দোল দোল দুলুনি, রাঙ্গা মাথায় চিরুনি,
বর আসবে এখনি, নিয়ে যাবে তখনি…
এই ছড়াটি শুনতে শুনতে আমরা বাঙ্গালি মেয়েরা বেড়ে উঠি। একটা মেয়ে তাঁর বিয়ে নিয়ে কত-শত কল্পনা করে! বিয়েতে এই রঙের শাড়ি পরবে, এভাবে সাজবে, বিয়ের স্টেজটা এমন হবে, ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে চারদিক। আরো কত কী! লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি টাকা খরচ করে আমরা একটি বিয়ের আয়োজন করি। এনগেইজমেন্ট থেকে শুরু করে বৌভাত পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষকে আপ্যায়ন করা হয়। আজকাল নাকি কেউ কেউ তাদের বিয়েতে সাত থেকে এগারটা অনুষ্ঠানও করে! লাখ টাকা খরচ করে ফটোগ্রাফার ভাড়া করে। সিনেমার মত ভিডিও তৈরি করা হয়। ফেসবুকে প্রায়শই বিভিন্নজনের বিয়ের রঙ-বেরঙের ছবি-ভিডিও দেখতে পাই। বর-বউ নাচতে নাচতে স্টেজে উঠে নিজেরদের সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি মেলে ধরে। আহা! কী অপরূপ সেই দৃশ্য! জীবনের এত বড় একটা ঘটনাকে তো এভাবেই উপভোগ করা উচিৎ।
বাংলাদেশে এখন একটা বিরাট সংখ্যক উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি হয়েছে। যারা সামর্থ্যবান। এমন অনেক নারী আছেন, যারা লাখ লাখ টাকা বেতন পান। ব্যবসা করে অনেকেই সফল। সে সব পরিবারের সদস্যদের বিয়েতে অনেক হৈচৈ, আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান করা হয়। ছেলে-মেয়ের বিয়েতে বেশ কয়টি অনুষ্ঠানও করেন। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা আড়ম্বর করবেন। অবশ্যই করবেন। জীবনের মধুর এই দিনক্ষণকে তো স্মরণীয় করে রাখাই উচিৎ।
বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জের বিয়েগুলো কেমন? কিভাবে তারা বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো আয়োজন করে? চলুন, বাংলাদেশের একটি গ্রামে ঘুরে আসি। উত্তরবঙ্গের জেলা কুড়িগ্রাম, এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব অঞ্চল। এখানকার শতকরা ৭১ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।

কুড়িগ্রামের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম ‘চর সুভারকুঠি’। সেই গ্রামের একটি মেয়ে ইয়াসমিন। হারুন নামক এক যুবকের সাথে তাঁর বিয়ে ঠিক হয়েছে। কিন্তু দারিদ্রের কারণে ইয়াসমিনের ‘বর আসবে এখুনি’ স্বপ্নটা পূরণ হচ্ছিল না। বিয়েতে সামান্য ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠানও আয়োজন করতে পারছিল না।
রূপকথার গল্পের মতই তাদের স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেল। তাতে এগিয়ে এলেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এক বাংলাদেশী তরুণী, তৃষা গোমেজ। তৃষা অস্ট্রেলিয়াতে পড়াশুনা করতে এসেছিলেন। ভারতীয় এক যুবকের সাথে তাঁর প্রণয়। তাদের প্রণয় বিয়েতে পরিনতি লাভ করার শুভক্ষণে তৃষা আরেকটি বড় স্বপ্ন পুরণ করতে চায়। নিজের বিয়েতে সে আরেকটি অসহায় গরিব মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবে। ১৪ নভেম্বর ২০২০, শনিবার, তৃষার বিয়েটা সিডনিতে নিবন্ধিত হলেও, একই দিনে কুড়িগ্রামের চর সুভারকুঠি গ্রামে ইয়াসমিন এবং হারুনের বিয়ের আয়োজন করে। সৃষ্টি করে এক অতুলনীয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এই মহৎ কাজটি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে তৃষার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে।
উক্ত ঘটনায় গ্রামবাসীরা শুধু অবাকই হয়নি, তাদের হয়েছে ভিন্ন ধরণের এক নতুন অভিজ্ঞতা। নব-দম্পতিসহ গ্রামের লোকজন এমন অভিনব আয়োজনে বিস্মিত, মুগ্ধ ও আনন্দিত। অনুষ্ঠানে উপস্থিত গ্রামবাসীরা তৃষার প্রতি প্রাণঢালা ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। একই সাথে তৃষা এবং ইয়াসমিনের জন্য তাঁরা দোয়া এবং আশীর্বাদ করেন।

তৃষার এই মহৎ উদ্যোগটি কি আমাদের সকলের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে না? তৃষা যা করে দেখিয়েছেন, আমি/আপনি তা অনুসরণ করতে পারি। যে কাজ দিয়ে আমরা হতে পারি আরেকজনের স্বপ্ন পূরণের সারথী। একেই বলে সামাজিক দায়িত্ব। আমাদের ছেলে-মেয়ের বিয়েতে যদি অন্তত একটি গরিব মেয়ের বিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেই, তাহলে কন্যাদায়গ্রস্ত সামর্থ্যহীন একটি পরিবার শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। বিয়ে না হওয়া একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে যেতে পারে। ঘরের কোনে লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করা একজন মায়ের চোখের জল মুছে যাবে। এত বড় একটি মহৎ কাজে হয়তো আমাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা কিংবা তাঁর চেয়েও কম খরচ হবে। হয়তো সামান্য একটু সেক্রিফাইস করতে হতে পারে, কিন্তু ফলশ্রুতিতে আমাদের ছেলে-মেয়ের বিবাহিত জীবন যাতে সুখের হয়, সেই জন্য সেই দরিদ্র মানুষগুলি আজীবন দোয়া করবে। পৃথিবীতে মানুষের দোয়ার চেয়ে দামী কিছু কি আছে?
অনীলা পারভীন
কর্মকর্তা, ইউনিভার্সিটি অফ সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।