে জীবিকা হিসেবে নেয়াটা একটা মধ্যবিত্ত সন্তানের জন্য অনেকটাই স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতরানোর পর্যায়ে পরে। ” তিনি জানান এখন অবশ্য তাদের আশংকা অনেকটাই কেটেছে, কারণ শিল্পকে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করাটা হয়তো চ্যালেন্জিং তবে অসাধ্য নয়, হ্যাঁ এটা ঠিক একজন শিল্পীকে অন্য যেকোনো মানুষের চেয়ে অনেক বেশি স্ট্রাগল করতে হয় জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে এবং অনেক ছাড়’ও দিতে হয়।

‘মা’ কে তিনি এঁকেছেন বহুরুপী মা দূর্গার অবয়বে।

কাজের মাধ্যম :
হাসিনা চৌধুরী মিতা জানান তিনি বহু মিডিয়া বা মাধ্যমেই কাজ করেন তবে বেশি কাজ করেন, তেল রঙে, জল রঙে ও মিক্সড মিডিয়াতে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তেল রঙে কাজ করার কারণ এর স্থায়িত্ব ও সহজলভ্যতা, আরেকটা কারণ এর ক্যারেক্টার বা চরিত্র, তেল রং অনেক বেশি ফরগিভিং। যেকোনো পরিবর্তন বা সংযোজন আপনি একটা তেলরঙে করা কাজে যেকোনো সময়ই আবার করতে পারবেন , যা অন্য মিডিয়া বিশেষ করে জলরঙে কঠিন। আর জলরঙে কাজ করার প্রধান কারণ আমি এই মাধমতার সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকে পরিচিত তাই এই মাধ্যমটা বলতে পারেন আমার হৃদয়ের কাছাকাছি একটি মাধ্যম। আরেকটি কারণ হলো জলরং এখনো অনেকটা প্রাচ্য বা ওরিয়েন্টাল শিল্পের মাধ্যম হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত। আর ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিগুলোতে জলরং অন্যান্য মাধমের মতো এত বেশি চর্চিত হয় না। আর আমার কাজগুলো যেহেতু কালচারাল রেফারেন্স ও আমার আইডেন্টিটি নির্ভর তাই ওয়েস্টার্ন কনটেক্সটে যখন আমি ইস্টার্ন মিডিয়াম ব্যবহার করি আমার সেই কালচারাল রেফারেন্সের মার্ক মেকিংটা অনেকটাই হয়ে যায়।

শিল্পের বিষয়বস্তু :
মিতা জানান, তার দৈনন্দিন যাপিত জীবন, তার চারপাশের পরিবেশ এবং সেই চারপাশের সঙ্গে তার যে সংযোগ ও সম্পর্ক, তার দৈত সাংস্কৃতিক পরিচয়, অভিবাসী জীবন এসবই মূলত তার শিল্পের মূলবিষয় ও উৎসাহ। আর যেকারণে তার সমসাময়িক চিত্রকর্মে এই দৈত সাংস্কৃতিক পরিচয়, অভিবাসী জীবনের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, ফেমিনিজম এই বিষয়গুলি বারবার স্থান পায়। তিনি বলেন, আমরা যারা ফার্স্ট জেনারেশন মাইগ্রান্ট, তারা নিরন্তর একটা স্ট্রাগলে থাকি, সেই স্ট্রাগলটা একটা ভালো জব, নিজের পরিচিতি, সামাজিক বৈসাদৃশ্যের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া সহ আরো অনেক বিষয় নিয়ে। আবার আরেকটা বিষয় হলো আমরা এক নিরন্তর মানসিক দৈরথে থাকি, যে আসলে আমি কোন সমাজের ? কারো দীর্ঘদিন বসবাস করেও আমরা এই সো কাল্লড পশ্চিমা সমাজের অনেক কিছুর সঙ্গে নিজেকে মানাতে পারিনা আবার আমরা নিজ দেশেও এখন পরবাসী। তারপর আছে সামাজিক বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য , এসকল বিষয় আমাকে খুব টানে।

মা- শিল্পী মিতা চৌধুরী

প্রদর্শনীর শিরোনাম কেন ‘মা’?
গত ১৯ এপ্রিল ২০২১ থেকে আরএমএইটি ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট সাইট গ্যালেরিতে শুরু হযওয়া প্রদর্শনীর শিরোনাম হলো ‘মা’। আর এই শিরোনাম বিষয়ে মিতা জানান, “আমি নিজেও একজন মা, আবার আমি ও মায়েরা ৮ ভাই বোন বেড়ে উঠেছি এমন এক মায়ের অধীনে যিনি ছিলেন আমাদের পরিবারের সর্বময় ও প্রধান রক্ষক। কিন্তু সেই মায়ের আলাদা কোনো পরিচয় ছিল না। তিনি একসময় পরিচিত হয়েছেন তার পিতার কন্যা হিসেবে, তারপর আমার পিতার স্ত্রী হিসেবে আর এখন আমাদের মা হিসেবে। এবং এটা শুধু আমার মায়ের ক্ষেত্রেই নয় সামগ্রিকভাবে সকল মায়েদের জন্যই প্রযোজ্য। আর তিনি যদি হন কোনো রক্ষণশীল সমাজের মা তবে তা’ই মূলত তার একমাত্র পরিচয় এবং মজার বিষয় হলো একটা সময় পর্যন্ত ধারণা ছিল মায়েদের এই অস্তিত্ব শুধু বাংলাদেশ বা আমাদের রক্ষণশীল সমাজের মায়েদেরই কিন্তু যখন আমি অস্ট্রেলিয়ায় আসি যা মূলত পশ্চিমা মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত দেখলাম সেখানেও মায়েদের অবস্থান আসলে কম বেশি একই। মায়েদের কাজগুলো ও দায়িত্বগুলো অদৃশ্য ও অস্বীকৃত তা সে কর্মজীবী মা’ই হোক আর বাড়িতে থাকা মা’ই হোক। এই মা বাংলাদেশেরই হোক বা অস্ট্রেলিয়ার বা ইতালির বা নাইজেরিয়ার। আসলে মায়েদের এই যুদ্ধ ও নিরন্তর মানিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা একটা ইউনিভার্সেল বিষয় এবং এই মা বিষয়টাও তাই ইউনিভার্সেল।”

তিনি জানান , এই শিল্পকর্মগুলোতে তিনি বারবার তার প্রতিকৃতিই এঁকেছেন বিভিন্নভাবে, এবং তিনি তাকে চিত্রায়িত করেছেন হিন্দু দেবী দুর্গার আদলে যার একাধিক বহু আছে বলে আমরা সবাই জানি। আমরা জানতে চেয়েছি কেন মিতা নিজেকেই বারবার এঁকেছেন এবং দেবী দুর্গার আদলে এঁকেছেন ? উত্তরে মিতা জানান ,” আসলে আমি আমাকে শুধু একজন বাংলাদেশী নারী হিসেবে দেখি না , আমি মিতা একই সঙ্গে আমার দেশ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এবং সেই সঙ্গে একজন অভিবাসী নারী ও সামগ্রিক নারী সমাজকেই দেখি। আর তাই আমি আমাকে আমার শিল্পেরই একটি মাধ্যম ও বিষয় হিসেবে চিন্তা করি।”
‘মা’  শীর্ষক এই প্রদর্শনীতে মোট ১০টি পেইন্টিং আছে  যার মধ্যে ৮টি জলরঙে ও ২টি মিক্সড মিডিয়াতে করা। আছে একটি ভিডিও আর্ট এবং ২টি ফ্লোর ওয়ার্ক।  এই প্রদর্শনী চলবে আগামী ৭মে ২০২১ পর্যন্ত।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments