
গানের সূত্রেই চমির সাথে আমার পরিচয়। সময়ের সাথে চমি আমাকে ওঁর জন্য একটা গান সুর করতে বললেন। পাহাড়ী মেয়ে সাথে শাস্ত্রীয় সংগীতেও দখল আছে। তাই চমির অনুরোধ ছিল এমন একটা গান তৈরীর যেটায় পাহাড়ী সুর তো বটেই, সাথে যেন চমির গায়কী দেখানোর প্রচুর সুযোগ থাকে। তো যে কোন গানের কোন বিশেষ রিকোয়েস্ট থাকলে আমি সবসময়ই মনে করি রেডিও এনলিস্টেড গীতিকার সোমা তাহেরা চৌধুরীর কথা। সোমা আমার বন্ধু। চমিরও বন্ধু। আমাদের বন্ধু। সোমার একটা অসাধারণ গুণ হল বলার সাথে সাথে গান লিখে ফেলতে পারে! আর আমার কাছে সবসময়ই সোমার লেখা কোন না কোন গান থাকেই। প্রসংগক্রমে জানিয়ে রাখি এখন পর্যন্ত আমি সোমার লেখা তিরিশটা গান সুর করে ফেলেছি, যার বেশীর ভাগই রিলিজ হয়ে গেছে। আমি দেশের শীর্ষ স্থানীয় শিল্পীদের দিয়ে করিয়েছি সোমার লেখা গান।তো ফিরে যাই গানটির গল্পে। চমি আমাকে জানালো গানটা ওদের ‘বৈসাবী’ উৎসবে রিলিজ দিতে চান। যেহেতু পাহাড়ী মেয়ে, তাই পাহাড়ী সংস্কৃতির বিশেষ উৎসবে রিলিজ হবে গানটা – এটাই হল প্ল্যান।
এ প্রসঙ্গে এবার ছোট্ট করে একটু বৈসাবী উৎসবটা সম্পর্কে জেনে নেই।পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের প্রধান উৎসব ‘বৈসাবী’। ১৩ এপ্রিল বৈসাবী উৎসবের দ্বিতীয় দিন। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান ৩টি আদিবাসী সমাজের বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবী। এটি তাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর একটি। এ উৎসবটি ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুব, বৈসু বা বাইসু , মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত।
এই বৈসাবীর কথা মাথায় রেখেই আমি পাহাড়ী ঢং এ সুর করেছি৷ তাই মিউজিকটা আমি কি রকম চাই সেটা ডিটেল বুঝিয়ে বললাম মিউজিক ডিরেক্টর এজাজ ফারাহকে। সেই মোতাবেক গানটির দারুণ সংগীতায়োজন করলেন এজাজ ফারাহ।
তো সেই বৈসাবী উৎসবকে সামনে রেখে আমার সুরে রিলিজ হয়ে গেল চমি দেওয়ানের গান। পুরো গানটায় দারুণ ও সাবলীল উপস্থিতি ছিল মডেল পমি দেওয়ানের। পমি চমির ভাইয়ের আদরের কন্যা। স্পেশাল ট্রাইবাল ড্রেসে স্ক্রিনে পমির উপস্থিতি ছিল প্রাণবন্ত। গানটা দর্শকশ্রোতাদের কাছে দারুণভাবে পৌঁছে যাবার একটা শক্তিশালী কারণ পমির চাকমা ট্রাইবকে প্রেজেন্ট করা।
গানটি সম্পর্কে গীতিকার সোমা তাহেরা চৌধুরী বলেন,”বন্ধু চমি দেওয়ানের গায়কী ভাষাহীন করে দিলো আমাকে। সুস্পষ্ট উচ্চারণের প্রতিটা শব্দ বলে দিচ্ছে কত মমতা দিয়ে যত্ন করে গানটি গেয়েছেন চমি। সত্যি অপূর্ব! পমি মামনির এক্সপ্রেশন সত্যি অসাধারণ। হাত দিয়ে জল ছোঁয়ায়, পাতার স্পর্শ – এককথায় একাকীত্বের অনবদ্য উপস্থাপন যা গানের কথা ও সুরের সাথে অনুপম মেলবন্ধনে যুক্ত হয়েছে। বন্ধু তানিম হায়াত খান রাজিত একের পর এক চমক দেখিয়ে যাচ্ছেন সুরের অপার মুর্ছনায়। পুরাই ফিদা হয়ে গেলাম পাহাড়ি এই সুরে। আর গানের কথাগুলোকে যথাযথ সুরে অবগাহন করানোর কাজটি রাজিত নিপুন দক্ষতার সাথে করেছেন।”
এ.এফ.এম ওমর আল-ফারুক (এজাজ ফারাহ) ভাইয়ের কাজের কথা আর কী বলবো। কাজের প্রতি তাঁর আন্তরিক দায়বদ্ধতা কাজগুলোকে উচ্চমার্গে আসীন করে তোলে। আমার কাছে গান লেখাটাকে বিন্দুর মতোই মনে হয় যা থেকে হয় সিন্ধুর সূত্রপাত। গানটির ভিডিওগ্রাফিও অসাধারণ। সবমিলিয়ে একটা কমপ্লিট শিল্পের সৃষ্টি।
আমি বিশ্বাস করি, আজ থেকে বছরের পর বছর ধরে এমনকি শতবর্ষ পরেও এমন এক অনবদ্য সৃষ্টিকে মানুষ মনে রাখবে-এমনই একটি কাজ ‘পোড়ামন বোঝেনা ভালোবাসার ঋণ’ । গানটির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। গানটির শ্রোতাদের প্রতিও শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা অবিরত।”
গানটি সম্পর্কে শিল্পী চমি দেওয়ান বলেন, “ গানটার শুরু থেকে শেষ পযন্ত কত যত্ন করে রাজিত Effort টা দিয়েছেন তা দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে সত্যিকারের সংগীত অনুরাগীদের মধ্যে একজন উনি। আমি লাকী যে রাজিত, সোমা বন্ধুর লেখা গান প্রথম গাইলাম। পাহাড়ী সুরের সংমিশ্রণে অসাধারণ বেঁধেছেন গানটা রাজিত এবং সব কিছুর জন্য ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা। এজাজ ভাইয়ের মিউজিক কম্পোজিশনের উপর যেমন দারুণ দখল তেমনি পারদর্শী গানেও। আর পমি মামনির মিস্টি মিস্টি পারফরম্যান্স সব মিলিয়ে এখন মনে হচ্ছে গানটা আমার আরো ভালো গাওয়া দরকার ছিল। সে যাই হোক, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল এই গান আশাকরি ভালো লাগবে দর্শক শ্রোতাদের।”
পোড়া মন ভোলে না যে ভালবাসার ঋণ গানটি সম্পর্কে সুরকার হিসেবে আমি বলব, আসলে একেকটা গান আমার কাছে একেকটা সন্তানের মতন বন্ধু! তাই আমি এফোর্ট দেই নি:স্বার্থভাবে আমার প্রতিটা সৃষ্টিতেই। চমির পাহাড়ী গায়কী আর ক্লাসিকালের ওপর দখল মনে রেখেই এই টিউনটা করেছি। চমির কথা বলব যে চমি আমার সুরটার যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন ওঁর পারফেক্ট গায়কী দিয়ে। আমি যেরকম চেয়েছি ঠিক সেই রকমের থেকেও ভাল গেয়েছেন চমি। বিশেষ করে শুরুর হামিংটা সংযোজন চমিরই আইডিয়া! পুরো কাজটাকে একটা দারুণ টিম এফোর্ট বলা যায়। আর মডেল হিসাবে আমাদের কন্যা পমির দারুণ উপস্থিতি গানটায় প্রাণ দিয়েছে। চাকমাদের ট্র্যাডিশনাল ট্রাইবাল ড্রেস পরিহিতা পমির প্রেজেন্টেশন আমাদের পাহাড়ি সংস্কৃতিকে দারুণ ভাবে তুলে ধরেছে।”
পরিশেষে বৈসাবীর শুভেচ্ছা রইলো সবার জন্য। ‘পোড়া মন ভোলে না যে ভালবাসার ঋণ’ গানটি ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে।