টানা ৩৬টি ম্যাচ জয়ী পৃথিবীর এক নম্বর খেলোয়াড় লিওনেল মেসি এবং সারা পৃথিবীব্যপী তাঁর কোটি কোটি ভক্তরা হয়তো কখনো কল্পনাই করতে পারেননি, কাতারে তাঁদের জন্য এতটা অনাকাংখিত ফলাফল অপেক্ষা করছে। “দি গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ” খ্যাত বিশ্বকাপ ফুটবলের মাঠে এই পরাজয়ের গ্লানি তাঁরা সহজে ভুলবেন না।
কিন্তু কেন এমনটি হলো? খেলার প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা একটু পরপর বল জালে পাঠায় ঠিকই কিন্তু গোলের স্বীকৃতি পায় না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, অফসাইড নামক ফাঁদটি তৈরিই করা হয়েছে, তাদেরকে ধরাশায়ী করার জন্য। কারণ পরবর্তীতে আরো কয়েকটি খেলা দেখলাম, ঠিক ওভাবে ইঞ্চি ইঞ্চি হিসাব করে আর কোনো ম্যাচে অফসাইড ধরা হয়নি। তবুও প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনা এক গোলে এগিয়েই ছিল। কিন্তু হাফ টাইমের পরে কী এমন হলো যে, আর্জেন্টিনার এত এত স্টার প্লেয়াররা আর একটি বারের জন্যও বল জালে পাঠাতে পারলেন না? এমন কি অফসাইডের মাধ্যমেও না।
বিরতির পর নেমেই সৌদি আরব দুই দুটি গোল দিয়ে দিল? এখানেই চিন্তার উদ্রেক করে। খেলাধুলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বড় বড় টুর্নামেন্ট আয়োজনের পিছনে অনেক ধরণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। আমরা যারা খেলাধুলাকে নির্মল আনন্দের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করি, তাঁদের আবেগ অনুভূতিকে পুঁজি করেই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যকে হাসিল করা হয়। অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই, থাকার কথাও নয়। সোজাসুজিভাবে বুঝি, লাভ ছাড়া এত টাকা বিনিয়োগ করবে কেন? কিন্তু রাজনীতিটা বড় নির্মম।
এবার আসুন সেই আলোচনাটাই করা যাক, আর্জেন্টিনা এবং সৌদি আরবের ম্যাচটি কেন রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপুর্ন ছিল? বিস্তারিত আলোচনার আগে বলে নেই, এই খেলাটি যদি ঐদিন ব্রাজিল বনাম সৌদি আরব হতো, তাহলেও সৌদি আরব জিতে নিত। ব্রাজিল হেরে যেত কিন্তু কেন?
এই বিষয়টি সহজভাবে বোঝার স্বার্থে একটু অন্যদিকে চোখ ফেরাতে হবে, শুধুমাত্র ফুটবল আর খেলোয়াড়দের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। আপনারা কি লক্ষ্য করেছেন, আর্জেন্টিনা বনাম সৌদি আরবের ম্যাচটি ফিফার বর্তমান প্রেসিডেন্ট Gianni Infantino এর পাশে বসে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান দেখেছেন। টেলিভিশনে সেই দৃশ্য বারবার দেখা গেছে। আপনি বলতে পারেন, তাতে কি হয়েছে? তাতে অনেক কিছু হয়েছে। এই যুবরাজ কাতারে ভীষণ অপ্রত্যাশিত ব্যক্তি, কারণ ২০১৭ সালে তিনি কাতার দেশটি দখলের পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই ব্যক্তি কিভাবে কাতারে এসে ফিফার প্রেসিডেন্টের পাশে বসে বিশ্বকাপ খেলা দেখেন? ঘটনার পিছনে অনেক ঘটনা আছে।
এবার চলুন আরেকটু পিছনে ঘুরে আসা যাক, ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকান্ডের জন্য এই যুবরাজকে আমেরিকা অভিযুক্ত করেছিল। আমেরিকার খুব অপ্রিয়ভাজন হয়েছিলেন। উক্ত কারণে বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশে এখনও তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি। মাত্র এক সপ্তাহ আগেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জুলাই মাসে তেল ইস্যুতে আলোচনার বিষয়ে সৌদি যুবরাজকে অভিযুক্ত করে ‘পরিণতি’ নিয়ে সতর্ক করেছিলেন। ওই বৈঠকের পর বাইডেন অঙ্গীকার করেছিলেন সৌদি আরবের ডি ফ্যাক্টো নেতাকে ‘একঘরে’ করা হবে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
তা না হলে এই মাসেই মোহাম্মদ বিন সালমান কায়রোতে কপ২৭, বালিতে জি২০ এবং ব্যাংককে এপিইসি সম্মেলনে হাজির হলেন কিভাবে? ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে সৌদির এই যুবরাজ জুলাই মাসে প্যারিসে বৈঠক করলেন কিভাবে? নাকি কিছুদিনের মধ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে রিয়াদে এই যুবরাজ স্বাগত জানাবেন। সেই কারণে যুক্তরাষ্ট্র নড়েচড়ে বসেছে? আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই মুহুর্তে অনেক ধরণের সমীকরণ চলছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র তেল সমৃদ্ধ সৌদি আরবের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।
তাই হঠাৎ করেই এখন পশ্চিমারা তাঁকে ওয়েলকাম করছে। কারণ শীতকাল চলে আসায় পশ্চিমা অর্থনীতিগুলো জ্বালানি স্থিতিশীলতার জন্য মরিয়া। যেহেতু সৌদি আরবের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৌদি যুবরাজের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই সৌদি যুবরাজ আবার লাইম লাইটে চলে এসেছেন। এখন তিনি যা করতে চাচ্ছেন, তাতেই তাঁরা সম্মতি দিচ্ছেন।
অন্যদিকে মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের মতো ধর্মীয়ভাবে চরম রক্ষনশীল দেশে চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহ, কনসার্টের আয়োজন করেছেন, ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম চালাচ্ছেন। ফলে রক্ষনশীলরা তাঁর প্রতি ভীষন বিমুখ। এমনকি রাজ পরিবারেও তাঁকে অনেকেই পছন্দ করে না। রাজপ্রাসাদেই তিনি হামলার শিকার হয়েছিলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরও বেরিয়েছিল।
গত চার পাঁচ বছর যাবৎ যেহেতু সৌদি যুবরাজ ঘরে বাইরে বহুমুখী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন। তাই তিনি একের পর এক বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করার চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বদৌলতে ভাগ্যের চাকা তাঁর দিকে ঘুরতে শুরু করেছে এবং তিনি পশ্চিমাদের ম্যানেজ করতে পেরেছেন; তাই এখন শুধু তাঁর দরকার নিজের দেশে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা। আর সেটা করার জন্য এই গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের (বিশ্বকাপ) চেয়ে ভাল সুযোগ কি আছে?
ফিফার প্রেসিডেন্টের পাশে বসে নিজের দেশের খেলা দেখে মোহাম্মাদ বিন সালমান মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আবার শক্তিশালীভাবে ফিরে আসার খবরটিই দিলেন। যাকে বলে এক ঢিলে বহুপাখি মারার কৌশল। সৌদি আরবের জনগনই শুধু নয়, মধ্যেপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোকেও তিনি একটি পরিষ্কার বার্তা দিয়ে দিলেন।
একটা ম্যাচ জেতার জন্য কত শত উপায় আছে! সেসব উপায়ের খোঁজ যুবরাজ ভালো করেই রাখেন। আর বাজিকররাও সবসময়ই ভাল কাস্টমারই খোঁজে। যুবরাজের চেয়ে ভাল কাস্টমার এই দুনিয়ায় কে আছে? তা ছাড়া ফিফা কি ধরণের দুর্নীতিবাজ, তা বোঝার জন্য নেটফ্লিক্সে একটা ডকুমেন্টারি আছে, সম্ভব হলে দেখে নিবেন। মঙ্গলবার আর্জেন্টিনাকে হারানোর ফলে সৌদি আরবে যুবরাজের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে, এটা না বোঝার মতো স্টুপিড তিনি নন, তাই না?