“Perhaps Eid is more than the vermicelli thing/ I was spooned to believe.
In the mosque this morning/ I promised God to bend my knees/ Another four time” -EID by Alamgir Hashmi
সে অনেক কাল আগের কথা।
অচিনপুর রাজ্যের এক নগরের ঘরে ঘরে ঈদ পালিত হইত। গাছে গাছে পাখি ডাকিত, শাখে শাখে ফুল ফুটিত, পথের পাশে পাশে সুমিস্ট শরবতের নহর বইত…ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা, ছোট ছোট টুপি আর ছোট ছোট ওড়নায় মাথা ঢেকে ইফতারের থালা সাজিয়ে বসত। কিছুক্ষণ আগে মা-চাচীরা কাঁসার বড় বড় রেকাবিতে ইফতার সাজিয়ে দিয়েছে, এদের দায়িত্ব ছিল প্রতিবেশী বাড়ি-বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসা। কেবল তাই না প্রতিদিন বাড়িতে বেশ কিছু মানুষের জন্য পরিমান বাড়িয়ে ইফতার তৈরী হত আর মুসাফির, মিসকিন, অতিথি থেকে শুরু করে কত মানুষ-ই না সে ইফতার খেয়ে যেত।
উনত্রিশ রোজার দিনে মুখে একটু খেজুর একটু পানি দিয়েই দে ছুট…দে ছুট! বড় মাঠ, রাস্তা কিংবা নিদেন পক্ষে বাড়ির ছাত। চাঁদ দেখা গেলে কাল ঈদ। মেহেদি দিতে হবে পটকা ফুটাতে হবে কত কত কাজ! বিটিভি-তে শুরু হয়ে যেত “ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ…”এর চেয়ে রক্তে নাচন ধরানো উৎসবের গান আর কোনদিন তৈরি হয়নি, হবেও না। সেই গান শুনতে শুনতে ছেলের দল পাড়ার মোড়ে ঈদ কার্ড আর কোকাকোলার দোকান সাজাতে বসত। চাঁদরাত পর্যন্ত চলত ঈদকার্ডের বিক্রি-বাট্টা। সখিতে সখিতে ঈদ কার্ড বিনিময়ের পাশাপাশি খুব গোপনে চলত প্রেমিক-প্রেমিকার ঈদ কার্ড দেওয়া নেওয়া অথবা প্রেম প্রত্যাশী কিশোর/যুবকের কিশোরী মেয়ের প্রতি অনুচ্চারিত আবেগঘন ভাষায় “ঈদ মুবারক” লেখা প্রেমপত্র থুরি, ঈদ কার্ড। এসব ছিল যেন,অনেক কথা বলে যাওয়া, কোন কথা না বলে। এসব ছদ্মবেশি ঈদ কার্ড (আদতে তো প্রেম-পত্রই) আনা-নেওয়ার কাজে নিয়োজিত থাকত অপেক্ষাকৃত কম বয়সি ছেলে-মেয়েরা। অবস্থাদৃষ্টে বলা যায়, এসব স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়া ছেলে-ছোকরা’দের ইঁচড়েপাকা করে তুলবার বিষয়ে এসব বড় ভাই-বোনদের কোন অবদান-কে অস্বীকার করবে!
যা হোক, এবার প্রসঙ্গে ফিরি। এমন টান টান উত্তেজনার চানরাত শেষ হত ঈদের জামা-জুতো ঠিক ঠিক লুকানো রইল নাকি কেউ দেখে ফেলল সেই শঙ্কায় দুরু-দুরু বুক নিয়ে ঘুমাতে গিয়ে। রাতটুকু কোনমতে সহী-সালামতে পার করতে পারলেই এতদিনের পরিশ্রম, কাক-পক্ষী সবার থেকে জামা জুতো লুকিয়ে রাখা সফল হয়! কী শীত, কী বর্ষা, কী হেমন্ত- ঈদের ভোর মানেই সাতসকালে গোছল (আসলে এটা পাঁচ সকাল বললে যথাযথ শোনাত। ঈদের ভোরে সাতটা মানে অনেক দেরী, ঈদের জামাত মিস!) । হি হি কাঁপতে কাঁপতে গোসল সেরে এসে ঈদের নামাজের জন্য তৈরী হতে হত। এরপর টেবিলে সাজানো থাকত থরে থরে সব বেহেস্তি খানা। কি তার রং, কি তার রুপ কি তার গন্ধ! কমলা রঙের জর্দা পোলাও, বাদামি রঙের বাহারি কিশমিশ-বাদাম দেওয়া জর্দা সেমাই, দুধের নহরে ভাসা দুধ সেমাই, নানা পদের মিষ্টান্ন, সুগন্ধী পোলাও চালের মাংসের টুকরা মেশানো খিচুড়ি আরও কত কি! সব সেমাইয়ের সেরা সেমাই ছিল ঘিয়ে ভাজা আকবরিয়ার লাচ্ছা সেমাই। এসব বেহেস্তি খানা-খাদ্য মুখে দিয়ে শুরু হত ঈদের জামাতে যাবার তোড়জোড়। তার অগে চলত আরেক আনন্দের সালামি পর্ব। এ পর্বে বাড়ির ছোটরা সবাই সাড় বেধে বড়দের সালাম করত আর সালামি জমাতো। এই সালামি শিকার কিন্তু চলত সারা দিনব্যাপি। এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে ঘুরে সারা পাড়াময় চলত ঈদের সালামি সংগ্রহ। আর দিন শেষে হিসাব নিকাশ, কার থলেতে কত জমল আর এসব কি করে খরচ হবে তার জল্পনা-কল্পনা। এত ভাল ভাল খেয়ে দেয়ে, এত ঘুরে ফিরে পকেট ভারী করে ক্লান্ত হয়ে গেলে ছিল বিনোদন ব্যবস্থা! এ তো আর তোমাদের মত পকেট ভর্তি নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন আর ইউটুবের যুগের কথা বলছি না। সে সময় তীর্থের কাকের মত বসে থেকে একমাত্র বিটিভিতে যে সিনেমা, ঈদের নাটক, ঈদ আনন্দমেলা চলত হাত পেতে নিয়ে চেটে-পুটে খেত সকলে মিলে বসে। দুপুরে-রাতে ঈদের পরদিন, তিনদিন ধরে চারিদিকে কেবল আনন্দ আর আনন্দ।
এই যে রুপকথার দেশের ঈদের গল্প শোনালাম, সেটা কিন্তু সত্যি গল্প। এতটুকু বানানো নয়। হ্যাঁ, এখন যদি তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করো যে এটাই পুরো চিত্র কিনা তাহলে একটু আমতা আমতা করতে হবে। মানে ধরো, রপকথার গল্পে কি আর না খেতে পেয়ে, পেট শুকিয়ে আমসি হয়ে থাকা, হাড় জিরজিরে গরিব গুরবোর গ্ল্যামারবিহীন ঈদের গল্প করা যায়, না সেটা শুনতে ভাল শোনায়? জানো, দাদাবাড়িতে গেলে খেলতে আসত যে শুকু, ও জানালো ঈদ উপলক্ষে ওর বাড়িতে বেশ ভাল রান্নাবান্না হচ্ছে। সকাল বেলা ডিমের তরকারি দিয়ে ভাত, আর দুপুর বেলা পাটশাক ভাজি। কিন্তু ভাতটা ঈদ ঊপলক্ষে ওর মা ওদের তিনবেলাই খেতে দেবার প্রতিস্রুতি দিয়েছে। ঈদের দিন পোলাও- কোরমা বাদ দিয়ে ও ভাত খেতে রাজি হয়ে গেল দেখে অবাক হয়ো না । শুকু’র তো তাও ভাগ্য ভাল সেদিন ভাত জুটেছিল, এরকম কত লোকেদের ঈদের কাপর জোটেনা, ভাত জোটেনা, শীতবস্ত্র জোটেনা, তবু ঈদ আসে আর যায়, সে কালেও যেত, এ কালেও যায়, ঘরে ঘরে শান্তির সুবাতাস নিয়ে রুপকথার দেশে ঈদ আসে আর যায়।
ধরো, ঈদের দিন সকাল বেলা উঠে যদি তোমাকে কাজে যেতে হয়, সকাল বেলার নামাজটা পড়তে যাওয়া না হয়, টেবিল ভর্তি জর্দা-সেমাই-পায়েসের বদলে তোমাকে নিজের টোস্টে নিজেই ভেজিমাইট লাগিয়ে খেয়ে নিয়ে ছুটতে ছুটতে কাজ, বাড়ির সবার জন্য, দেশে জন্য মন কেমন কেমন করতে থাকে তাহলে তুমি নিজেকে এই বলে শান্তনা দিও, রুপকথার রাজ্যের ঈদ কি সবার ভাগ্যে জোটে? শুকুর ভাগ্যে জোটে পাটশাক ভাজি আর তোমার ভাগ্যে ভেজিমাইট।