শুধুমাত্র এক লাইনের একটি হেডলাইন, ‘সিডনিতে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর মৃত্যু’ ব্যস এটুকুই। পরপর তিনটি সংবাদের একই হেডলাইন। পরপর তিন তিনটি যুবকের মৃত্যু, তিন তিনটি প্রাণের অকাল প্রয়াণ। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সকল মানুষ পরম্পর এ শোক সংবাদে স্তব্ধ হয়ে গেছে। এক মায়ের চোখের জল শুকাতে না শুকাতে অন্য মায়ের চোখ অশ্রুসজল। শুরু হয়েছে সমুদ্র আর পাহাড় সন্নিকটে পা পিছলে অনিকের মৃত্যু দিয়ে, এরপর সিডনির ছেলে ময়ূখের পার্থে পাহাড় হাইকিং করতে গিয়ে মৃত্যু আর অতি সম্প্রতি সিডনির অদূরে ন্যাশনাল পার্ক পেড়িয়ে ওয়াটামোলা’র উঁচু থেকে সমুদ্রে লাফ দিয়ে রাহাতের মৃত্যু। মাত্র ৬ সপ্তাহের ব্যবধানে এই তিন যুবকের মৃতের মিছিলে আমরা মর্মাহত।
সিডনিতে পড়তে আসা কুমিল্লার ছেলে রাহাত বিন মুস্তাফিজ দুই বন্ধুর সঙ্গে ওয়াটোমোলা বিচে গিয়েছিলো। এখানে বিচসংলগ্ন সমু্দ্রের উঁচু পাড় থেকে অনেকেই লাফঝাঁপ দেয়। যদিও এখানে লাফ দেয়ার ওপর কঠিন নিষেধাজ্ঞার সাইনবোর্ড আছে। তরুন প্রাণ সেই নিষেধাজ্ঞা মানবে কেনো? আমার মনে পড়ে, শেষ সময় আমরাও বন্ধুদের সঙ্গে ওয়াটোমোলা গিয়েছিলাম। আমাদেরও ইচ্ছে করছিলো একটা লাফ দিতে। নদীমাতৃক দেশের মানুষের সবারই হয়তো এরকম পাড় দেখলে লাফিয়ে জলে পড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু প্রায় ১০০ মিটার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ার রিস্কটা কেনো নেবেন আপনি? আর এই কারনেই কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞার সাইনটি ঝুলিয়ে রেখেছে। রাহাত তার দুই বন্ধুর সঙ্গে সমুদ্রের জলে লাফ দিয়ে আর উপরে উঠতে পারেনি। প্যারামেডিক জানিয়েছে, জলের ভেতরেই তার আকষ্মিক মৃত্যু ঘটে। বাকী দু’জন উপরে উঠলেও ফুসফুসে পানি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
ময়ূখ পার্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ব্যাচেলর করেছেন। বন্ধুদের সঙ্গে প্রখ্যাত ক্যালবেড়ি পর্বতের শৃঙ্গ আরোহন করতে যায় সে। দীর্ঘ ৮ কিলোমিটার হাইকিংয়ের পর সে পানি পিপাসা বা ড্রিহাইড্রেশনে আক্রান্ত হয়। অথচ ওর সঙ্গে পানি ছিলো, পান করার সময় পায়নি। ময়ূখের মা সংস্কৃতি ও মিডিয়া কর্মী কিশোয়ার জাহান ঝুমা, সদা হাস্যময়ী মানুষ। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তিনিও শয্যাশয়ী হয়েছেন। ময়ূখকে তিনি পেটে ধরেছেন, ২৬ বছর ধরে তিলতিল করে মানুষ করে তুলেছেন। হঠাৎ এই ছন্দপতনে তিনি একাকিনী হয়ে গেলেন। আমরা জানিনা, সদা হাস্যময়ী ঝুমা আপা আবার কবে হেসে উঠবেন, কবে একটু স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলবেন, আদৌ কি স্বস্তি মিলবে ?
অনিক মাত্র সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছিলেন। এর আগে তিনি ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে ইন্জিনিয়ারিং পড়েন। বাবা মধ্যপ্রাচ্যের শারজাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। মা আর ভাই সহ অনিক সিডনিতেই থাকতো। অনিককে হারিয়ে তার মা, বাবা ও ছোটভাই বিহবল হয়ে পড়েছে।
বন্ধুদের সঙ্গে ন্যাশনাল পার্ক পেড়িয়ে সেও গিয়েছিলো সিক্লিফ ব্রিজের কাছাকাছি একটি পাহাড়ে। হঠাৎ পা পিঁছলে সেও চলে গেলে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। অনিক এবং ময়ূখ দুজনকেই সমাহিত করা হয়েছে সিডনির রকউড কবরস্থানে।
রাহাতের মৃতদেহ এখনো মর্গে রয়েছে। এখনো জানা যায়নি কোথায় তাকে সমাহিত করা হবে। হয়তো বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে নয়তো বাকী দু’জনের মতো তাকেও রকউডে সমাহিত করা হতে পারে। একবার ভাবুন যে ছেলেটা জীবনের চাকা ঘুরিয়ে এদেশে পড়তে এসেছিলো, সে যাচ্ছে লাশ হয়ে। কেমন করে সহ্য করবে তার পরিবার।
অনিক, ময়ূখ এবং রাহাত তিনজনের বয়স ছিলো খুবই কাছাকাছি। জীবনকে তারা পুরোপুরি না দেখেই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেন।আর একটু সাবধান হলে হয়তো তিনটি জীবন বেঁচে থাকতো। হয়তো থাকতোনা, এই মৃত্যু তাদের ভাগ্যে লেখা ছিলো কি? তবুও বলব, সাবধানের মার নেই। আমাদের দৈনন্দিন চলার পথে সাবধানতা মেনে চলতে হবে। বাবা-মা বা গুরুজনদের কথা মেনে চলতে হবে।
প্রশান্তিকার পক্ষ থেকে আমরা শোক সন্তপ্ত পরিবারের সকলের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। সৃষ্টিকর্তা আপনাদের এই অপরিসীম শোক সইবার শক্তি দিক।