রাতের প্যাসেঞ্জারের সুক্কুরের কথা মনে আছে কি? এক রহস্য মানব তার পায়ে গুলি করে গ্যাংগ্রিনের অপারেশন করেছিল, তার হাতে তুলে দিয়েছিল এক বান্ডিল টাকা। সেই ঘটনার পর বদলে গিয়েছিল সুক্কুরের জীবন যাত্রা। সে জুয়া খেলা, গাঁজা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। তার মেয়েটা এখন স্কুলে যায়। ফেরেস্তারূপী মানুষের দেয়া বান্ডিলে পেয়েছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা, সে টাকা সে খরচ না করে বিনা সুদে ধার দিয়েছিল শেফালিকে। তার চায়ের দোকানে জমজমাট ব্যবসা, এখন আর শরীর বেচতে হয় না। সুক্কুর একটা গ্যারেজ দিয়েছে, অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী গ্যারেজ ছাড়াও ভাড়ায় চলছে অটো রিক্সা। তবে এখনও সুক্কুর রাত গভীর হলে মোটরসাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে পথে। যতটা না যাত্রীর খোঁজে তার চেয়েও বেশি সেই ফেরেস্তার খোঁজে। সুক্কুরের সুখের গল্প না হয় থাক, অন্য এক রাতের আরোহীর গল্প শোনাই।
হরি হামাগুড়ি দিয়ে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে চলছে, কত সময় ধরে চলছে মনে করতে পারছে না। মাঘ মাসের শীতের রাত, শিশিরে সমস্ত শরীর ভিজে গেছে। বাম পা টা আর সামনে টানতে পারছে না। হাঁটুর নিচে পেছনের দিকে ধারালো দা-এর কোপ পড়েছে। হরি একটু থামে, মোবাইলের টর্চ জ্বেলে পায়ের দিকে তাকালো। তাকাতেই ওর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। হরি রক্ত ভয় পায়, মাফলার দিয়ে পা বেঁধেছিল, পুরো মাফলার এখন রক্তে ভেজা। গায়ের জ্যাকেটের ভেতর গেঞ্জিটা খুলে ফেলে। পায়ের মাফলারটা খুলতেই দেখে টপ টপ করে রক্ত পড়ছে। কাঁটা অংশে ধান ক্ষেতের নরম মাটি লেপ্টে দেয়। গেঞ্জিটা ছিঁড়ে শক্ত করে বাঁধে। ঠান্ডা মাটির কারণে কাটা জায়গায় আরাম বোধ করে। জ্যাকেটটা গা জড়িয়ে, একটা সিগারেট ধরায়। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে হা ভগবান কেন এই পথে আনলে !
সিগারেটের দম নিয়ে হরি আবার হামাগুড়ি দিয়ে চলতে শুরু করে। আধাঘণ্টা চলার পর ধান ক্ষেত শেষ হয়ে যায়, ধান উঠে যাওয়ায় সম্মুখের মাঠ ফাঁকা। হরি ধান ক্ষেতের ভেতর থেকে মাথা গলিয়ে সামনের দিকটা দেখার চেষ্টা করে। কুয়াশা খুব ঘন না হলেও খুব বেশি দুর দেখতে পাচ্ছে না। কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করে মানুষের গুঞ্জন আছে কিনা! মানুষের সাড়া না পেয়ে ধান ক্ষেতের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে উঠে দাঁড়ায়। মনের মধ্যে সংশয় যেখান দিয়ে চলা শুরু করেছে ঘুরেফিরে সেখানেই ফিরে আসলো কিনা! শেষে সব সংশয় ঝেড়ে ফেলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। কিছু দূর যেতেই রাস্তা দেখতে পায়। রাস্তাটা দেখেই সস্তি পায়, বুঝতে পারে গ্রামের রাস্তা নয় হাইওয়ে। হাইওয়েতে উঠে রাস্তার পাশে একটা শিশু গাছে হেলান দিয়ে বসে। পায়ের কাটা অংশের দিকে তাকাতে ভয় পায়। মনে মনে ভগবানকে ডাকে – ভগবান আমাকে বাঁচাও, আমি এবার ভালো হয়ে যাবো।
ভগবান বুঝি ওর ডাক শুনতে পায়, কিছুক্ষণ পর দেখে দুর থেকে একটা আলো আসছে ছুটে। ভগবানকে ডাকার মাত্রা বেড়ে যায়, ভগবান মোটরসাইকেল/ অটোরিকশা যাই হোক এখানে যেন থামে। আলোর বৃত্তটা কাছাকাছি আসতেই বুঝতে পারে যানবাহনটা মোটরসাইকেল। হরি প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মোটরসাইকেলটা হরির কাছে এসে দাঁড়ায়। স্বাভাবিক উচ্চতার একজন বাইক আরোহী, মাফলার দিয়ে মাথা মুখ মোড়ানো তাই চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। হরি দ্রুত মোটরসাইকেলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোমর থেকে পিস্তল বের মোটরসাইকেল চালকের দিকে তাক করে ধরে একটু চিৎকার করে বলে: কোন চালাকি করবি না, চাবি বাইকে রেখে নেমে নেমে যা।
লোকটা দ্রুত মোটরসাইকেলের চাবি হাতে নিতেই, হরি আবার চিৎকার করে ওঠে: এরপর উল্টোপাল্টা করলে ডাইরেক্ট গুলি করে দেব। কোন ফাজলামি করবি না চাবিটা ছুড়ে দে।
লোকটা চাবির গোছা ছুড়ে মারে, চাবির গোছা হরির ডান হাতের কব্জি বরাবর আঘাত হানে। চাবির রিং এর সাথে ভারী ধাতব কিছু ছিল। ব্যাথায় হরি কুঁকড়ে ওঠে, পিস্তলটা দুড়ে ছিটকে পড়ে। হরি ঘুরে পিস্তলের দিকে যেতে চাইলে কাটা পায়ের ব্যাথায় যেতে পারে না। ততক্ষণে মোটরসাইকেল চালক পিস্তল এবং চাবি কুরিয়ে নেয়। হরি রাস্তার উপর বসে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। বিলাপ করতে লাগলো ভাই আমার ভুল হয়ে গেছে আমারে মাফ করে দেন। লোকটা কাছে আসতেই বলতে লাগলো ভাই আমারে বাঁচান, আমারে একটা হাসপাতালে ছেড়ে দেন।
লোকটা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে, যেন হরির কথা শুনতে পাচ্ছে না। ধীর স্থির ভাবে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকে, মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। সিগারেট শেষ করে মোটরসাইকেল এর দিকে ফিরে যায়, একটা টর্চ লাইট এনে হরির মুখে ধরে। হরির মনে হচ্ছে হাজার ওয়াটের আলো চোখের উপর পড়েছে, আলোর দিকে তাকাতে পারে না। মুখ ঘুরিয়ে নিলে লোকটা ঘুরে আলো ফেলছে। হরি তার সাথে আবারো কথা বলতে চাইল কিন্তু সে নিরুত্তর। হরির কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। লোকটা আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে চোখে আলো ফেললো। তারপর প্রথমবার কথা বলল: কিরে বিড়ি খেতে মন চায়?
ভয় ডরের পরিস্থিতিতেও বিড়ির কথা শুনেই, ওর সিগারেটের তেষ্টা পায়। কোন কিছু না ভেবেই বলে হমম।
লোকটা: বিড়ি আছে সাথে? নাকি আমি দেব?
আছে বলে, জ্যাকেটের ভেতর থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে। খুলে দেখে একটাই সিগারেট, সিগারেটটা বের করে প্যাকেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করে ভাইজান ধরামু। লোকটা অনুমতি দিতেই সিগারেটটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দেয়। ধোঁয়া ছাড়তে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। কুয়াশা কিছুটা কেটে গিয়েছে, যেটুকু আছে সে কুয়াশা ভেদ করে জ্যোৎস্না এসে মুখের উপর পড়ে। মনের ভেতর একটা কু ডাক দেয়, হরির মনে হচ্ছে এটাই তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। সে মরতে যাচ্ছে, পাশের লোকটা হয়ত যমদূত। আচ্ছা যমদূত দেখতে কেমন হয় ! প্রশ্ন মনে এলেও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে না। এই মুহূর্তে ঠাকুরমার মুখখানা মনে পড়ছে, হরি মরে গেলে ঠাকুরমার কি হবে ? ঠাকুমার চিকিৎসা কেমন করে হবে? মন খারাপ লাগছে, সিগারেটটা ফুড়িয়ে আসছে। নিজের মনকে বুঝ দেয় – ভগবান দেখবেন।
লোকটা হুট করে জিজ্ঞেস করে: কি বাঁচতে ইচ্ছে করে? হরির বুকের ভেতর ছ্যাত করে ওঠে, মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কুয়াশায় ঢাকা ছায়া মুর্তির মত মানুষটার দিকে।
লোকটা আবার বলে: বাঁচার জন্য একটা উপায় আছে, সত্য কথা বলা। আমি যা কিছু জিজ্ঞেস করব তার সত্যি জবাব দিতে হবে। মিথ্যে বললে আমি তোমাকে রেখে চলে যাব, পায়ের রক্ত ক্ষরণে সকালের মধ্যে মারা পড়বে। কথা শেষ করে লোকটা আরো একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে পা কেটেছে কিভাবে?
হরির জিভটা আরস্ট হয়ে যায়, সব জড়তা কাটিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে ডাকাতি করতে গিয়ে পা কেটেছে। ডাকাতির সময় গ্রামের লোকজন টের পেয়ে যায়। পালানোর সময় পেছন থেকে খেজুর গাছ কাটার দা ছুড়ে মারে। সেই দা পায়ের মাংসে কেটে ভেতরে ঢুকেছে। সেই অবস্থায় দৌড়েছি। পরে ধান ক্ষেতের ভেতর ঢুকে দা বেড় করে মাফলার দিয়ে বেঁধেছি।
সত্যি কথা বলায় একটা অন্যরকম অনুভূতি টের পায়, কথা শেষ হতেই লোকটা মোটরসাইকেলের দিকে হেঁটে যায়। হরি ভাবল সত্যি কথাটা লোকটা মেনে নিতে পারছে না, তাই হয়তো ওকে ফেলে চলে যাচ্ছে। হরি পিছু ডাকের তাগিদ অনুভব করে না, গেলে যাক, জীবনের প্রতি কোন টান অনুভব করে না। লোকটা মোটরসাইকেলের টুলবক্স খুলে কি সব বের করে ফিরে কেটে যাওয়া পা বের করতে বলে। গেঞ্জির বাঁধন খুলে পানি দিয়ে ধুয়ে, একটা কাপড় পেঁচিয়ে টেপ দিয়ে বেঁধে দেয়। তারপর বলে – চলো এবার যাওয়া যায়। হরির সব কিছু অবিশ্বাস্য লাগছে, অবাক লাগছে ডাকাত শোনার পরেও কেউ সাহায্য করে!সামনের মানুষটাকে তার মানুষ বলে মনে হচ্ছে না, দেবদূত বলে মনে হচ্ছে।
লোকটা মটরসাইকেল স্টার্ট করে, হরি পিছু পিছু গিয়ে তার পেছনে বসে। চলতে চলতে লোকটা প্রশ্ন করতে শুরু করে।
– ডাকাতি কি পেশা?
– না, এই প্রথমবার।
– সংসার চলে কিভাবে?
– আমি অটো চালাই, সংসার বলতে আমি আর ঠাকুরমা। সংসার ঠাকুরমাই চালায় মানুষের বাড়ি কাজ করে।
– নেশা করো?
– নেশা বলতে গাঁজা খাই, মাঝে মাঝে বাংলা মদ।
– ইয়াবা টিয়াবা খাও না?
– নাহ, দু একবার খেয়ে দেখছি ভালো লাগে না।
– জুয়া খেলো?
– মাঝে মাঝে খেলি তয় নেশা নাই।
– মেয়ে মানুষের দোষ আছে?
– না ভাইজান, একজনকে পছন্দ করি। সে আমারে ভাও দেয় না।
– যেসব দোষ আছে তাতে তো ডাকাতির দরকার হয় না। তাইলে ডাকাতি করতে আসছো কেন?
– বাপ মা মরা ছেলে আমি, মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে ঠাকুমা আমাকে বড় করেছে। ঠাকুমার পেটের ক্যানসার ধরা পড়েছে, রাতভর যন্ত্রনায় ঘুমোতে পারেনা। চিকিৎসার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা দরকার। কেউ লোন দেয় না, বেচার মত কিছু নেই। ঠাকুমাকে বাঁচাতেই ডাকাতি করতে আসা।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতায় চলার পর একটা ব্রীজের উপর মোটরসাইকেল থামিয়ে সিগারেট ধরায়, হরিকে একটা দেয়। সিগারেট ধরিয়ে জিগ্যেস করে – আবার কি ডাকাতি করবে? হরি বলে না ভাই বেঁচে ফিরলে বাপের ভিটে বেঁচে ঠাকুরমার চিকিৎসা করাব তাও আর এই পথে আসবো না। লোকটা কোমর থেকে হরির পিস্তলটি বের করে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে।
ওরা আবার চলতে শুরু করে, চলতে চলতে কথা – পড়ালেখা জানো।
হরি: ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি।
সিগারেট শেষ হতে হতে হরি অসুস্থ বোধ করে মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে পড়বে। ভাই আমার খুব খারাপ লাগছে মনে হচ্ছে মারা যাচ্ছি। লোকটা মোটরসাইকেল থামায়। নিজের মাফলারটা খুলে দেয়। তোমার কোমর পেঁচিয়ে আমার কোমরে বেঁধে ফেল। হরি মাফলার দিয়ে নিজেকে লোকটার সাথে বেঁধে ফেলে।
হরির জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিষ্কার করে হাসপাতালের ছোট এক কামরায়। পরিপাটি গোছানো কামরা, এয়ার কন্ডিশনার চলছে তাই একটু শীত শীত লাগছে। রুমের ভেতর সকালের আলো এসে পড়েছে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে গতকালকের নোংরা পোশাক বদলে ফেলা হয়েছে, হাতে স্যালাইন চলছে। হরির টেনশনে কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। এই হাসপাতালের বিল মেটাবে কিভাবে! সুস্থ হবার পর পালানো ছাড়া গতি নেই। মাথা ঘুরিয়ে রুমটা দেখতে গিয়ে একজন নার্সকে দেখতে পেল। তাকে ডাকতেই কাছে এল, হরি প্রথমেই জিগ্যেস করল – ভাই কোথায়?
নার্স: উনি চলে গেছে। রাতে অনেক ছোটাছুটি করছে, আপনার জন্য ২ ব্যাগ রক্ত জোগাড় করেছে। আপনার দুর্ঘটনায় পুলিশ কেস হয়, ঘুস দিয়ে মিটিয়েছে।
হরি: কখন আসবে কিছু বলেছে।
নার্স: তাতো জানি না।
নার্স রুম থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করলে হরি জিগ্যেস করে আমার জামা কাপড় মোবাইল কোথায়।
মোবাইল আপনার বালিশের নিচে রাখা আছে, আর আপনার ভাই আপনার জন্য নতুন জামা কাপড় দিয়ে গেছে, বলতে বলতে বেড়িয়ে যায়। নার্স চলে যেতেই মোবাইল খুঁজতে বালিশের নিচে হাত দেয়। মোবাইলের সাথে আরো কিছু একটা অনুভব করে, টাকার বান্ডিলের মত মনে হয়। বের করে দেখে টাকার বান্ডিল, বান্ডিলের সাথে একটা চিরকুট। হরির বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে গেল।
চিরকুটটা সাবধানে খুলে বের করে, চিরকুটে লেখা – এখানে তোমার ঠাকুরমার চিকিৎসার টাকা রয়েছে, তোমার হাসপাতালের বিল আমি পরিশোধ করে গেছি। যদি ভালো হয়ে কাজ করতে চাও তবে সুস্থ হয়ে সোনামুখী বাজারে গিয়ে সুক্কুরের খোঁজ করবে। তাকে গিয়ে বলবে – তোমাকে ফেরেস্তা পাঠিয়েছে।
স্তম্ভিত হরি চিরকুটের দিকে তাকিয়ে থাকে, অজ্ঞাতেই তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। মনে মনে বলছে ভগবান তুমি তাহলে সত্যিই আছো ! মানুষের বেশে দেখা দিয়েছো !
অলংকরণঃ দীপংকর গৌতম