রবীন্দ্র-সাহিত্যের চলচ্চিত্র রূপায়ণে সত্যজিৎ রায় । হুমায়ূন আহমেদ শ্রাবণ

  
    

বাংলা শিল্প সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায় দু’জন মহামানব। তারা দু’জনই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, শিল্পে তাদের অবদান আজও সারা বিশ্বের কাছে মহিমান্বিত। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কিংবদন্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বাংলা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায় বললেও ভুল হবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য থেকে বহু নির্মাতা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এবং এখনো করছেন। কিন্তু তাঁর সাহিত্যের সার্থক চলচ্চিত্র রূপায়ণে সবচেয়ে এগিয়ে সত্যজিৎ রায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঁচটি সাহিত্য কর্ম নিয়ে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ১৯৬১ সালে তিনটি ছোট গল্প পোস্টমাস্টার, মণিহারা ও সমাপ্তি নিয়ে নির্মাণ  করেন “তিন কন্যা” চলচ্চিত্র। এরপর ১৯৬৪ সালে নষ্টনীড় গল্প অবলম্বনে নির্মাণ করেন “চারুলতা”। ১৯৮৪ সালে “ঘরে বাইরে” উপন্যাস নিয়ে নির্মাণ করেন একই নামের চলচ্চিত্রটি। এছাড়াও ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে নির্মাণ করেন “রবীন্দ্রনাথ” নামক তথ্যচিত্র।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সাহিত্য ও চলচ্চিত্র দুইটি ভিন্ন শিল্প মাধ্যম। তারা নিজ নিজ মাধ্যমে সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত। সাহিত্য থেকে পৃথিবীতে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সাহিত্যের চলচ্চিত্র রূপায়ন খুব সহজ কাজ না। এজন্য অনেকে ব্যর্থও হয়েছেন। সত্যজিৎ রায় তার চলচ্চিত্রের প্লট নির্বাচনে সাহিত্যের আশ্রয় নিয়েছেন বহুবার। নিজেও একজন ভালো কথা সাহিত্যিক ছিলেন। প্রত্যেক শিল্পের ধরণ ও চাহিদা অনুযায়ী তার রূপের পরিবর্তন ঘটে। চলচ্চিত্রে দৃশ্য-শব্দ-সংগীত দিয়ে যেভাবে গল্প বলা যায়, উপন্যাসে সেভাবে যায় না। উপন্যাসে বাক্য দিয়ে যত সহজে যেকোনো কিছু বলা যায়, চলচ্চিত্রে বলা যায় না। চলচ্চিত্রের বড় উপাদান সময়। সেটাকে ব্যবহার করে সত্যজিৎ সাহিত্যের নির্যাসকে নিয়ে রবীন্দ্র সাহিত্যের চলচ্চিত্র রুপায়ন করেছেন। গল্পের ভাবনা ঠিক রেখে চলচ্চিত্রে অনেক কিছু সংযোজন-বিয়োজন রূপান্তর ঘটিয়েছেন। কখনো মূল চরিত্র কে বাদ দেননি তিনি। চলচ্চিত্রের সার্থক রূপদানের জন্যই এই নবনির্মাণ। নিজের দর্শনকেও চলচ্চিত্রে রেখেছেন। চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র সাহিত্য খুঁজতে গেলে বিভ্রান্ত হতে হবে। ভিন্ন মাধ্যমে তারা নিজ নিজ অবস্থানে অনেক বেশি নান্দনিক।

তিন কন্যা চলচ্চিত্রের প্রথমটি ‘পোস্টমাস্টার’ দ্বিতীয়টি ‘মনিহারা’ এবং শেষটি ‘সমাপ্তি’। ‘পোস্টমাস্টার’ রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোট গল্প। এই গল্পে পোস্টমাস্টারের কোন নাম উল্লেখ নেই। সত্যজিৎ তাঁর চলচ্চিত্রে পোস্টমাস্টারের নাম দিলেন ‘নন্দলাল’ এবং রতনের বয়স কমিয়ে নয়-দশ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে পার্থক্য তৈরী হলো মূলগল্প এবং চলচ্চিত্রের মধ্যে। গল্পে পোস্টমাস্টারের উলাপুর গ্রামে আগমন এবং তার চরিত্রের বর্ণনার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। চলচ্চিত্রে আমরা দেখি নন্দলাল বাবুর গ্রামে পোস্টমাস্টার হিসেবে আগমনের পর একজন ব্যক্তি কাজ বুঝিয়ে রতনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং ম্যালেরিয়া সম্পর্কে সচেতন করেন। চলচ্চিত্রে আমরা দেখি পোস্টমাস্টার চেয়ারে বসতে গিয়ে চেয়ার ভেঙে উঠানে পড়ে যায়। উঠানে বসে সিগারেট ধরালেন এক পাগলের আবির্ভাব ঘটে যাকে দেখে পোস্টমাস্টার ভীত হয়ে পড়েন এবং রতন সাহায্য করে। এসব দৃশ্য দিয়ে নির্মাতা পোস্টমাস্টার এর জন্য গ্রামের পরিবেশ সুখকর হবে না বুঝিয়ে দিলেন। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে পাগলের প্রলাপ শুনতে পেলে পোস্টমাস্টার “রতন” বলে ডেকে ওঠে এর মধ্য দিয়ে রায় বুঝালেন রতনের প্রতি পোস্টমাস্টারের নির্ভরতা। বিষয়গুলো সংযোজন না করলে রবীন্দ্রনাথের সূচনায় যে বর্ণনা তা ফুটে উঠত না। এর পরের ঘটনা অনেকটাই গল্পের বর্ণনার মতো এগিয়ে যায়। গল্পের শেষ অংশ যে বর্ণনা এবং চলচ্চিত্রের শেষ দিকের শেষের দিকের দৃশ্যায়নের ভিন্নতা দেখা যায়। গল্পের শেষে যে বিচ্ছেদ যা আমরা সংলাপ এবং বর্ণনা দিয়ে অনুভব করি, চলচ্চিত্রে কান্নার দৃশ্য এবং পোস্টমাস্টারের ডাকে রতনের সারা না দেয়া দেখে অনুভব করি। রতন নতুন পোস্টমাস্টারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের গল্পের শেষে যে গতিময়তার দর্শন পাওয়া যায় নদী ও নৌকার বর্ণনা দিয়ে সেই দৃশ্য অনুপস্থিত।

সত্যজিৎ রায়

রবীন্দ্রনাথের মণিহারা গল্পের মূল চরিত্র ফণিভূষণ সাহা আর সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে মণিমালিকাকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে। গল্পে ফণিভূষণের বর্ণনা দিয়ে শুরু, চলচ্চিত্রে শুরু থেকে স্কুল মাস্টারকে পাই এবং তার বর্ণনায় গল্প শুনি গল্পের ফণিভূষণ রাচি থেকে বায়ু পরিবর্তনের জন্য সস্ত্রীক নদীতীরের বাড়িতে থাকতে আসে। কিন্তু চলচ্চিত্রের মণিমালিকার সাথে ফণির আত্মীয়-স্বজনের বনিবনা না হবার জন্য এই বাড়িতে থাকতে আসেন। মূলত মণিমালিকার চরিত্রের নেতিবাচক একটি দিক ফুটিয়ে তুলতে সত্যজিৎ এই পরিবর্তন আনলেন। রবীন্দ্রনাথের মণিমালিকা আটপৌরে গৃহবধূ এবং সহজবোধ্য কিন্তু চলচ্চিত্রে সহজবোধ্য নয়, চলচ্চিত্রে মণিমালিকার লালসার অভিব্যক্তি বেশি ফুটে উঠেছে। গল্পের ফণীভূষণ হরতকি রেশম এবং কাঠের ব্যবসায়ী আর চলচ্চিত্রে পাটের ব্যবসায়ী। দুই ক্ষেত্রেই ফনিভূষণ স্ত্রী ভক্ত, অনেকটা গোবেচারা। গল্পের আরেকটি অন্যতম চরিত্র মধুসূদন। চলচ্চিত্রে মধুসূদন লোভী, মেরুদণ্ডহীন এবং মণির অতীতের সাথে জড়িত ইঙ্গিত পাওয়া যায়। চলচ্চিত্রে মধুসূদনের উপস্থিতি অনেক বেশি এবং মণিমালা সাথে কথোপকথনের অনেক গুলো দৃশ্য দেখা যায় যা গল্পে অনুপস্থিত। নির্মাতা মূলত মণিমালিকার চরিত্রের নানা দিক ফুটিয়ে তুলতে সংযোজন করেছেন দৃশ্যগুলো। গল্পে ফণিভূষণ কলকাতায় থাকাকালীন জেনেছিল মণিমালিকা গয়না নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে।এই প্রেক্ষিতে খোজাঁ, এরপর তল্লাশির যে প্লট সেটি চলচ্চিত্রে নেই। সমগ্র ছবি জুড়ে মণিমালিকা ও তার অলংকার এর প্রতি তীব্র আসক্তি। শেষ অংশে সবচেয়ে বড় রূপান্তর আমরা দেখি ফণীভূষণের মধ্য দিয়ে। গল্পে তিনি রক্তমাংসের মানুষ কিন্তু চলচ্চিত্রে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া হাস্যকর ভূত। তার এই পরিবর্তন দর্শককে হাসিয়েছে প্রবল ভাবে। তাই রবীন্দ্রনাথের মণিহারা এবং চলচ্চিত্র মণিহারা ভিন্নভাবে এগিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের সমাপ্তি গল্পটি মূলত পল্লী বাংলা এবং পল্লী বালিকা মৃন্ময়ীর গল্প।গল্পে মৃন্ময়ী নির্লজ্জ, ভয়হীন, হাবভাবহীন। চলচ্চিত্রে ডানপিটে ও বুদ্ধিমতী। গল্পের নায়ক অপূর্ব নাম পরিবর্তন হয়ে ‘অমূল্য’ রাখা হয়েছে। চলচ্চিত্রে গল্পে কবিগুরু অনেকগুলো চরিত্র এবং ধীরে ধীরে চরিত্র বিকাশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ অমূল্য মৃন্ময়ীর সম্পর্ককে কেন্দ্র করে ঘটনা এগিয়ে নিয়েছেন। রাখাল চরিত্রটি চলচ্চিত্রে থাকলেও গল্পের মত গুরুত্বপূর্ণ নয়, শুধুমাত্র খেলার সঙ্গী। চলচ্চিত্রে নতুন চরিত্র সংযোজিত হয়েছে সেটি কাঠবিড়ালি। তার জন্যই মৃন্ময়ী গাছ বেয়ে বাড়ি থেকে রাতে বের হয়ে যায়। গল্প কিংবা চলচ্চিত্র উভয় ক্ষেত্রে অপূর্বের মা অথবা আমূলের মা চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ। গল্পে মা মনে করে তার কথাই শেষ কথা। কিন্তু চলচ্চিত্রে এই ভাবনা প্রকাশ করে না। ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। সময়ের পরিবর্তনে মায়েদের চরিত্রের সূক্ষ্ম পার্থক্য সত্যজিৎ অনুভব করেছিলেন। এই পরিবর্তনের জন্য মৃন্ময়ীর ভাবনাতেও ভিন্নতা দেখা যায়। গল্পে মৃন্ময়ী অপূর্বকে স্বামী হিসেবে যত সহজে মেনে নেয়,চলচ্চিত্রে তা নয়। মৃন্ময়ী স্বামী হিসেবে তাকে স্বীকার করে না।গল্প ও চলচ্চিত্র দুটিই ক্ষেত্রে সমাপ্তি খুব আকর্ষণীয়। গল্পকার মিলনের দৃশ্যে পরিবারের অন্য সদস্যদের রেখেছেন কিন্তু চলচ্চিত্রে তা নয়। চলচ্চিত্রে এ সমাপ্তি খুবই সংক্ষিপ্ত এবং ইঙ্গিতপূর্ণ। অমূল্য মৃন্ময়ী মিলন এবং মায়ের আগমন দেখে তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করা দৃশ্য দিয়ে তাদের গভীর বন্ধনের ইঙ্গিত দিয়ে শেষ হয়।

রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ গল্পটি ৬৪ বছর পর সত্যজিৎ নির্মাণ করেন ‘চারুলতা’,যা নষ্টনীড় গল্পের মূল চরিত্রের নাম। ‘নষ্টনীড়’ গল্পটি একটি বাড়ি এবং তার বিভিন্ন চরিত্র কেন্দ্র করে এগিয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র চারুলতাকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে। নষ্টনীড়ের শুরুটা হয় ভূপতির কাগজ ব্যবসার বর্ণনা দিয়ে। আর চলচ্চিত্রে শুরু থেকে আমরা চারুলতাকে পাই। শুরুতে তার একা সময় কাটানোর শৈল্পিক দৃশ্য গুলো দেখতে পাই। ভূপতির সাথে তার সম্পর্ক দৃশ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুললেন নির্মাতা। চারুলতা দূরবীন দিয়ে দেখলেন ভূপতিকে, যেন ভূপতি অনেক দূরের কেউ। গল্পে যেখানে অমর ওই বাড়িতে থাকতো শুরু থেকে, সত্যজিৎ আনলেন ঝড়ের সিকুয়েন্স দিয়ে। ঝড়ের মতো অমলের আগমন ঘটলো চারুলতার জীবনে। অমলের সান্নিধ্যে নিজেকে খুঁজে পায় চারুলতা। চলচ্চিত্র ভূপতির পরামর্শে চারুলতা অমল চারুলতার সাহিত্য সঙ্গী হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্রে যে দৃশ্য ভূপতি অমলের বিবাহ সম্বন্ধ নিয়ে আসে এবং পরে অমলকে প্রলোভন দেখায় বিয়ের সে বর্ণনা আমরা গল্প পাইনা। সত্যজিৎ তাদের সম্পর্কের ভাবনা দর্শকদের স্পষ্ট করতে এইদৃশ্য সংযোজন করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা নিজের মনোভাব গোপন রাখতে পারদর্শী, সংযত। তার মনের অবস্থা দর্শকদের বুঝাতে দোলনায় চারুলতা দোল খাওয়ার দৃশ্য দারুণ রূপক অর্থে দেখালেন। চলচ্চিত্রের চারুলতার গল্প ভাবনা ছোটবেলায় গ্রামের দৃশ্য ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে দেখতে পাই, যা গল্পে অনুপস্থিত। উমাপদের অসততা ও চুরি করে চলে যাওয়া প্রকাশ্যে আসলে ঘরে অস্বভাবিকতা দেখা যায়। অমল অনাকাঙ্ক্ষিত অপরাধ বোধ থেকে পালিয়ে যায়। এই ঘটনার পর চারু ভেঙে পড়ে কিন্তু দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে। একদিন অমলের চিঠি আসলে চিঠিতে তেমন কিছু উল্লেখ না থাকায় কান্নায় ভেঙে পড়ে। চারুকে কান্না করতে  দেখে ফেলে ভূপতি। বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় ভূপতি। যখন ফিরে আসে চারু হাত বাড়িয়ে দেয় ভূপতির দিকে, ভূপতিও সংশয় নিয়ে হাত উঁচু করে। এখানে শেষ হয় দৃশ্য যা দিয়ে বোঝা যায় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। চলচ্চিত্রের এসব দৃশ্য গল্পের ভিন্ন রূপান্তর দেয়। দেশের বাহিরে চলচ্চিত্রটি প্রশংসিত হলেও চলচ্চিত্র মুক্তির পর সমালোচনায় পড়েছিলেন সত্যজিৎ।

রবি ঠাকুরের সাহিত্য নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সর্বশেষ চলচ্চিত্রটি “ঘরে-বাইরে”। স্বদেশী আন্দোলনের ভূমিকা পটভূমিকায় “ঘরে বাইরে” উপন্যাসটি রচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  স্বদেশী আন্দোলনের নেতিবাচক দিক কে সমর্থন করেননি। আগুনের দৃশ্য দিয়ে সত্যজিৎ চলচ্চিত্র শুরু করলেন। চলচ্চিত্রে বারবার এ আগুন দেখা যায়। এই আগুন দেশ-সমাজ-ঘর সবখানে যে অবস্থা তা বোঝাতে রূপক অর্থে ব্যবহার করছিলেন। “ঘরে বাইরে” উপন্যাসটি ডায়রির আঙ্গিকে লেখা। সত্যজিৎ সংলাপের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র রূপ দিলেন।  উপন্যাস শুরু হয় বিমলার মায়ের সতীত্বের প্রতি বিমলার আবেগের বর্ণনা দিয়ে। কিন্তু বিমলার মায়ের প্রসঙ্গ সত্যজিৎ চলচ্চিত্র রাখলেন না। উপন্যাসের বিমলা সন্দ্বীপের বক্তব্য শুনে নিজে থেকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর কথা লিখে নিখিলেশকে বলেছিল। চলচ্চিত্রে নিখিলেশই সন্দ্বীপের সাথে বিমলার  আলাপ করার প্রসঙ্গ এনেছেন। অন্যান্য অংশ ঘটনার মতো করে চলচ্চিত্র এগিয়েছে বেশিরভাগ। চলচ্চিত্রের সমাপ্তি ও গল্পের শেষ ভিন্নভাবে হয়েছে। গল্পের শেষে দাঙ্গা থামাতে গিয়ে নিখিলেশ আহত হয়। কিন্তু চলচ্চিত্রে নিখিলেশের মৃত্যু দেখানো হয়েছে। সত্যজিৎ নিজের মত করে চলচ্চিত্র শেষ করলেন বিমলাকে বিধবা দেখিয়ে। বস্তুত চলচ্চিত্রে চরিত্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক একটি সরলরেখার রেখাচিত্রের টানে চিত্রিত। এই ছবিতে প্রথমবারের মতো সত্যজিৎ চুম্বন দৃশ্য দেখান। বিমলার সন্দ্বীপের কাছে আত্মসমর্পণ বোঝাতে এই দৃশ্য যোগ করা হয়।

সাহিত্য যা দেয়,চলচ্চিত্র সবসময় তা নাও দিতে পারে। সাহিত্যের মতো করে গল্প বলে যাওয়া চলচ্চিত্রের কাজ নয়। চলচ্চিত্র নিজের গতিতে এগিয়ে চলে। সত্যজিৎ তার নির্মাণে অনেক পরিবর্তন আনলেও গল্পের মূল ভাবনা থেকে সরে যাননি। চিত্রায়নে নিজের সময়ের চরিত্রের ছাপ রেখেছেন। তার সার্থক চলচ্চিত্র আমাদের চলচ্চিত্রায়নের জন্য আজও চলচ্চিত্রগুলো জীবিত হয়ে আছে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-

“ছায়াচিত্র এখনো পর্যন্ত সাহিত্যের চাটুবৃত্তি করে চলেছে তার কারণ কোনো রূপকার আপন প্রতিভার বলে তাকে এই দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারেনি”

সত্যজিৎ রায় তার চলচ্চিত্র দিয়ে রবীন্দ্রনাথের আকাঙ্খা পূরণ করেছেন।

তথ্যসূত্রঃ

● উল্লেখিত গল্প-উপন্যাস এবং চলচ্চিত্র
● Satyajit Ray : Inner Eye – Andrew Robinson
● Tagore through the lens,  Ray cinematic vision –  Jirayudh
● বিষয় চলচ্চিত্র- সত্যজিৎ রায়।

হুমায়ূন আহমেদ শ্রাবণ
শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা, বাংলাদেশ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments