রাতের প্যাসেঞ্জার – রাজীব হাওলাদার 

  
    

গল্প

রাতের প্যাসেঞ্জার
রাজীব হাওলাদার 

সুক্কুরের চোখে মুখে একটা বিরক্তি, মাফলার টা দিয়ে মাথা গলা পেচিয়ে বেঁধেছে। একা একাই মনে মনে বলছে আজ জামাইল্লারও এত পুঁজি কম বুঝলে খেলতেই বসতাম না। জুয়ার আসর টা তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে গেল বলে তার এই বিরক্তি। আজ সে অনেক দিন পর জিততে ছিল আর আইজই হালাগো সবার পুঁজি কম।

মোবাইল বের করে সময় দেখল রাত ১ টা বাজে।
মোটরসাইকেলটা বের করে, ঘাটে যাবে খ্যাপ মারতে ।
আইজ কপালডা ভাল, কপালে একটা ভাল প্যাসেঞ্জার জুটলে হয়। তাইলে রাইতে আর খ্যাপ মারবে না।

চারদিকে সুনশান নীরবতা। রাস্তাঘাট ফাঁকা। হঠাৎ করে দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেলে টান দেয়। ঘাটে মানুষজন নাই, একটা রিকশাওয়ালা বসে ঝিমুচ্ছে।

মোটরসাইকেল থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিরে ফেরী কখন গেছে ওপার?
রিকশাওয়ালা : এইত একটু আগে।
সুক্কুর : ধুর ১ ঘন্টার মামলা ফিরা আইতে।

একটা সিগারেট ধরায়, ঘাটের দিকে হেটে যায়, ঘন কুয়াশায় নদীর ওপারের কিছুই দেখা যায় না। শীতের সঙ্গে দমকা বাতাস, শরীরে একটু কাপুনি ধরেছে। সিগারেটে কষে টান দেয়। সিগারেটটা শেষ করে উঠতে যাবে এমন সময় নদীতে ট্রলারের শব্দ পেয়ে দাঁড়ায়। যদি খেয়ার ট্রলার হয়, তবে যাত্রী পেয়ে যেতে পারে। শীতে হাটুতে কাঁপুনি ধরছে দেখে আর একটা সিগারেট ধরায়।

অল্প সময় যেতেই ট্রলারের আলো দেখা যায়। মনে মনে আস্বস্ত হয়, যাক খেয়ার ট্রলার, একটা প্যাসেঞ্জার পাওয়া যাবে। ট্রলারটা ঘাটে ভিড়লে চোখে পরে একজন মাত্র লোক। লোকটা বেশ লম্বা আর স্বাস্থ্যও ভাল ! এমন বড়সড় মানুষ সাধারনত দেখা যায় না।

লোকটা তীরে উঠতেই সুক্কুর জিজ্ঞেস করল ভাইজান কই যাইবেন? মোটরসাইকেলে যাবেন নাকি?
যাত্রী : সোনামুখী যাব, বাজারের মাইল খানেক আগে। কত নিবা?
সুক্কুর : চলেন, শীতের রাইতে কি দর দাম করুম, আপনি ভালো বুইঝা দিয়েন।
যাত্রী : না না দর দাম মিটিয়ে লও। পরে ঝামেলা করতে পারবা না।
সুক্কুর : ১২০০ দিবেন ভাইজান। আওনের সময় খালি আওন লাগব ..
যাত্রী : ভালই তো চাইছস, ৩০০ টাকার ভাড়া ১২০০।
সুক্কুর : না ভাইজান বেশি চাই নাই। রাস্তায় কিছু নাই, আপনারে নামিয়ে খালি টাইনা আওন লাগব। তাইলে কন !! ৬০০ তো দিনের ভাড়া !!
যাত্রী : বেশি কথায় কাজ নেই ৯০০ দেব, যাবা ?
মাঝিও হাঁক মেরে উঠল, ওই সুক্কুর, ভাইরে লইয়া যা।
সুক্কুর : চলেন ভাইজান। দোকান খোলা আছে, চা খাইলে খাইয়া লন, পরে আর কিছু পাওয়া যাইব না।

চা শেষ করে দুজনে উঠল । সুক্কুর মোটরসাইকেলে কিক দিতে গিয়ে ব্যাথায় ককিয়ে উঠল, কিন্তু মোটরসাইকেল স্টার্ট নিল না। আরো ২-৩ বার চেস্টা করল, স্টার্ট নিলনা।

যাত্রী : কি হলো নস্ট নাকি..?
সুক্কুর : নাহ ভাইজান আমার পায়ে জোর কম, ডান পায়ের কনুই আঙ্গুলে গ্যাংগ্রিন হয়েছে। ব্যাথায় কিক দিতে পারছি না।
যাত্রী : জায়গা দাও, আমি স্টার্ট দিয়ে দিচ্ছি। এক কিকেই স্টার্ট নিল।
সুক্কুর আবার চালকের জায়গা নিয়া নিল । তাদের যাত্রা শুরু হলো ।
যাত্রী : গ্যাংগ্রিন হয়েছে, অপারেশন করাও না কেন ?
সুক্কুর : ভয় লাগে ভাইজান।
যাত্রী : ভয়ের তো কিছু নাই, পরে বিপদে পরবা। দেখা যাবে পা কেটে ফেলতে হচ্ছে।
সুক্কুর : কবিরাজী ব্যান্ডেজ করেছি, বলল তো শুকাইয়া যাবে।
যাত্রী : তা রাইতে যে গাড়ি চালাও, বিয়া কর নাই!
সুক্কুর : কি যে কন !! বিয়া করছি তো বহু আগে!! মেয়েও আছে একটা, ক্লাস টু তে পড়ত, এবার স্কুলে দেই নাই ।
যাত্রী : এবার কেন দেওনি? মেয়েদের তো পড়ালেখা ফ্রি আবার উপবৃত্তিও দেয়।
সুক্কুর : আর উপবৃত্তি!! মেয়েরে স্কুলে দিয়া নিয়া আসনের তেলের পয়সা হয়না।
যাত্রী : একটু থামাও, সিগারেট ধরাতে পারছি না।

সুক্কুর মটরসাইকেল থামায়, ভাইজান কিছু মনে না করলে আমিও একটা ধরাইতাম।
যাত্রী : ধরাও, সিগারেটই তো ধরাবা। আবার চলা শুরু হয় তাদের।
যাত্রী : তা রাতের বেলা গাড়ি চালাও, মদ গাজার স্বভাবও আছে নাকি ?
সুক্কুর : না না ভাইজান মদ খাই না, তয় গাজাটা না হইলে আমার ঘুম হয় না।
যাত্রী : হেসে ফেলে, তোমার স্বভাব চরিত্র তো ভালোই। আর কি কি ভালো গুন আছে।
সুক্কুরও হেসে দেয়, আপনে তো আমার নাড়ির খবর সব নিয়া ফেলছেন। খারাপ কিছু না ভাইজান মাঝে মাঝে একটু জুয়া খেলি।

যাত্রী হো-হো করে হেসে ওঠে, তা মেয়ে মানুষের অভ্যাসটাও কি আছে ?

সুক্কুরও হেসে জবাব দেয়, না ভাইজান উত্তর পারার শেফালির লগে আমার বিয়ার আগেই প্রেম ছিল। শেফালির তালাক হয়ে গেছে, মাঝে মাঝে অর কাছে যাই। ছেমরিটা নষ্ট হয়ে গেল, শুনছি অনেকের লগে সম্পর্ক।

হা হা হা তোমার তো গুন সব গুলি আছে। যাই হোক, সামনের ডান দিকে যে কাঁচা রাস্তাটা আছে সেখানে নামব আমি।

লোকটা মোটরসাইকেল থেকে নামল, কোমর থেকে ছোট রিভালবার বের করল । কর্কশ স্বরে বলল, নাম মোটরসাইকেল থেকে। সুক্কুর হতবাক হয়ে গেল, কথা না বলেই নেমে পড়ল।

যাত্রী: পকেটে যা কিছু আছে বের কর।
সুক্কুর মানিব্যাগ আর মোবাইল বের করে দেয়।

যাত্রী : তোর ডান পকেটে টাকা আছে দে, আর গাড়ির চাবি দে।
সুক্কুর টাকাটা বের করে দেয়, ভাইজান গাড়ির চাবি দিতে পারব না। ভাড়ার গাড়ি, এটা দিলে আমার ভিটা বেঁচা লাগব।

কিছু বোঝার আগেই গুলির শব্দ, সুক্কুর একটা চিৎকার দিয়ে কাত হয়ে পড়ে। যে আঙ্গুলে গ্যাংগ্রিন হয়েছে সেটা দূরে ছিটকে গেছে। চাবিটা বাড়িয়ে ধরে। তারপরও লোকটা একটা লাথি কসিয়ে দিয়ে বলে, উঠে দাঁড়া, কান ধরে উঠবস কর। আর বল, আমি জুয়া খেলব না, আর শেফালির কাছে যাবনা, আর গাজা খাব না। এক এক লাইন ৩ বার করে বলবি।

সুক্কুর কান ধরে উঠবস করে ও বিড়বিড় করে। লোকটা শেষে আবার লাথি দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যায়।

সুক্কুর রাস্তার ঢালে শুয়ে পড়ে। পায়ের ব্যথাটা ঠান্ডায় টের পাচ্ছে না, পকেট হাতরিয়ে একটা সিগারেট বের করে ধরায়। আকাশের দিকে মুখ করে ধোঁয়া ছাড়ে আর বলে… আল্লাহ তোমার সব অবিচার কি গরীবের উপর !!

সিগারেট শেষ হতে না হতেই মোটরসাইকেলের শব্দ পায়। চোখ ঘোরাতেই দেখে আবার সেই লোক।

লোকটা মোটরসাইকেল থেকে নামে, চাবিটা ছুড়ে দেয়। মানিব্যাগ আর মোবাইলও ফেরত দেয়, সুক্কুর হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

এরপর আরো অবাক হয়, লোকটা এক বান্ডিল টাকা বাড়িয়ে ধরে বলে তোর আঙ্গুলের গ্যাংগ্রিন অপারেশন হয়ে গেছে, হাসপাতালে গিয়ে ড্রেসিং করে নে। আর অবশিষ্ঠ টাকা দিয়ে কাল মেয়েকে নতুন জামা পড়িয়ে স্কুলে নিয়ে যাস।

লোকটা দ্রুত হেটে চলে যায়, মনে হল যেন কুয়াশায় মিলিয়ে গেল।

সুক্কুর আগের মতো শুয়ে রইল, আর বিড়বিড় করতে লাগল …
আল্লাহ ফেরেশতারা কি দেখতে মানুষের মত হয়! আল্লাহ ফেরেশতারা কি দেখতে মানুষের মত হয়!!

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments