মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নিকোস পাপাস্তারগিয়াদিসের লেখা বই ‘কস্মোপলিটেনিসম এন্ড কালচার‘ পড়ছিলাম কিছুদিন আগে। সেখানে গ্রিক কবি কনস্টান্টিন ক্যাভাফি এর ‘ওয়েটিং ফর দ্যা বারবারিয়ান্স‘ নামে একটি কবিতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কবিতাটি হলো এমন, প্রাচীন গ্রিক নগরী আতঙ্কের সঙ্গে অপেক্ষা করছে শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হবে এই ভয়ে। সেই দস্যু বা বারবারিয়ানরা মুখ দিয়ে ‘বার‘ ‘বার‘ শব্দ করে করছে; কবিতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করা হচ্ছে সেই ‘বার‘ ‘বার‘ শব্দ করা শত্রুরা হয়তো যেকোনো সময় আক্রমণ করবে, কিন্তু তারা কারা বা কি চায় তার কিছুই কেউ জানে না! এরপর কবি নজর দেন ভয় আর গুজবের দিকে যেটা জনগণের মাঝে বিরাজ করছে এবং সবাইকে চরম আতঙ্কে রাখছে, তা হলো এই অদেখা, অজানা ও অপরিচিত শত্রুরা পুরো সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিবে। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, সব আতঙ্ক ও গুজবের পরে মূলত কিছুই হয় না। কোনো দস্যু আসে না, শহর জনপদ কিছুই আক্রান্ত হয় না। তবে সেই অদেখা শত্রু বা দস্যু যাই বলি না কেন সে তার উদ্দেশ ও লক্ষ্য পূরণে ঠিকই সফল হয়। আর তা হলো জনগণের দৃষ্টি স্থানান্তরিত করা। মজার বিষয় হলো সেই প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সবসময়ই আমরা সেই অদেখা শত্রুর আতঙ্কে অস্থির থাকি, যদি আমরা অস্থির না থাকি তবে রাষ্ট্র, সমাজ ও কর্তৃপক্ষ আমাদের আফিমের মতো সেই অদেখা জুজুর ভয় দিয়ে আমাদের মনোজগতকে আচ্ছন্ন করে রাখে। পৃথিবীর সকল রাষ্ট কাঠামো ও কর্তৃপক্ষই এই অদেখা শত্রুকে ব্যবহার করে নিজেদের উদ্দেশ্য ও স্বার্থ পূরণের লক্ষে।
৪ এপ্রিল ১৯৪৯ সালে ওয়াশিংটন ডি সি-তে ন্যাটো গঠন করা হয়েছিল এমনি এক অদেখা শত্রুর মোকাবিলার লক্ষে, বলাই বাহুল্য সেই অদেখা শত্রু ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, আরো পরিষ্কারভাবে সমাজতন্ত্রবাদ। যাইহোক, সেই অদেখা শত্রুর টোপ দিয়ে কালে কালে মার্কিন সাম্রাজ্যের বহু আগ্রাসনের সাক্ষী পৃথিবীবাসী হয়েছেন। যদিও মার্কিন কর্তৃপক্ষের ভাষায় তা কখনো ছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা,কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা করা আবার কখনো ছিল ওয়ার ও টেরর। আবার এই ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা‘ বা ‘ওয়ার অন টেরর বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ‘! এই টার্মগুলোরও আবার স্থান ও জাতিভেদে বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। সেই ব্যাখ্যাগুলো একটু পরে দিচ্ছি।
তার আগে ছোট্ট একটা ব্যাক্তিগত ঘটনার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। কিছুদিন আগে এবিসি নিউজে একটা অনুষ্ঠান দেখছিলাম, সঙ্গে ৯ বছরের ছেলেও দেখছিলো আমার সঙ্গে। তো সেই অনুষ্ঠানে মূলত ইউক্রেনের যুদ্ধ ও সমসাময়িক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পৃথিবী জুড়ে যে ভয়াবহ খাদ্য ঘাটতি শুরু হবে বা ইতিমধ্যে হয়েছে সেই বিষয়ে আলোচনা চলছিল। অনুষ্ঠানের একজন অতিথি বক্তা ছিলেন ইয়েমেনের রেডক্রসের প্রধান। সেই রেডক্রস প্রধান যখন ইয়েমেনের পরিস্থিতির কথা বলছিলো আমার ৯ বছরের ছেলে আমাকে প্রশ্ন করে, “মা ইয়েমেনেও যুদ্ধ চলছে অনেকদিন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে না খেয়ে কিন্তু আমরা টিভিতে শুধু ইউক্রেইনের যুদ্ধের কোথায় শুনি আর দেখি, ইয়েমেনের যুদ্ধ কেন শুনি না”? আমি আমার ৯ বছরের ছেলেকে বললাম, কারণ ইয়েমেনের যুদ্ধ আমেরিকার বন্ধু সৌদি আরব করছে। আর সৌদি আরব আমেরিকার থেকে অস্ত্র কিনছে, যদি যুদ্ধটা শেষ হয়ে যায় তবে আমেরিকা তার অস্র কি করে বিক্রি করবে? এবার আমার ছেলের প্রশ্ন ইউক্রেইনে অস্ত্র দিচ্ছে কে? বললাম সেটাও আমেরিকা আর বন্ধু দেশরা। ছেলে এবার বিরক্ত, বললো, “সবখানে শুধু ওরাই অস্ত্র দিচ্ছে!” একটা ৯ বছরের ছেলে খুব সহজ করে বর্তমান ভূরাজনৈতিক চিত্র বলে দিলো, আমি তার সরল মনকে আর জটিল কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করলাম না।
এখন কথা হচ্ছে কেন আমরা ইয়েমেনের যুদ্ধের বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা সকাল বিকাল ২৪ ঘন্টা ধরে মিডিয়াতে দেখি না বা শুনি না যখন সৌদি ও তার জোটের চলমান সাত বছরের আক্রমণে দেশটিতে এ যাবৎকালের ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন চলছে। লক্ষ লক্ষ শিশু মারা যাচ্ছে খাদ্যাভাবে; মোট ৩৭৭০০০ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণে যার ১৫০০০০ জন প্রাণ হারিয়েছে সরাসরি যুদ্ধের কারণে।
পূর্বেই বলেছি গণতন্ত্র, সন্ত্রাসী বা মানবাধিকার এই শব্দ বা টার্মগুলোর বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে স্থানকাল ও জাত ভেদে। আরো একটি সত্য হলো এই টার্মগুলো মূলত পশ্চিমা রাষ্ট্র ও শাসকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যে মানবিকতা একজন হোয়াইট এংলো সেক্সসনের জন্য প্রযোজ্য তা একজন কৃষ্ণাঙ্গ বা মুসলিম বা অন্যের জন্য প্রযোজ্য নয়। আবার বিপরীত ভাবে, একজন মুসলিম যেভাবে সন্ত্রাসী হয়ে যায় সেই ভাবে একজন সাদা ক্রিস্টিয়ান সন্ত্রাসী হয় না, এমনকি যদি সে খোলা রাইফেল নিয়ে প্রাইমারি স্কুলে ঢুকে নিঃস্পাপ শিশুদের হত্যা করে তবুও না! তখন সে মানসিক বিকারগ্রস্থ একজন, যার মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন! এই ক্ষেত্রেও মানবিকতা সেই সাদা লোকের জন্যই বরাদ্দ।
আমরা পশ্চিমা রাষ্ট্র ও তার শাসকদের মুখে মানবাধিকার, মানবতা, বিপন্ন মানবতা ও গণতন্ত্র এই সবগুলো যত বেশি শুনি ঠিক তার কতটা নিশ্চিত করা হয় বা ব্যবহার করা হয় তা নিয়ে বোধ করি আমার মতো অনেকেই সন্দিহান। মূলত এই শব্দ ও টার্মগুলো খুবই তরল যার কোনো সঠিক আকার, প্রয়োগ ও ব্যবহার নেই; মূলত পশ্চিমা রাষ্ট্র ও তার শাসকরা নির্ধারণ করেন এগুলোর ব্যবহার। তাদের বদান্যতায় ও কৃপায় তৃতীয় বিশ্বের মানবিকতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার মিলে।
মানবাধিকার ও মানবতা যে একটি বর্ণবাদী সেন্টিমেন্ট, তা মিডিয়া এবং পশ্চিমা নেতাদের বক্তব্য একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। ফিরে যাই ইয়েমেনের প্রসঙ্গে; কেন আমরা রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা প্রতিটি মিডিয়াতে শুধু ইউক্রেইনের যুদ্ধের কথাই শুনছি আর দেখছি আর দিনে নয় শুধু মাসেও একবার কেউ ইয়েমেনের মানবিক বিপর্যয়ের কথা বলছে না ? কারণ ইউক্রেইন ইউরোপের দেশ, সেই দেশের মানুষের চামড়া সাদা, নীল চোখ এবং তারা ক্রিস্টিয়ান বা জুইশ, তারা আক্রান্ত হয়েছে আমেরিকার চির শত্রুর দ্বারা! অপরপক্ষে ইয়েমেন মধপ্রাচ্যের একটি দেশ, মানুষের চামড়া বাদামী, চোখের রং নীল না, তাদের আক্রমণ করেছে আমেরিকার চরম মিত্র সৌদি!
আপনি যদি পশ্চিমা মিডিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ধারাভাষ্য শুনেন তবে লক্ষ্য করবেন কিছু শব্দ তারা খুব জোর দিয়ে হতাশার সঙ্গে পুনরাবৃত্তি করে যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই ইউরোপের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় বা যে শরণার্থীরা পালাচ্ছে তারা সিরিয়া বা আফগানিস্তানের কেউ নয় তারা ইউরোপের সাদা চামড়ার নীল চোখের মানুষ (!)। প্রথমতঃ এই বর্ণনার অর্থ এশিয়া বা মধ্যপ্রাচের বা আফ্রিকার মানুষের জীবনের দাম ইউরোপের মানুষের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যহীন, এদের শরণার্থী হওয়াটাই স্বাভাবিক, এটা নিয়ে উদগ্রীব হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। দ্বিতীয়তঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এটাই ইউরোপের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় এই কথার মধ্যে দিয়ে কসোভো বা বসনিয়াতে যে জঘন্যতম গণহত্যা সংগঠিত হলো তাকে অস্বীকার করলো। কসোভো বা বসনিয়া ইউরোপেরই দেশ তারপরেও এই নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া গণহত্যাকে কেন পশ্চিমা রাষ্ট্র বা মিডিয়ার অস্বীকার? কারণ গণহত্যাগুলো সংগঠিত হয়েছিল বসনিয়ান মুসলিম ও কসোভোর মুসলিমদের বিরুদ্ধে সার্বিয়ানদের দ্বারা।
১৯৯২ এর এপ্রিল থেকে সার্বিয়া তার জাতিগত নিধন শুরু করে বসনিয়ান মুসলিমদের বিরুদ্ধে। ১৯৯৫ পর্যন্ত ১ লক্ষ বসনিয়ানকে হত্যা করা হয় জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী। ১৯৯৫সালের জুলাই মাসে, বসনিয়ান সার্ব বাহিনী স্রেব্রেনিকা শহরের প্রায় ৮,000 বসনিয়াক পুরুষ ও ছেলেদের হত্যা করে। হলোকাস্টের পর এটি ছিল ইউরোপে সবচেয়ে বড় গণহত্যা। সেই শহরে বহু বছর পর্যন্ত পরিবারগুলোতে কোন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ছিল না।
মনে আছে নিশ্চই ২০১১ সালে যখন সিরিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় হাজার হাজার সিরিয়ান ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয় প্রার্থনা করছিলো, তখন বেশিরভাগ ইউরোপিয়ান দেশ‘ই সেই শরণার্থীদের শুধু অমানবিকতাই প্রদর্শন করেনি বরং তাদের ক্রিমিনালের মতো গণ্য করেছে। শিশু অ্যালেন কুর্দির লাশ পড়েছিল ভূমধ্য-সাগরের তীরে! পরিবারের সঙ্গে যুদ্ধবিদ্ধস্ত সিরিয়া থেকে ইউরোপ পাড়ি জমিয়েছিল দুই বছরের অ্যালেন কুর্দি একটু নিরাপদ জীবনের আশায়! পোল্যান্ড তার সীমানার তারে বৈদ্যুতিক লাইন সংযোগ করে রেখেছিলো যেন কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে কেউ ঢুকতে চাইলে বিদ্যুৎস্পষ্ট হয়েই মারা যায়! সেই পোল্যান্ডই আবার ইউক্রেনের শরণার্থীদের জন্য গরম পানীয় খাবার ও পোষাক নিয়ে অপেক্ষা করেছে? কেন? কারণ ওই যে লিখার শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম গ্রিক কবির কবিতার বারবারিয়ানদের কথা; বিগত কয়েক দশকে পশ্চিমা মিডিয়া ও রাষ্ট্রের কল্যানে সেই অদেখা দস্যু এখন মুসলিমরা, আর মানবতাও সবার জন্য প্রযোজ্য নয়, মানবাধিকার কথাটা মূলত বিলাসবহুল এলাকায় থাকে।
অদেখা এই শত্রুকে জিম্মি করে রাজনীতি ও ফায়দা লুট আজকে হচ্ছে নাএটা অতি আদিম একটা কুট কৌশল, তবে এই নিরাপত্তার ইস্যুকে জিম্মি করে ভূরাজনীতির কলকব্জা মার্কিন ও পশ্চিমারা ঘুরাচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পর থেকে শীতল যুদ্ধের শুরুও তখন থেকেই, এবং এটিকে একটি অনন্য রূপ দিয়েছে, যেমনটি অধ্যাপক নিকো উল্লেখ করেছেন, “ভয়ের নান্দনিকীকরণ” নামে! অধ্যাপক নিকো একে ব্যাখ্যা করেছে ‘পলিটিক্স অফ ফিয়ার‘ নাম যা মূলত ৯/১১ পরে চরম রূপ পেয়েছে।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান 11শে জুলাই হোয়াইট হাউসে এক বিবৃতিতে বলেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে যে ইরান রাশিয়াকে ইউক্রেনের যুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য শত শত সামরিক যান সরবরাহ করবে।
সোমবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে ইরান সরকার একটি দ্রুত সময়ের মধ্যে অস্ত্র-সক্ষম ইউএভি সহ রাশিয়াকে কয়েকশ ইউএভি সরবরাহ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।” সুলিভান আরও উল্লেখ করেছেন যে ইরান এই বছরের শুরুতে যুদ্ধবিরতি হওয়ার আগে সৌদি আরবে আক্রমণ করার জন্য ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের অনুরূপ চালকবিহীন বিমান সরবরাহ করেছে।
বলাই বাহুল্য ইতিহাসের পাতা উল্টালে মার্কিন মুল্লুক ও তার সঙ্গীদের এমন ‘ধারণা‘ ‘ বিশ্বাস‘ ও নির্ভরযোগ্য তথ্য‘ এই টার্ম ও কূটনৈতিক চালগুলোর ব্যবহার আমরা ঢের পাই। যেমন ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসাইনকে ও তাঁর দেশকে আক্রমণের আগে আমরা এমন অনেক কল্পকাহিনী ও তাদের প্রচার যেমন শুনেছি মার্কিন সরকার ও পশ্চিমা নেতাদের মুখে তেমনি শুনেছি পশ্চিমা মিডিয়াতে। এমন অনেক কল্পকাহিনীর একটি ছিল, সাদ্দাম হোসাইনের কাছে শুধু পারমাণবিক অস্ত্র‘ই নয় সঙ্গে মজুদ আছে বিপুল পরিমান বায়ো-কেমিকাল ওয়াপন বা জৈব-রাসায়নিক অস্ত্র। তৎকালীন ইউএস প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়র ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার সাদ্দামের সেই কল্পিত ল্যাবরেটরির প্রধান বিজ্ঞানীকেও সামনে হাজির করেছিল, যা পরে প্রমাণিত হয় সেই বিজ্ঞানী সাদ্দাম হোসাইনের সঙ্গে ব্যাক্তিগত রেষারেষির শোধ নিতেই এমনটা করেছিলেন। আর সাদ্দাম হোসাইনের পতনের পর সমগ্র ইরাক তন্ন–তন্নকরে খুঁজেও কোনো জীবাণু-বোমা বা এর ল্যাবরেটরি হদিস পায়নি। কিন্তু একটি জাতির কপালে তারা এনে দিয়েছে চরম দুর্ভোগ আর ধ্বংস হয়েছে ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা ও তার নিদর্শন।
আজকে পশ্চিমা মিডিয়া ও নেতাদের ইউক্রেনের প্রতি যে সমবেদনা ও সহমর্মিতা এমনটা কি প্যালেস্টাইনের জনগণের জন্য আমরা দেখেছি বা ইরাকের জনগণ বা বসনিয়ানদের জন্য? কিংবা কোনো মিডিয়া কি কখনো জানতে চেয়েছে ইরাকে বা প্যালেস্টাইনে মার্কিন বা ইসরায়েলি বোমায় আহত বা নিহতের পরিবার কেমন আছে? কিংবা আজ আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে রাশিয়ার সমালোচনায় মুখর এমনটা ইসরায়েলের বা আমেরিকার প্রতি?
আচ্ছা বাদ দিলাম ইরাক বা প্যালেস্টাইন বা আফগানিস্তানের কথা! কারণ ইরাক বা আফগানিস্তান আমেরিকার নিজ আক্রমণ আর ইসরায়েলের বিষয়ে কেউ কথা বলে এমন কোনো পশ্চিমা ও প্রাচ্যের নেতা নাই। কিন্তু ইয়ামেন? আমেরিকা কি তার মিত্র সৌদিকে কখনো নিন্দা জানিয়েছে ইয়েমেনে এই বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধের জন্য? সেখানে চলমান সাধারণ জনগণ হত্যার জন্য?
অপরদিকে, সৌদি আরব গত কয়েকদশকে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও অন্যান্য মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে তাদের কট্টর সালাফিবাদ প্রচারের জন্য বিপুল পরিমান অর্থায়ন করে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন করা কি উচিত নয় সেই কট্টর সালাফিবাদ বিশ্বাস করা একটি সরকার কেন আমেরিকার ও ইসরায়েল এত ঘনিষ্ঠজন? চিন্তার খোরাক, একটু ভেবে দেখা উচিত।
আজ বিশ্ববাসী ও পশ্চিমা মিডিয়া যেভাবে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে, এটা অব্যশই প্রশংসার দাবিদার, এত এত যুদ্ধ দেখার পর মানবজাতি হিসেবে এটাই আমাদের সকলের মানবিক ও নৈতিক দ্বায়িত্ব। কিন্তু এমনটাকি ইয়েমেনের প্রতি হওয়া উচিত নয় বা প্যালেস্টাইনের প্রতি?মানবতা যদি হ্যান্ড-পিকড বা বাছাইকৃতদের জন্য সংরক্ষিত থাকে তখন সেই মানবতা কুমিরের কাঁন্নায় পর্যবসিত হয় এবং প্রশ্নবিদ্ধ হয় তার উদ্দেশ্য! এটা শুনতে ও মানতে যতই খারাপ লাগুক না কেন, সত্য হলো আজ মার্কিন সরকার ও পশ্চিমা–বিশ্ব ইউক্রেনের পাশে কারণ এখানে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব বা এর জনগণ নয়; মূল উদ্দেশ্য রাশিয়াকে শায়েস্তা করা। মার্কিনরা সেই ৪ এপ্রিল ১৯৪৯ থেকে যা চাচ্ছিলো, যেভাবে দানবের ভূমিকায় রাশিয়াকে উপস্থাপন করে আসছিলো এতদিনে সেই রূপকথার গল্প ও রাক্ষস বাস্তবে এসেছে। এবং রাশিয়ার এই আগ্রাসনে মার্কিন ও পশ্চিমাদের চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হয় নি। কারণ এতদিনে সত্যিই রাশিয়াকে শায়েস্তা করার নৈতিক ইস্যু ন্যাটো পেয়েছে! যে ন্যাটো এতদিন শুধু ঝিমিয়েছে কাগুঁজে বাঘের মতো আজ সেই ন্যাটো উজ্জীবিত, গতমাসে শেষ হওয়া ন্যাটো সামিট‘ই এর প্রমান, যা শীতল যুদ্ধের সময়েও হয়ে ওঠেনি। ভূরাজনীতির ও পেশী শক্তির নোংরা বাস্তবতা হলো, এই যুদ্ধে পশ্চিমা সরকার ও মিডিয়াগুলো যতই মানবিকতার জামা পরে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াক না কেনো, মূলত যুদ্ধের এই আগুনে পুড়বে ইউক্রেনের সাধারণ জনগণ আর সেই আগুনে আলু পোড়া খাবে মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তি। ইউক্রেন আর এর নিরীহ জনগণ এখানে ভূরাজনৈতিক পেশী-প্রদর্শনীর বলির-পাঠা মাত্র।
মিতা চৌধুরী : চিত্রশিল্পী, লেখক, সংগঠক, প্রশান্তিকা প্রধান, মেলবোর্ন।