পর্ব ১
ভোর বেলাতে স্নান করার অভ্যেস মৌসুমীর, গিজারের চাটপ্যাডটা আপাতত বিকল তাই হাতেই গরম জলটা গায়ে সয় সয় মতো তাপমাত্রায় গিজারটা বাড়িয়ে নেয়। জলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গুন গুন গুন করে গাইতে থাকে ‘এপারে মুখর হলো কেকা অই কেকা আ আ আ ….ওপারে নিরব কেনে কুহু হায়’ কুহু কুহু বলতে বলতে চট করে হালকা নীল নরম তোয়ালে দিয়ে গা মুছে নেয়। আজ সবুজ তাঁতের শাড়ীটা পরবে তাই মিলিয়ে রাখা কালো ব্লাউজ এবং পেটিকোট পরে, শাড়ীটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে স্নানঘর থেকে। ও হো সিঁদুর পরতে ভুলে গেছে তাই আবার ফিরে গিয়ে শ্বেত পাথরের ছোট্ট কৌটোয় রাখা রাঙা সিঁদুর অল্প করে সিঁথিতে ছোঁয়াতেই নিজেকে নিজের কাছে বড্ড সুন্দর লাগতে থাকে। আয়নায় তাকিয়ে মিষ্টি হেসে অরুণ, এই অরুণ, অরুণবাবু ওঠো বলে শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
এই যে সময়ের ওরা এখন সভ্যতার এতোটা অগ্রগতি স্বত্তেও মৌসুমী সনাতন ধর্মাচার পালন করে। বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের চাইতে এই পালনের মধ্য দিয়ে সে সমর্পনের সুখ খুঁজে পায়। বংশ পরম্পরায় যে অভ্যেসটা চর্চা হয়েছে সেটা থেকে বেরিয়ে আসতেও চায় না মৌসুমী। শোবার ঘরের এক পাশে পূজোর স্থান, সেখানে ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম শেষে প্রার্থনা করে তার একমাত্র পুত্র অনিরুদ্ধের জন্য। আজ অনির জীবনের অনেক বড় একটা দিন, ভাবতে ভাবতেই দু ফোটা আনন্দ অশ্রু ওর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে। পূজো শেষ করে ওঠার আগেই পেছন থেকে জাপটে ধরে অরুণের উষ্ণ মায়াবী দুটো হাত, বলে থাক না মৌ এসব চলো আমরা এই মিষ্টি ভোরে আরেকটু ঘুমিয়ে থাকি। মিথ্যে রাগের ছলে কটমটে চোখে তাকালে অরুণের মিশমিশে মসৃন কালো মুখে ঝকঝকে হাসি দেখে মৌসুমীর রাগ গলে জল হয়ে যায়। মনে মনে বলে অরুণবাবু তোমাকে ভালোবাসি। তবু তাড়া দিতে থাকে যেনো এক্ষুনি শাওয়ার নিয়ে নেয় নইলে সকালের হাওয়াই জাহাজটা সময় মতো ধরতে পারবে না ।
পর্ব ২
হাওয়াই জাহাজটির নাম মসলিন ৫০৫, এটি একটি বিশেষ বাহন। অতি অতি দ্রুত গতির বাহনটি সব সময় আবার যাত্রী বহন করে না, এ সপ্তাহে মসলিন ৫০৫ উড়লে অন্য সপ্তাহে জামদানী ৬০৬ উড়াল দেয় অন্য গন্তব্যে। মৌসুমী এবং অরুণ দুজনেই খুব যত্ন করে ওদের ভ্রমনের বিশেষ ব্যাগগুলো গুছিয়ে নিয়েছে। কতো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে তাই পর্যাপ্ত শুকনো খাবার নিয়েছে সাথে, যদিও মাঝে যাত্রা বিরতি আছে তবু সাবধান হতে কি ক্ষতি। অক্সিজেন মাস্ক নিতে হলো পর্যাপ্ত পরিমানে। অনির অনুষ্ঠানে যারা আসবেন তাদের জন্যে বিশেষ উপহার নিতে হলো সকলের নাম ধরে ধরে। অরুণের স্বভাবজাত আলস্য ওদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছিলো তাই মৌসুমী রেগে চিৎকার শুরু করে দিলো এবারে ‘ কি হচ্ছে অরুণবাবু তুমি কি ভুলে গেছো আজ হাওয়াই জাহাজে উঠতে না পারলে আমরা আর অনির সিংটিমিন এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটায় যেতেই পারবো না? তোমায় নিয়ে আর পারি না গো। সব কিছুতে ছেলেমানুষী করো।’
এতো যে অভিসম্পাত দিচ্ছে তার মৌ, অরুণ তবু মুখে স্মিত হাসি নিয়ে নিজের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। ওদের প্রেমটা মধুর রইলো সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত, এ ভালোবাসায় কখনোই কোন বিরাম চিহ্ন জায়গা দখল করতে পারেনি। বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে, অরুণের অন্তর তাই বলে এবং মৌসুমীর ভেতরেও একই আবেগ কাজ করে বোঝে অরুণ খুব বোঝে। সব প্রস্তুতি সারা হলে মসলিনের ঘাটিতে পৌঁছে যায় ওরা সময় মতোই। সে এক বিশাল এলাকা নিয়ে মসলিনের ঘাটিটা তৈরি করা, আজ আবার যাত্রী সংখ্যা খুব বেশি নয় কারন এটা ব্যয়বহুল যাত্রা সকলে এ হাওয়াই যানে ওড়ার সামর্থ্য রাখেনা। পাশাপাশি সিটে বসে নেয়া মাত্রই ওদের নভোযানটি উড়াল দেয় শূন্যে।
পর্ব ৩
মসলিন ৫০৫ নভোযানটি অবতরণ করলো চন্দ্রে, এখন যাত্রা বিরতি চলছে, একটু পরে উড়াল দেবে মঙ্গলগ্রহের উদ্দেশ্যে। পৃথিবী ছেড়ে আসা সকল নভোযান চন্দ্রে বিশ্রাম নিয়ে তারপর উড়াল দেয় শেষ গন্তব্যে। নভোযানের ভিড়ে চন্দ্র এখন একটা উড়াল জাহাজ ঘাঁটি। অরুণের পরদাদার বাবা মৃন্ময়কুমারের নিবাস ছিলো ঢাকার নারিন্দায়, তার ডায়েরীতে লেখা কয়েকশ বছর আগের সেই সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের রুপ নিয়েছে যেনো চন্দ্রে। সারাক্ষন যাত্রীদের ওঠা নামা, বিশ্রামের কক্ষে গিয়ে নভোযাত্রী পোশাক বদলের জটলা, অক্সিজেন সিলিল্ডার ষ্টেশনে কেউ রিফিলিং করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নভোযানগুলোর জ্বালানি ভরে নেবার তাড়া থাকে। খাবার স্টেশনগুলোয় উপচে পড়া ভিড়তো আছেই।
মৌসুমী এবং অরুণবাবু প্রায়ই চন্দ্রে আসে কারন ওরা ওদের অবকাশ যাপনের ফ্ল্যাটটি এখানেই কিনে রেখেছে। শত ভিড় হলেও চন্দ্রই সৌরমন্ডলে ওদের সবচাইতে প্রিয় স্থান। চন্দ্রে এলে স্মরণ করে ওরা নিজেদের দেখা হবার সেই মুহূর্তগুলো। অরুণ তখন মঙ্গলে আবাস স্থাপনের কাজে তুমুল ব্যস্ত, চন্দ্রের বিশেষ গবেষণাগার দ্যা মারস্ সিভিলাইজেশনের তরুণ বিজ্ঞানী অরুণকুমারের দেখা হয় চন্দ্রের সয়েল সাইনটিষ্ট মৌসুমী সেনের সঙ্গে। প্রথম দেখার সেই মধুরক্ষন ওরা কেনো যে ভুলতে পারে না আজো! চৌম্বক আকর্ষণ ছিলো সেটা দুজনেই জানে, চারচোখের গভীর মিলনের সে সময়ে দুজনেই রচনা করে নিয়েছিলো আমৃত্যু ভালেবাসার এবং পাশে থাকার গল্পটা।
পর্ব ৪
অরুণ মৌসুমীর চাইতে সাত বছরের ছোট, সেটা ওদের প্রণয়ে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি।বরং অরুণ তুমুল প্রেমে আগলে রেখেছে ওর সঙ্গীকে, ভালোবাসার নকশীকাঁথায় মুড়িয়ে দিয়েছে মৌসুমীর অষ্ট প্রহর। ভালোবাসার বুঝি অমনই ধারা কোনো বাঁধা তাকে আটকাতে পারে না। যদি সেটা ঘটে যায়, আপন স্রোতে সে বয়ে চলে ভীষণ প্রাবল্য নিয়ে মধুর ছন্দে। ওদের যখন দেখা হলো তখন চন্দ্রের মৃ্ত্তিকা বিষয়ক গবেষণায় নিমগ্ন ব্যস্ততম বিজ্ঞানী মৌসুমী সেনের ভাবনায় ছিলো না কোনও সঙ্গী কিংবা সংসারের স্বপ্ন। কাজ পাগল মানুষটাকে অরুণ তার ভালোবাসায় এমনি করে জড়িয়ে ফেললো যে বিয়ে প্রথায় যার কোনো বিশ্বাসই নেই সেই মৌসুমী সাতপাক ঘুরেই বরমাল্যটা অরুণের গলায় পড়িয়ে দিয়েছিলো। চন্দ্রে তখন আবাস তৈরীর প্রবল চেষ্টা চলছে, মৌসুমীর গবেষণার ফলাফল যেখানে বিশাল ভূমিকা রাখবে এমন একটা ক্রান্তি লগ্নে মৌসুমীর মা হতে ইচ্ছে হলো, অরুণের বাচ্চার মা হবে সে জেদ ধরে বসলো।
অরুণ খুব করে বুঝিয়েছিলো স্যারোগেট বেবি নিয়ে নিতে, যেটা হরহামেশাই ঘটছে মানুষ উৎপাদনে ওদের সময়ে কিন্তু কে বোঝাতে পারবে সে একরোখা মৌসুমীকে? মৌসুমীর গর্ভে ওদের সন্তান একটু একটু করে বড় হতে থাকলে প্রতিটা দিন গর্বিত বোধ করেছে মৌসুমী। স্টেমসেল গবেষণায় যেখানে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড সম্পূর্ণ নিরোগ এবং প্রোগ্রামড্ হিউম্যান তৈরি করা হচ্ছিলো সে সময় মৌসুমী কিছুই পরোয়া করেনি এসবের। মনের খুব গভীরে বিশ্বাস ছিলো ভালোবাসার এবং খুব আকাংখার সন্তান সেরাই হয়। ওর স্বপ্নটা সত্যি করে বিয়ের ন মাস পরেই জন্মে ওদের একমাত্র সন্তান। অরুণ সব সময় চেয়েছে ওদের সন্তান মায়ের পদবীতেই পরিচিত হবে তাই পুত্রের নাম রাখা হয় অনিরুদ্ধ সেন।
পর্ব ৫
পুত্রের নাম অনিরুদ্ধ সেন অনি হলেও মৌসুমী ছেলেকে মঙ্গল বলে ডাকে সেই ছোটবেলা থেকে। কারণ ওর যেদিন জন্ম হলো সেদিন চন্দ্রে অবস্থিত মারস্ সিভিলাইজেশন সেন্টারের জন্য চূড়ান্ত সফলতার একটা দিন ছিলো। বিজ্ঞানী অরুণকুমারের বহু গবেষণালব্ধ এবং কষ্টার্জিত তত্ত্ব অনুসরণ করে মঙ্গলে সভ্যতা স্থাপনের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যায় সেদিনই। অনি জন্মানোর পর পরই অরুণ এবং মৌসুমী পরিকল্পনা করে রাখে যে করেই হোক ওরা মঙ্গলে গবেষণার কাজে চলে যাবে, অনিকে আরো অগ্রসর গবেষণায় আগ্রহী করে তুলবে। মেধার সঙ্গে লক্ষ্য স্থির করতে পারে যে মানুষ সেই তার স্বপ্নকে ছুঁয়ে উঠতে পারে সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে।
মৌসুমী অরুণ দম্পতি এবারে এক এক করে সফল হতে থাকে মঙ্গলগ্রহে নিজেদের গবেষণা দিয়ে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মঙ্গলে বসত বাড়ি তৈরি হতে থাকে। অতি সফল ও ধনী মানুষেরা কেউ কেউ শুধু মঙ্গলগ্রহ ভ্রমনেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তারা কিনে নিয়েছিলেন মন মতো অবকাশ যাপনের স্পেইস ফ্ল্যাটগুলো। আরেক দিকে উন্নত মানের স্পেইস সাইন্স সেন্টার তৈরি হতে থাকলে ধাই ধাই করে এগিয়ে যেতে থাকে আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে নিয়ে গবেষণা। সেই যে কবে ২০৩৩ সালে এক আমেরিকান মেয়ে আলিসা কারসন পাড়ি দিয়েছিলো মঙ্গল গ্রহে এবং আর ফিরে যায়নি পৃথিবীতে। তার কয়েকশ বছর পর মানুষ কতোটা দাপটে মঙ্গলে বিচরন করছে ভাবলেই বিস্মিত হয় মৌসুমী, সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে মানুষের এই আত্মত্যাগ সত্যি অনেক বড় ভূমিকা রাখে।
পর্ব ৬
অরুণকে আচমকা জড়িয়ে ধরে গলায় ঠোঁটে দীর্ঘ চুমু খায় মৌসুমী, চন্দ্রে এলে এমনটা করেই অরুণবাবুর জন্য, ও জানে এই বিশেষ স্পর্শটা অরুণ ভীষণই ভালোবাসে। তুমুল আদরের মাঝেও চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে দুজনেরই। চন্দ্রে ওদের প্রেমের বীজ বোনা আছে তাই হয়তো এমন হয়। আলগোছে চোখ মুছে নিয়ে উঠে পড়ে নভোযান মসলিনে গন্তব্য তো সেই মঙ্গলগ্রহ। বুকের ভেতর ধুন্ধুমার বেজেই চলে অজানা এক আশংকার ধ্বনি অনির জন্য তবুও এ বড় আনন্দের দিন ওদের। অনিরুদ্ধ সেন একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী এবং বিশিষ্ট নভোচারী। মানব সভ্যতায় অগ্রগতিতে অনির অবদান এতোটাই যে পৃথিবী, চন্দ্র এবং মঙ্গলে এক নামে সবাই ওকে জানে। সূর্যের নিকটবর্তী নক্ষত্র যেটা ৪,২ আলোকবর্ষ দূরে নাম তার প্রক্সিমা সেঞ্চুরি, এই নক্ষত্রের অরবিটে প্রথম নভোযান পাঠাতে সক্ষম হয় অনি তার বয়স যখন মাত্র সাতাশ বছর। তোলপাড় হয়ে যায় গ্রহে উপগ্রহে এ ঘটনায়।অনির কাজ আর বেশিদূর এগোতে পারেনি কারন সেখানে সোলার সিস্টেমের গ্রহের মতো মনুষ্যবান্ধব পরিবেশ পাওয়া যায়নি।
তবু থেমে থাকেনি অনি। দিনরাত পরিশ্রম করে গেছে অন্য একটি নক্ষত্রলোকে পৌঁছানোর স্বপ্নে। সূর্যের চাইতে কিছুটা পুরোনো সে নক্ষত্র যার নাম টাও-সেটি, বারো আলোক বর্ষ দূরে যে আছে পৃথিবী থেকে, তার কক্ষপথে ঘুরছে পাঁচ পাঁচটি গ্রহ। দুটো গ্রহতো মনুষ্য বাসের উপযোগী তা জানা হয়েছিলো সেই কবেই কিন্তু মানুষের পদচারণায় মুখর হয়নি তারা। অনির স্যাটেলাইট উপগ্রহ বিম্বিশা ৯৯৯ এরই মধ্যে ঘুরে এসে সকল তথ্য উপাত্ত নিয়ে এসেছে। তারপর দুবছর সকল ভুলে সত্যি সকল ভুলে তৈরি করেছে অনি ময়ূরপঙ্খী ৭০৭, অনির উপেক্ষা সহ্য করতে না পেরে ক্যাথরিন কবেই আংটি ফেরত দিয়ে অন্য একজনের ঘর করছে। সে বেদনাও অনি সহ্য করে নিয়েছে আরো বড় স্বপ্নের কাছে পৌঁছাবে বলে।ময়ূরপঙ্খী ৭০৭ উড়াল দেবার আগের দিনটিতে মঙ্গলে পৌঁছাবেন অরুণকুমার আর মৌসুমী সেন। একমাত্র পুত্রের এ অভূতপূর্ব সাফল্য উদযাপনের জন্যেই পৃথিবী থেকে এই বিশেষ দিনে নভোযান মসলিনে উড়াল দিলো অনির মা বাবা।
পর্ব ৭
মঙ্গলে নামতেই মনটা বিষাদে ছেয়ে যায় অরুণবাবুর কারণ এখানকার আকাশটা খুব করুণ এবং বিষন্ন গোলাপী আভার এ আকাশে কখনোই মন ভালো থাকে না তার।সভ্যতার কল্যাণে নিজ সন্তানকে হারানোর বিষয়টাও মেনে নেয়। পুত্র পাড়ি দেবে ভিনগ্রহে যেখানে কেউ আগে কখনও যায়নি আর অনির ফিরে না আসার সম্ভাবনাই বেশি।নক্ষত্র টাও-সেটির পৃথিবীতুল্য গ্রহ করোনা যেনো মৃত্যু গহ্বর ওদের জন্য। যদিও সেখানে জলের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং প্রাণের অস্তিত্বও আছে। মনের ভেতরে তীব্র শূন্যতা বোধ নিয়েও সকল আয়োজনে হাসি মুখে উপস্থিত হয় অরুণ এবং মৌসুমী। সে রাতে নৈশভোজে উপস্থিত হয় সবমিলিয়ে এগারোজন। মৌসুমী নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করে এবং পৃথিবী থেকে আনা উপহার গুলো পৌঁছে দেয় সবার হাতে। একজন খুব সপ্রতিভ মেয়েকে দেখে চোখ থমকে যায় মৌসুমীর, মেয়েটা অনির এসিস্ট্যান্ট সাইন্টিস্ট রেবেকা তাসমীম।
পরদিন এসে যায় সে মাহেন্দ্রক্ষন, উড়বে মহাকাশে নভোযান ময়ূরপঙ্খী ৭০৭, মঙ্গলের স্পেইস লাউন্জে অপেক্ষা করছে মৌসুমী সেন এবং অরুণকুমার, ওদের সঙ্গে আছে অনির সুপারভাইজার প্রফেসর নাহিদ খলিল।অনি তখনো তাম্র পোশাকটা গায়ে তোলেনি, কেমন বিক্ষিপ্ত দেখায় ওর চাহনী, মায়ের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে রেবেকাকে দেখেছো? আমি উড়াল দিচ্ছি আর ও আসেনি বিদায় জানাতে? অগত্যা পোশাকটা পরে নিয়ে পা বাড়ায় অনি দৃঢ়তার সঙ্গে… তখন পেছন থেকে ওর পিঠ খামচে ধরে কেউ! কে? কে? বলে পেছন ফিরতেই বিস্ময়ে দেখে রেবেকা, কেঁদে কেঁদে চোখদুটো ফুলে আছে, স্পষ্ট স্বরে বলে আমাকে সঙ্গে নিন স্যার।
অনি স্মিতমুখে ওর চোখে চোখ রেখে বলে মৃত্যু অনিবার্য যে রেবেকা! আপনাকে ছাড়াও আমি মৃত বলেই অঝোরে কাঁদতে থাকে মেয়েটা। কুয়াশা সরে গেলে চারপাশ যেমন স্বচ্ছ হয়ে ওঠে তেমন একে একে সবকিছু পরিষ্কার বুঝতে পারে অনি। গত দুবছর নাওয়া খাওয়া ভুলে কাজ করবার সময় হাতে কফির পেয়ালা তুলে দিয়েছে, মুখে খাবার তুলে দিয়েছে, জোর করে পাওয়ার ন্যাপ নিতে পাঠিয়েছে, সকল নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে এই মানুষটাই অথচ একে কখনো ভালো করে চোখ মেলে দেখেনি পর্যন্ত অনি। আজ প্রথমবার মনে হচ্ছে এতো মায়াভরা মুখ তার! স্বয়ং প্রেম উপস্থিত রেবেকার অবয়বে, এক ঝটকায় ওকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নেয় অনি। রেবেকা শুনতে পায় অনির হৃদস্পন্দন এই প্রথম। আনন্দ এবং একই সাথে বিষাদ নিয়ে জলভরা চোখে বিদায় জানায় অনির মা বাবা আর প্রেমকে সঙ্গে নিয়ে ভাসে ওরা, ভাসে মহাশূন্যে অনিরুদ্ধর নভোযান ময়ূরপঙ্খী।
সমাপ্ত।
লাবণ্য সায়মা রহমান
গল্পকার, চিকিৎসক; সুইডেন।