রণেশ মৈত্র পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন । নিয়মানুযায়ী তাঁর যাবার বয়স হয়েছিল এই মাসেই ৯০ বছরে পদার্পণ করার কথা ছিল তাঁর । নয় নয় করে নব্বই বছরে পা দেবার আগে বিদায় নিলেও সারাজীবন মানুষটি বাংলাদেশের রাজনীতি মিডিয়া এবং লেখার জগতে থেকে গেছেন । তাঁর মৃত্যুর খবর পেলাম সামাজিক মিডিয়ায় । ভাষা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক রণেশ মৈত্র মারা গেছেন। সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ভোর ৩টা ৪৭ মিনিটে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
এগুলো তাঁর কর্মজীবনের পরিচয় বহনকারী তকমা। মূলত: জনকল্যানের রাজনীতি বলতে যা বোঝায় সে বাম ধারার মধ্য দিয়েই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু ও শেষ। আমি প্রথম তাঁর নাম শুনি আমার তরুণ বয়সে। বিশেষত: ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের পর দেশের মিডিয়ায় যখন কলাম লেখার জোয়ার আসে আমিও তাতে যুক্ত হই । চট্টগ্রাম থেকে আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, সংবাদ সহ বিভিন্ন দৈনিকে কলাম লিখতে গিয়ে তাঁর লেখার সাথে পরিচয় ঘটে আমার। তখন আমি বিরোধীদলে থাকা আওয়ামীলীগের সমর্থক। রাজপথে বিএনপি জাতীয় পার্টির আমলে নিগৃহিত আওয়ামী লীগের সুরত যে একদিন এমন হবে সেটা তখন অনুমান ও করা যায়নি। আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর সুনাম ও ইতিহাসের সত্যতার তাগিদে বঙ্গবন্ধুর দলের হয়ে লিখতে থাকায় রণেশ মৈত্রের লেখার সাথে দ্বন্দ্ব ছিল স্বাভাবিক। যতদূর মনে পড়ে হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের একটি সংকলনে আমাদের দুজনার লেখা ছাপা হয়েছিল দুটি ভিন্ন বিভাগে। একদিকে ছিল এই সংগঠনের যৌক্তিক অভিযোগের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাদের অনেক কাজের বিরোধিতা যেখানে আমার লেখাটি ছাপা হয়েছিল। অন্যদিকে ঐক্য পরিষদের সাথে সমার্থক লেখালেখি। রণেশ মৈত্র ছিলেন সেই সারিতে । তখন সঙ্গত কারণেই পরিচয়টা অনিবার্য হয়ে গেছিল ।
সে পরিচয় দেখার রূপ নেয় আরো কয়েক বছর পর তিনি যখন সিডনি এসেছিলেন । তাঁর বড় ছেলে প্রবীর মৈত্র থাকে সিডনিতে। তার বাড়িতেেই রণেশ মৈত্রের সাথে প্রথম দেখা হয় আমার । দীর্ঘদেহী ঝাঁকড়া চুলের মানুষটি যে আড্ডা প্রবণ সেটি বলে বোঝানোর দরকার পড়ে নি। কয়েক কাপ চা আর বাদাম বিস্কিট সহযোগে সে আড্ডায় আমরা তাঁর কাছ থেকে শেরে বাংলা ফজলুল হক বঙ্গবন্ধু থেকে আজকের বাংলাদেশের নেতাদের গল্প শুনেছিলাম। তিনি এবং বঙ্গবন্ধু যে এক ই কারাগারে ছিলেন তা আমরা অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকেই জেনেছি । সত্যি বলতে কি এর আগে আমি কারো কাছ থেকে এসব নেতাদের সাথে এমন নিবিড়তার গল্প শুনি নি । কিন্তু আমার সাধে তাঁর একটা বিষয়ে কিছুতেই মিল্ছিল না। তাঁর মত বাম নেতা যিনি ছাত্র জীবন থেকে পাবনায় বাম আন্দোলনের সাথে যুক্ত বামধারার প্রবক্তা তিনি কি ভাবে ড: কামাল হোসেনের মতো ডান ঘেঁষা একজন মানুষের গণফোরামের নেতা হন? কিভাবে তিনি বা পঙ্কজ ভর্টৃচার্যের মতো মানুষেরা ড: কামাল হোসেনের নেতৃত্বে কাজ করেন ? সে সব প্রশ্নের উত্তর তিনি তাঁর মত করে দিয়েছিলেন যার আর কোন ব্যাখ্যার দরকার পড়বে না কোনদিন ।

এরপর থেকে তিনি সিডনি এলেই খবর দিতেন । যেবার তাঁর ছেলের ঘরের নাতনীর বিয়েতে এসেছিলেন সেবাবের আড্ডাটা ছিল অন্য ধরণের । সিডনি শহর থেকে অনেক দূরে একটি মন্দিরের আঙ্গিনায় সে বিয়েতে উপস্হিত কয়েক শ মানুষের ভীড় এড়িয়ে রাজনীতি সমাজ আর দেশ নিয়ে গভীর সব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন আমার সাথে। বলাবাহুল্য ততদিনে সরকার দেশ রাজনীতি বিষয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গী ও পাল্টে যাওয়ায় প্রায় বিষয়েই ঐকমত্যে পৌঁছুতে পেরেছিলাম আমরা । এর পরপর ই তিনি একুশে পদক পান:। এরপর ও একবার অল্প সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল আমাদের । ভোরের কাগজের সম্পাদক সাংবাদিক আমার কিশোর বেলার বন্ধ শ্যামল দত্ত তখন আমার সিডনির বাড়িতে অতিথি। দুজনে মিলে দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁর সাথে। তেমন ই শালপ্রাংশু দীর্ঘ দেহী । প্রাণখোলা হাসি। আর কানে কম শুনতেন বলে বড় করে কথা বলা । আবার দেখা হবে এমন প্রতিশ্রুতি ও আড্ডার আশাতেই বিদায় নিয়েছিলাম সেদিন ।
আজ জানলাম আর কোনদিন দেখা হবে না আমাদের। রণেশ মৈত্র কতবড় লেখক তার বিচার করবে সময় । তবে একসময়কার সাংবাদিক আজীবন বামধারার সাথে যুক্ত এই মানুষটির দেশপ্রেম ও অসাম্প্রদায়িক কর্মকান্ড থাকবে ইতিহাসের পাতায় । এমন মানুষ এখন বিরল। রণেশ মৈত্রের আত্মার শান্তি কামনা করি। পোড় খাওয়া মানুষের নেতা জীবনব্যাপী আদর্শ লালন করার এমন মানুষ আমাদের দেশে খুব কম জন্মায় । পাবনায় বসবাস করেও তিনি ছিলেন জাতীয় এটিও বড় একটি বিষয় । প্রণাম রণেশ মৈত্র।
অজয় দাশগুপ্ত : ছড়াকার, কলামিস্ট, সিডনি।