রিকশা গার্ল : একটি হিউম্যান ডকুমেন্টারি ফিল্ম | শাখাওয়াৎ নয়ন

  
    

মিতালী পার্কিন্সের “রিকশা গার্ল” উপন্যাস অবলম্বনে অমিতাভ রেজা চৌধুরী “রিকশা গার্ল” সিনেমাটি নির্মান করেছেন। এই সিনেমার উল্লেখযোগ্য একটি দিক হচ্ছে, গল্পের জন্য গল্পকারের কাছে যাওয়া। সাম্প্রতিককালের ঢাকাই সিনেমায় তা খুব কমই দেখা যায়। নায়ক-নায়িকা, ফটোগ্রাফি, এডিটিং, কালারিং, মাস্টারিং, সাউন্ড সবকিছু সেরাটা নিয়েও কাজ হয় না, যদি গল্পটাই শক্তিশালী না হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশের সিনেমার প্রথম অথবা অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমা “পথের পাঁচালী”, বিভূতিভূষণের উপন্যাস অবলম্বনে বানানো হয়েছিল। যদিও সত্যজিৎ রায়ের বাপ-দাদা বিখ্যাত কবি লেখক ছিলেন। নিজেও লেখক হিসেবে কম বিখ্যাত নন। তারপরেও বিভূতিভূষণের দ্বারস্থ হলেন কেন? একটি ভালো গল্পের জন্য।

মিতালী পার্কিন্সের উপন্যাসটি পড়ার সুযোগ এখনো হয়নি, তবে দুই একটা রিভিউ পড়েছি। ইতোমধ্যেই উপন্যাসটি অল্প-বিস্তর সুনাম অর্জন করেছে। যেকোনো উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা বানানোর অনেক সুবিধা-অসুবিধা থাকে। সেসব সামলাতে পারলে ভাল, নইলে বিপত্তির কোনো শেষ থাকে না। অমিতাভ রেজা চৌধুরীর নির্মিত এই ছবির বেশ কিছু দৃশ্য এখনো আমার চোখে লেগে আছে। নির্মাতা হিসেবে এটাই তাঁর মুন্সিয়ানা।

সেলিমের কাছ থেকে ছো মেরে নাস্তা নিয়ে নাঈমার ছুটে বেড়ানো কিংবা হাইড এন্ড সিকের উচ্ছলতা যেন শীতসকালের এক চিলতে রোদের হাসি। ‘কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না’ ধরণের সম্পর্কটায় কোনো অতিরঞ্জন নেই, বাস্তবতা আছে। তবে একরকম দুজন তরুন তরুনীর সম্পর্ক দেখলে এক ধরণের বোধের উদ্রেক হয়- দারিদ্র্য শুধু মানুষকে অন্ন-বস্ত্রের সংকটেই ফেলে না, জীবনে নানা রকম না পাওয়ার নরকেও নিমজ্জিত করে।

নাঈমার গৃহকর্মী (কাজের মেয়ে) জীবনের খণ্ডাংশই বাংলাদেশের প্রচ্ছন্ন দাসপ্রথার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। বহুতল ভবনের ফ্লাটে বন্দীজীবনে নাঈমা যখন এক চিমটি মাটির ঘ্রান নিচ্ছিল, প্রবাস জীবনে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে বসেও সোদাগন্ধ পেয়েছি। সুগন্ধ তো মাটিতেই থাকে, যেখানে গোলাপ ফোটে আবার ঝরে পড়ে। পথের কুকুর এবং একটি অসহায় পাখির সাথে মানব জীবনের সাদৃশ্য কিংবা সাজুয্য ভাবিয়েছে, অনেক। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যা যাপন করি, সেটাই কি আমাদের জীবন? নাকি যা যাপন করতে পারি না তার নাম জীবন? একদিকে বিপুল বিস্তৃত পদ্মাপাড়ের ছোট্ট জনপদ পাকশী, অন্যদিকে বুড়িগঙ্গাপাড়ে মহানগরী ঢাকায় দারিদ্র্যের ক্যানভাসে আঁকা গল্পটা কখনো কখনো হৃদয় ছুঁয়েছে।

নাঈমা দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও শিল্পীমনে সমৃদ্ধশালী এক অদম্য সাহসী তরুনীর প্রতিমা। আবার কখনো কখনো মনে হয়েছে একজন শিল্পীর মনের আয়নায় সংগ্রামী জীবনের প্রতিবিম্ব। ‘ভয় হতে তব অভয় মাঝে নূতন জন্ম দাও হে’ গানটি মনের কোনে বারবার বেজে উঠেছে।

‘আদার সাইড অব দ্যা ক্রুয়েল্টি’ হচ্ছে নারী মালিকানাধীন রিকশা গ্যারাজটি। এক্ষেত্রে ‘নারী নরকের দ্বার’ নয় এটাও হতে পারে এই সিনেমার একটি মেসেজ। ব্যাপারটি আকস্মিকতার ঢঙে নয়, স্বাভাবিকতায় দেখানো হলেও ভালো লেগেছে। আকস্মিকতাই যেহেতু গল্পের প্রান। সেক্ষেত্রে বলতে হয়- রিকশা গার্ল মুভিতে আকস্মিকতা আছে, তবে তা খুব শক্তিশালী নয়। একজন অসুস্থ রিকশা চালক বিনা চিকিৎসায় কিংবা উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মারা যাবেন, এটা যে কেউ ধারণা করতে পারেন। এটা স্বাভাবিক পরিণতি, আকস্মিকতা নয়।

পিছনে দেখার জন্য কখনো কখনো পিছনে না তাকালেও চলে। কারণ সামনের রাস্তায়ই পিছনের চিহ্ন পড়ে থাকে। নাঈমা যখন তাঁর শিল্পী জীবনে সফলতার মুখ দেখতে শুরু করে; তখন তাঁর বাবার মৃত্যু কি সেরকমই কোনো ইশারা? এক ঘোর ভেঙ্গে মানুষ আরেক ঘোরের মধ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু নাঈমার জীবনের ঘোর একটাই। সেই ঘোরের জগতে জীবিতরাও ক্ষেত্রবিশেষে মৃত, আবার মৃতরা জীবিত হয়ে উঠতে পারে। তাই নাঈমার রঙ তুলিতে তাঁর বাবা জীবিত হয়ে উঠেন। আলোর মধ্যে রঙ থাকে নাকি রঙের মধ্যে আলো? সিনেমার এই অংশে ‘রঙের মধ্যে আলো’ অসম্ভব শক্তিশালী পরাবাস্তব হয়ে ফুটে উঠেছে।

এক সময় সীমিত বাজেটের কারণে ‘আংশিক রঙ্গিন ছবি’ বানানো হতো। একটা দুটো গানের দৃশ্য শুধু রঙ্গিন থাকত। কিন্তু রিকশা গার্ল সিনেমায় কেন ইংরেজি এবং বাংলার মিশ্রনে সংলাপ দেয়া হয়েছে, তাঁর কোনো প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাইনি। তাই বারবারই মনে হয়েছে-‘আংশিক ইংরেজি’ অথবা ‘আংশিক বাংলা’ ছবি। এসব ক্ষেত্রে সাব-টাইটেল দিতে দেখা যায়, কিন্তু এই মুভিতে তা খুঁজে পাইনি।

দর্শকের মনোজগতে প্রভাব ফেলতে পারাটাই একজন অভিনয় শিল্পী এবং পরিচালকের কৃতিত্ব। এক্ষেত্রে নভেরা রহমান এবং অমিতাভ রেজা চৌধুরী দারুন সফল। কোথাও অতি অভিনয় কিংবা তথাকথিত হিরোইজম দেখানো হয়নি। বিশ্বাসযোগ্যতার ফ্রেমে অভিনয় করেছে নভেরা রহমান। তাঁর রিকশা চালানোর ধরণ এবং অভিনয় বাস্তবসম্মত মনে হয়েছে। কোথাও চোখে লাগেনি। সিনেমা দেখে বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রিকশা চালকের মুখ কল্পনা করার চেষ্টা করেছি আর ভেবেছি, আমরা ভালো করে দেখি না বলে অনেক কিছু বুঝতে পারি না। কত জীবনের কত গল্প অজ্ঞাতই রয়ে যায়!

একটা গল্পকে একাধিক দর্শনের ছাঁচে ফেলে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। রিকশা গার্ল এর আখ্যানে জ্যাঁ পল সাঁৎরের অস্তিত্ববাদী দর্শনের ছাপ স্পষ্টভাবেই দেখা যায়। কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, মানুষ কি ঘটনার মধ্যে নিজেই জড়ায়? নাকি নিয়তিই তাঁকে জড়িয়ে দেয়? সেই প্রশ্ন তোলা থাক স্যুয়োরিয়েলস্টিক কিংবা কার্য-কারণবাদীদের জন্য। বাস্তবের সাদামাটা পরাজিত জীবনেও জয়ী হবার কিংবা টিকে থাকার চেষ্টা, স্বপ্ন-কল্পনা থাকে। জয়-পরাজয়ের জীবনপথে কখনো অসহায়ত্ব, কখনো বন্দীত্ব, কখনো প্রতিবাদ, কখনো নিঃস্ব, আবার কখনো মুক্তির আনন্দে মন ছুটে যেতে চায়। ‘রিকশা গার্ল’ জঁনরার দিক থেকে সোশ্যাল ড্রামা ধরণের মুভি হলেও আমার কাছে ‘হিউম্যান ডকুমেন্টারি ফিল্ম’ মনে হয়েছে। সবকিছু ছাপিয়ে একজন শিল্পীর অসীমে ঘুরে বেড়ানো, উড়ে বেড়ানোর গল্পই রিকশা গার্ল।

 পুনশ্চঃ

এই প্রথম অস্ট্রেলিয়ার কোনো সিনেমা হলে সম্পুর্ন হল কতৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় বাংলা সিনেমা প্রদর্শিত হলো। Hoyts Cinema এর ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনে টিকেট কিনে সিনেমা দেখেছি। BongOz Films এর প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছে। BongOz Films এর কর্নধার Taneem Al Minarul Mannan আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

শাখাওয়াৎ নয়ন

 কথাসাহিত্যিক। শিক্ষক, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments