রূপালী ছায়াবীথি । এস এম জাকির হোসেন

  
    

দিনগুলো সব এমনি করেই ফুরিয়ে যায়।
কাজের চাপে পিষ্ট হওয়া একঘেয়ে ক্লান্তিকর বলয় থেকে বেরিয়ে একটু অবসর খোঁজে উদভ্রান্ত মন। তারপর একদিন হঠাৎ অবসর মিলেও যায়। তখন কেবল মনে হয় দূরে কোথাও ঘুরে এলে নেহায়েত মন্দ হয় না!

বসন্তের শেষ বিকেলে অনিরুদ্ধ যখন শ্রীমঙ্গল ষ্টেশনে নামলো ঘড়িতে তখন পাঁচটা বাজে। ততক্ষণে চা বাগানের ফাঁকে ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা শেড-ট্রিগুলোর ছায়ারা পূবদিকে হেলে পড়েছে। আর, নতুন গজিয়ে ওঠা কচি চা-পাতাগুলো বিকেলের সোনালী আলোয় ঝলমল করছিলো। পাহাড়ের ঢালে চা বাগানগুলোতে অদ্ভুত আলোছায়ার খেলাটা জমে উঠেছিল বেশ।
এমন সময় অনিরুদ্ধ ট্রেন থেকে প্রায় ফাঁকা প্লাটফর্মটায় নামলো। পড়ন্ত বিকেলে ছোট্ট ষ্টেশনটায় লোকজনের ভিড়-ভাট্টা তেমন একটা ছিল না। অচেনা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। শুরুতেই দেখে নেয়া প্রকৃতির রানী শ্রীমঙ্গলের রূপ। ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে অবশ্য এই জায়গার সৌন্দর্য বোঝা সম্ভব নয়, তবুও নতুন জায়গায় এলে শুরু থেকেই একটা আকর্ষণ কাজ করে মনে।
হঠাৎ সেলফোনটা বেজে ওঠে। পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই চোখে পড়ে অপরিচিত নম্বরটা।
– হ্যালো!
– অনিরুদ্ধ সাহেব বলছেন?
নারীকন্ঠ শুনে কিছুটা অবাক হয় অনিরুদ্ধ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
– হ্যাঁ, অনিরুদ্ধ বলছি। আপনি কে বলছেন?
– আমি বীথি; অঞ্জনদার মামাতো বোন। আপনার জন্য ষ্টেশনে অপেক্ষা করছিলাম।

এবার বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। এ নিশ্চয়ই অঞ্জনের কাজ। ওর স্বভাবটাই এমন। প্রতিটা কাজই ছকে বাধা এবং দিন-ঘণ্টা ধরে সবকিছু একেবারে নিখুঁত হওয়া চাই। নিশ্চয়ই মেয়েটাকে ষ্টেশনে আসতে বাধ্য করেছে। কী দরকার ছিল মেয়েটাকে কষ্ট দেবার? ঠিকানা তো ওর কাছে ছিলই, ও ঠিকই খুঁজে নিতে পারতো।

অনেকদিন পর কক্সবাজারের বাইরে আসার সুযোগ পেল অনিরুদ্ধ। দীর্ঘদিন একটানা কাজ করে হাঁপিয়ে উঠেছিলো। গতকাল যখন কোথাও যাবার কথা ভাবছিলো, ঠিক তখনই হাজির অঞ্জন। অনিরুদ্ধ বেড়াতে যাবে শুনে নিজেই ঠিক করে ফেলে ওর গন্তব্য। ট্রেনের টিকেট কেটে হাতে ধরিয়ে দিয়ে কড়া হুকুম- যা ঘুরে আয়। তোকে কিছুই করতে হবে না, মামার ওখানে সব ব্যবস্থা করা আছে। বিনা বাক্য ব্যয়ে সে আদেশ মেনে নিয়েছিলো অনিরুদ্ধ। জানে, প্রতিবাদ  করে কোন লাভ হত না, ও যা করার করবেই।

একসময় অনিরুদ্ধর বন্ধুর অভাব ছিল না। আজ অনেকেই হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। ছন্নছাড়া এ জীবনটার সাথে একমাত্র অঞ্জনই জড়িয়ে আছে। অনেকটা ছায়ার মত। ওর অগোছালো জীবনে ঝড়ের মত এসে উদয় হয় ঠিক যখন ওর কাউকে প্রয়োজন।
অনিরুদ্ধ পাশ ঘুরতেই দেখতে পায় বীথিকে। ফোনটা তখনও কানের কাছে ধরা। ঘুরে সেদিকে তাকাতেই হাসিমুখে এগিয়ে আসে।
– আমি বীথি। মুখে তখনও অভ্যর্থনার হাসি।
– অনিরুদ্ধ।
অনিরুদ্ধ বীথিকে দেখে। মেয়েটি ছিপছিপে গড়নের। খুব সুন্দরী না হলেও চেহারায় এমন কিছু একটা আছে যা সহজেই যে কোন পুরুষকে আকৃষ্ট করবে। বিশেষ করে চোখ দু’টো। আচমকাই যেন ওখানে দৃষ্টি আঁটকে যায়!
– দেখুন তো, এই অঞ্জনটার কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই। আপনাকে এভাবে কষ্ট দেবার কোন মানে আছে? আমার কাছে ঠিকানা তো ছিলই।
– না না, এতে কষ্টের কি আছে? আপনি এখানে নতুন, পথঘাট চিনতে তো কিছুটা সময় লাগবে। তাছাড়া, আমার জন্য এটা কোন কষ্ট না। চলুন, যাওয়া যাক।

ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে একটা রিকশা নিল। সূর্যের আলো ততক্ষণে কমে এসেছে। যেতে যেতে টুকটাক কথা হয়। বীথি নিজের কথা বলে। বাবা-মেয়ের ছোট্ট সংসারের কথা। প্রকৃতিকে ভালবেসে বাবা আবাস গেড়েছেন সবুজ মায়াময়ী চা-বাগানের ছায়ায়। বীথির নিজেরও এই পরিবেশের প্রতি আকর্ষণটা প্রবল। মাঝে মাঝে মনে হয় এই সবুজের মাঝেই যদি সারাটা জীবন বাঁচা যেত! সকালে ঘুম ভাঙলে, স্নিগ্ধ সন্ধ্যায় কিংবা জোছনা রাত্রিতে এখানে জীবনের রঙটা সত্যিই অন্যরকম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে যায়। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের দু’ধারে সবুজ অরণ্যের মাঝে সারি সারি উঁচু-নিচু টিলা। দু’জনের আলাপচারিতায় সময় কেটে যায়, ওরা পৌঁছে যায় গন্তব্যে। তখন দিনের উজ্জ্বল আলো কমে গিয়ে অস্তগামী সন্ধ্যার লালিমা ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। গাছপালা ঘেরা এই জনপদে যেন ঝুপ করেই রাত নামে।
এখানে রাতের ছবিটা অন্যরকম! দৃষ্টির মায়ায় চা বাগানের বিশালতা অনিরুদ্ধর মনের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো নিমেষেই। যতদূর চোখ যায় বাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা শেড-ট্রি আর চা-গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলোর লুকোচুরি খেলাটা দারুণ উপভোগ্য লাগছিলো। খোলা বারান্দায় বেতের সোফায় বসে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। এতদিন ভাবত, সাগর পাড়ের জোছনার সাথে আর কিছুর তুলনা হয় না। আজ মনে হচ্ছে, এ এক অন্যরকম সৌন্দর্য। সারাদিনের ট্রেন জার্নির ক্লান্তি শেষে এই অসাধারণ মোম-জোছনায় অবগাহন; রাতে ঘুমটা বেশ আরামের হবে!
জানালা দিয়ে সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল অনিরুদ্ধর। পর্দাটা সরাতেই ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগলো মুখে। চা বাগানে প্রথম সকাল। বাইরে বেরিয়ে আসলো ও। চারিদিকে চোখ জুড়ানো সবুজের মাঝে বাংলোটা চমৎকার। সামনের প্রশস্ত বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। খোলা বারান্দায় এসে ব্যাপারটা চোখে পড়লো অনিরুদ্ধর। সবুজ চা গাছগুলোর উপর দিয়ে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে ভোরের সূর্যের স্নিগ্ধ আলোটা চুইয়ে নেমে এসেছে বাংলো বাড়িটার উপরে। এখান থেকে বাগানের বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। কাল সন্ধ্যায় যখন এসেছিলো এখানে, আধো-অন্ধকারে ভাল করে দেখা হয়নি। অনিরুদ্ধ বাংলো থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটে ঘাসে ছাওয়া সবুজ কার্পেটের চত্বরে। বাগানের মধ্য দিয়ে সরু পথ ধরে কিছুদূর গিয়ে বাঁক ঘুরতেই সবুজের স্বর্গরাজ্যে হারিয়ে যায়। ছোট ছোট টিলার গায়েই তৈরি হয়েছে এই বাগান। বিস্ময়কর এক অচেনা জগত!

পাহাড়ের ঢাল ছেড়ে কিছুটা দূরে বাগানের মধ্য দিয়ে ছুটে চলা সরু পথটার দিকে চোখ পড়তেই দেখে সে পথ ধরে এদিকেই এগিয়ে আসছেন জামিল সাহেব। অঞ্জনের মামা। তাঁকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো অনিরুদ্ধ।
সামনে এসে ওর কুশল জিজ্ঞেস করেন জামিল সাহেব।
– কি বাবা, কেমন লাগছে চা বাগানের পরিবেশ?
– অসাধারণ! জায়গাটা খুব সুন্দর।
– কোন কিছুর প্রয়োজন হলে বীথিকে বোলো। আমি ব্যস্ত থাকি, হয়ত তোমাকে সময় দিতে পারবো না।
– না না! আপনাকে একদম ভাবতে হবে না, মামা।
– না ভাবলে কি চলে? একমাত্র ভাগ্নের কড়া হুকুম, তোমার যত্নে যেন কোন ত্রুটি না হয়!
অনিরুদ্ধ হাসে।
ফিরে এসে বাংলোর পাশের ফুলের বাগানটির দিকে এগিয়ে যায় অনিরুদ্ধ। ছোট্ট বাগানটিতে নানান জাতের ফুলের সমারোহ, সেখানে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। কক্সবাজারে ওর বাগানটিতে ঠিক যেমন করে ও। তবে এই বাগানটি আরও সুন্দর, বেশ গোছানো।
– কখন উঠেছেন?
– ও আপনি! বীথির কণ্ঠ শুনে পিছনে ফিরে তাকায় অনিরুদ্ধ। এইতো কিছুক্ষণ।
– রাতে ভাল ঘুম হয়েছে তো?
– হুম, দারুণ! কাল তেমন চোখে পড়েনি, আপনাদের এই জায়গাটা ভীষণ সুন্দর।
– আমাদের কাছে নতুন কিছু না, রোজই দেখি তো!
– এই গাছগুলো কি আপনার লাগানো?
– হুম। নিষ্কর্মা মানুষের কাজ আর কি।
অনি স্মিত হাসে।
– তাহলে তো আমিও নিষ্কর্মা।
– সে কেমন?
– এই কাজটা করতে আমারও যে ভাল লাগে। আমার ডেরার সামনে ছোট্ট একটি বাগান আছে, যদিও আপনার মত করে যত্ন নিতে পারিনা। আসলে যত্ন ব্যাপারটা মেয়েদের সাথে খুব যায়।
– ছেলেরা বুঝি যত্ন নিতে জানে না?
– ঠিক তা নয়, তবে মেয়েদের মত পারে না।
অনিরুদ্ধর কথা শুনে হেসে ফেলে বীথি। অনিরুদ্ধ ভাবে- শুধু চোখ নয়, মেয়েটার হাসিটাও সুন্দর।
বীথি বলে, ঐ পাহাড়ের ওপাশে একটা চমৎকার লেক আছে, লেক পার হলেই আদিবাসীদের গাঁ। আপনাকে ওদিকটা দেখিয়ে আনবো।
– আপনাদের খুব বিরক্ত করছি, তাই না?
– কী যে বলেন! বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই, বরং আপনার সৌজন্যে আমারও কিছুটা বেড়ানো হবে। বীথি হেসে জবাব দেয়।
– আজ সারাদিন আমাদের পরিকল্পনা কি?
– আপনি যেভাবে বলবেন তা-ই! মৃদু হেসে বীথি উত্তর দেয়।
– আমি তো এখানে অচেনা পথিক। আপনি যেদিকে পথ দেখাবেন সেদিকেই হাঁটব। অনিরুদ্ধ হেসে জবাব দেয়।
– দিলেন তো আমাকে ফাঁসিয়ে! ঠিক আছে, আজ আমরা লাউয়াছড়া যাব।
– তবে তাই হোক!

পড়ন্ত বিকেল। দু’পাশের আকাশ ছোঁয়া ঘন গাছগাছালি ঘেরা বনপথের নিবিড় মায়ায় পাশাপাশি হেঁটে চলে দু’জন মানব মানবী। একটানা ঝিঁঝিঁপোকা ডাকার শব্দ ভেসে আসে। পাখিদের বিরামহীন কলতানের সাথে বনমোরগের ডাকও শোনা যায়। গাছের ডালে কাঠবিড়ালিদের অবাধ বিচরণ দৃষ্টি এড়ায় না। এ গাছ থেকে ও গাছে লাফিয়ে ছুটে চলে বানর আর উল্লুকের দল। মাঝে মাঝে ফিরে তাকিয়ে দেখে বিরক্তকারী অনুপ্রবেশকারীদের। এই জঙ্গলে এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়, তবে অনিরুদ্ধ’র জন্য একটা নতুন অভিজ্ঞতা।
অনিরুদ্ধ খেয়াল করে হালকা- পাতলা গড়নের মেয়েটি আচরণে যথেষ্ট আন্তরিক, রুচিশীলও বটে; তবে নিজের চারপাশে যেন একটা কোমল গাম্ভীর্যের দেয়াল তুলে রেখেছে। যা সহজে অতিক্রম করা যায় না। হাঁটতে হাঁটতেই টুকটাক কথা হয়। কদাচিৎ চোখাচোখি। মেয়েটির চোখ দু’টিতে যেন সাগর নীলের স্বচ্ছতা, ওখানে অনায়াসে ডুব দিয়ে থাকা যায় দীর্ঘকাল।
হঠাৎ আনমনা হয়ে যায় অনিরুদ্ধ। চকিতেই আরেকটা ছবি ভেসে ওঠে মনে। দু’টি গভীর কালো চোখ। যে চোখই অনিরুদ্ধকে আচ্ছন্ন করে রাখে সারাক্ষণ। এর মায়ায় পড়ে আজও থিতু হতে পারল না।
– জায়গাটা খুব বেশি নীরব, তাই না?
– বীথির কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকায় অনিরুদ্ধ।
– হুম। আপনি বুঝি প্রায়ই আসেন এদিকে?
– একা আসা হয়নি কখনও। শ্রীমঙ্গলে কেউ বেড়াতে এলে তাদের সাথেই এসেছি কয়েকবার। তবে যতবার এসেছি ভালোলাগা বেড়েছে একটু একটু করে। আপনার ভাল লাগছে না?
– এত সুন্দর জায়গা আর সেইসাথে এমন একজন সঙ্গী সাথে থাকলে কার না ভাল লাগে বলুন?
– বীথি হাসে। -যাক তবুও আপনার কাজে লাগতে পারছি। অঞ্জনদা অন্তত আমাকে দোষ দিতে পারবে না।
– আপনাদের মধ্যকার সম্পর্কটা চমৎকার! সবাই সবাইকে খুব ফিল করেন, তাই না?
– আসলে আমার কাজিন বলতে এই দু’জনই। অঞ্জনদা আর নীলাপু। নিজের থেকে কখনও ওঁদেরকে আলাদা ভাবতে পারিনা। ওঁরাও তাই। সামনে একটা ঝর্না আছে। অবশ্য এখানকার লোকজন এটাকে ছড়া বলে, তবে আমার কাছে ঝর্ণাই। যাবেন?
– যাবো না মানে! যাওয়ার জন্যই তো আসা। কিন্তু কতদূর?
– অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।
– আমি ভাবছি আপনার কথা। হাঁটতে কষ্ট হবে না তো?
– বীথি হেসে জবাব দেয়- তাহলে চলুন, আমার হাঁটার অভ্যেস আছে।
অনিরুদ্ধ মেয়েটিকে যতই দেখে ততই অবাক হয়। কোন কিছুতেই না নেই তার। যেন অফুরন্ত প্রাণশক্তি!

সুদক্ষ গাইডের মত বীথি এগিয়ে চলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা পৌঁছে যায় ছড়াটার কাছে। সাদা বালির মাঝখানে একটি ক্ষীণ জলের ধারা বয়ে চলেছে। ছড়ার উপরে একটি কাঠের সেতু। দু’জনে সেতুর উপরে দাঁড়ায়। বাগানের গাছপালার মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে ছড়াটি বহুদূর চলে গেছে।
– জানেন, গতবার নীলা’পুরা এসেছিল। সিহাব ভাইয়া নিচে নেমে ঠিক এখানেই একটুর জন্য চোরাবালি থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
– এখানেও চোরাবালি আছে?
– হুম।
– আপনি কখনও নেমেছেন?
– নাহ! পাগল?
অনিরুদ্ধ হেসে ফেলে।
বীথি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে- এবার আমাদের ফিরতে হবে।
– আনন্দের সময়গুলো যেন খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়, তাই না? অনিরুদ্ধ হেসে বলে।
– হুম। বেশিক্ষণ স্থায়ী হলে হয়তো সেই ক্ষণগুলো আর আনন্দময় থাকত না।
– চমৎকার বলেছেন। চলুন যাওয়া যাক।

একঘেয়ে কর্মমূখর দিনগুলোর চাপে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো অনিরুদ্ধ। তারপর এখানে এই ভাবনাবিহীন সময়গুলো দারুণভাবে উপভোগ করছিলো। সকাল-দুপুর-বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা আসে। একেকটা ক্ষণ যেন উড়ে চলে যায়।
এখানে জীবন কোন এক অদৃশ্য সূতোয় বাঁধা। ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন, হাসি-কান্নার বাঁকে হারিয়ে যায় ক্ষুদ্র সত্ত্বার চাওয়া পাওয়াগুলো। আজকের দিনটা চা বাগানেই পার করেছে অনিরুদ্ধ। চা শ্রমিকদের সাথে। বাগানের নারী শ্রমিকদের কচি পাতা উত্তোলনের দৃশ্যের কথা এর আগে বিভিন্ন লেখা পড়ে জেনেছে, লোকমুখে শুনেছে। আজ নিজেই দেখছিলো। কষ্টকর সারাদিনের পর কত সামান্যই প্রাপ্তি ওদের! সময়গুলো কিভাবে যেন দ্রুত শেষ হয়ে যায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে আসে।
শেষ বিকেলে দুজনে বসে পাহাড়ের ঢালে। সম্মুখে পাহাড়ের গা বেয়ে প্রবাহিত সেই অগভীর লেক। স্বচ্ছ টলটলে পানি! পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা লেকটির মাঝখানে একটি জলের ধারা বয়ে চলেছে কেবল। সামনে তাকালে অনেকদূর পর্যন্ত সবুজের হাতছানি। লেকটির ওপারে দল বেঁধে হেঁটে চলেছে অল্প বয়সী খাসিয়া মেয়েদের একটি দল।
– আপনার কথাই ঠিক। জায়গাটা খুব সুন্দর।
– কক্সবাজারের চেয়েও? অনিরুদ্ধর মুখে প্রশংসা শুনে বলে উঠলো বীথি।
– আমি ঠিক এভাবে তুলনা করি না। দু’টোর সৌন্দর্য দু’রকম।
– শুনেছি আপনি দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারে আছেন; এতদিন এক জায়গায় বোর লাগে না?
– না! তবে সাগরের বিশালতায় নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হয়।
– সে তো আমরা সবাই।
– পাহাড়, সাগর, সবুজ! এ কারণেই আমাদের দেশটা এত সুন্দর।
– জানেন, এই জায়গাটা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার কথা ভাবতেও পারি না। এখানকার পাহাড় ঘেরা সবুজ আর আঁকাবাঁকা এই শান্ত লেক; আর ঐ যে দূরে দেখা যায় খাসিয়া পল্লী! ওদের সহজ সরল জীবনধারা। কেমন যেন মায়া ধরে গেছে।
– চলে যাবার দরকারই বা কী? থেকে যান এখানেই।
– চাইলেই কী থাকা যায়? বাবার চাকরি আর মাত্র ছ’মাস, তারপর এখানকার পাট চুকাতে হবে।
– এখানে কোথাও স্থায়ী বসতি গড়ে নেন না!
বাবার তেমন ইচ্ছে নেই। তিনি তার নিজ গাঁয়েই ফিরে যেতে আগ্রহী। এজন্য তাঁকে দোষ দেইনা, শেকড়ের কাছে ফেরার ইচ্ছাটা সবারই প্রবল থাকে। আপনার নেই?
– আমার তো কোন শেকড় নেই, আমি হলাম ছন্নছাড়া, যাযাবর মানুষ। অনিরুদ্ধ হাসে।
বীথিও হেসে ফেলে। তারপর বলে,
– আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পেরেছি।
হঠাৎ চমক লাগে অনিরুদ্ধর।
– কী করে? আমাদের আগে কখনো দেখা হয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না!
– আপনার হয়ত মনে নেই। ব্যস্ত মানুষ, এই নগণ্য বীথিকে মনে থাকার কথাও না। লাজুক হাসি হেসে বলে বীথি।
– আমার মনে হয় আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনাকে দেখলে ভুলে যাবার কথা না।
– আমি কি বলেছি অতি সম্প্রতি আমাদের দেখা হয়েছে? সে অনেক আগের কথা। নীলাপুদের ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আপনি ওখানে প্রায়ই আসতেন। সেখানেই দেখা। মনে আছে তখন আপনাকে অনিদা নামেই ডেকেছিলাম।
– অনেকেই আমাকে ও নামে ডাকতো।
বীথি আবার হাসে।
অনি কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে,
– এবার বোধহয় চিনতে পেরেছি, আপনি তখন অনেক ছোট ছিলেন।
বীথি হেসে বলে -আপনার বয়সটাও তেমন বেশি ছিল না তখন!
– হুম, সময় তো আর থেমে থাকে না!
– ছোটবেলাটাই আসলে ভাল সময়। অনেক মন খারাপ করা মুহূর্তে ছোট্টবেলার স্মৃতি মন ভাল করে দেয়।
– আপনাকে দেখি আমার রোগে পেয়েছে!
– কি রকম?
– নস্টালজিয়া।
– ওটা কি আপনার একার? বীথি হেসে বলে।
– আমি প্রায়শই ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতির মধ্যে ডুব দেই।
– একটা কথা মনে পড়লো হঠাৎ।
– কি?
– ক্যারাম খেলার কথা?
অনি হঠাৎ হো হো শব্দ করে হেসে ফেলে।
– কী নাছোড়বান্দা মেয়ে ছিলেন আপনি! সেবার আমাদের অনেক ভুগিয়েছিলেন।
বীথি কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অনির দিকে। এখানে আসার পর এই প্রথম অনিকে প্রাণখুলে হাসতে দেখলো।
– আপনি খুব ভাল কবিতা লিখতেন। একজন আপনার কবিতা খুব পছন্দ করতো।
– হঠাৎ অনি চুপ হয়ে যায়। চকিতে একটা নাম ভিড় করে মনের কোণে।
– আপনি কি এখনো কবিতা লিখেন?
বীথির কণ্ঠ শুনে চমক ভাঙে।
– নাহ! এখন আর লেখা হয় না।
– কেন? নীলাপুর কাছে আপনার অনেক কবিতা ছিল, আমি পড়েছিলাম সেগুলো। নীলাপু খুব সুন্দর আবৃতি করতো। আমি ওঁকে দেখেই আবৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম।
– আজ অনেকদিন পর আবৃত্তি শুনতে বড় ইচ্ছে করছে। শোনান না একটা।
– এখনই?
– হুম। এই চমৎকার পরিবেশে আপনার কণ্ঠে আবৃত্তি মনে হয় জমবে ভাল। নিন শুরু করুন।
বীথি স্মিত হেসে বলে, ভাল না লাগলে আমার কোন দোষ নেই।
অনি হেসে জবাব দেয়- আচ্ছা, সব দোষ আমার।
সামনে খাসিয়া পল্লীর উপরে খোলা আকাশ, নিচে স্বচ্ছ-অগভীর লেক, বীথি সেদিকে তাকিয়ে শুরু করে-

“আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো
সহজ মহৎ বিশাল,
গভীর; – সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে
মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন,
আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।
সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো:
সেই দিনের – আলোর অন্তহীন এঞ্জিন চঞ্চল ডানার মতন
সেই উজ্জ্বল পাখিনীর – পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে
অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন।”

অনি যেন নিমেষেই ডুবে যায় কবিতায়। চোখে ভেসে ওঠে অসীম সাগরের মত গভীর দু’টি চোখ। যে চোখই ছিল একসময় ওর কবিতা লেখার প্রেরণা। অমন চোখের মাঝে হারিয়ে যাওয়া যায় অনায়াসে। পাহাড়ি ঝর্নার মত কলকল হাসির ঝংকার! সেই চমৎকার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। তখনই হঠাৎ মনে হয়- ওর ভাগ্যটা তো চৈত্র মাসের শুকনো খড়খড়ে মাঠ! রোদে পোড়া তপ্ত মাটি সিক্ত হয়না কখনো।
কবিতা শেষ করে বীথি তাকিয়ে থাকে আনমনা অনি’র দিকে। একটু পর বলে,
– বোধহয় আপনার মন খারাপ করে দিলাম।
অনি হঠাৎ ফিরে আসে বাস্তবে।
– না না, মন খারাপের কিছু নেই। আপনি খুব ভাল আবৃত্তি করেন। জীবনানন্দের খুব ভক্ত, তাই না?
– হুম। ওঁর বেশীর ভাগ কবিতা আমার মুখস্ত।
দু’জনে আরও কিছুক্ষণ বসে থাকে, পাশাপাশি। দু’জনের মনের মধ্যে অন্যরকম ভাবনা খেলা করে। অনিরুদ্ধ ডুবে যায় এক ভিন্ন জগতে। ধীরে ধীরে বেলা কমে আসে। ছোট্ট লেকটার ওপারে খাসিয়া মেয়েরা এখন ফিরে চলেছে গৃহপানে। বীথি বলে,
– এবার ফেরা দরকার।
– তাহলে চলুন।
দিনগুলো এমনি করেই ফুরিয়ে যায়। ভাললাগা ছুটির সময়গুলোও যেন দৌড়ে পালায়। চা বাগানে আজকেই অনির শেষ রাত। রাত ফুরালেই তাকে চলে যেতে হবে চেনা গণ্ডিতে।

বাংলোর খোলা বারান্দায় বসে আছে অনি। সন্ধ্যার পরে ধীরে ধীরে রাত বাড়ে, গাঢ় অন্ধকার সরে গিয়ে বড় গোল থালার মত চাঁদ ওঠে আকাশে। সামনের খোলা চত্বরটুকু ঝলমল করে জোছনার আলোয়। সবুজ চা গাছগুলোর প্রান্ত ছুঁয়ে চাঁদের আলো নেমে এসে ঘাসে ছাওয়া মাঠ ছাড়িয়ে বাংলোর বারান্দায় ছড়িয়ে পড়েছে। অনির খুব আফসোস হয় চমৎকার সময়টা কেন এত দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে।
– একা একা এখানে বসে কি ভাবছেন?
বীথির কন্ঠ শুনে ফিরে তাকায় অনি।
– তেমন কিছুনা, চন্দ্রালোতে স্নান করছিলাম।
– চমৎকার বলেছেন। এমন জোছনায় স্নান করা মন্দ নয়, তবে একা একা ভাল লাগার কথা নয়।
– এইতো আপনি এসে পড়লেন।
– আমি না হয় ক্ষনিকের সঙ্গী হলাম, তারপর? এবার একাকীত্ব ঘুচানোর ব্যবস্থা করুন।
অনি মৃদু হাসে। – চাইলেই কী সবকিছু করা যায়? আমার তো মনে হয় এই বেশ ভাল আছি, মুক্ত স্বাধীন জীবন। ইচ্ছেমত যেদিকে খুশি চলে যেতে পারি, এই স্বাধীন চলাফেরার সুযোগ হাতছাড়া করার কোন মানে হয়?
বীথিও হাসে।
– যাক, আপনার স্বাধীন জীবন সুন্দর আর আনন্দময় হোক। আপনি তো কাল চলে যাচ্ছেন, আবার কি আমাদের দেখা হবে?
– আমাদের দেশটা খুব ছোট। দেখবেন ঘুরে ফিরে কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে যাবে। তাছাড়া আমার ঠিকানা তো আপনার জানাই থাকলো, কক্সবাজারে চলে আসেন।
– ভাল বলেছেন। হয়ত এমনি করেই কোথাও দেখা হয়ে যাবে। আচ্ছা, ফেরার পথে আপনার সাথে কি নীলাপুর দেখা হবে?
– না। কেন বলুন তো?
– কতদিন নীলাপুকে দেখি না! আপনি আসার আগেরদিন ফোনে কথা হচ্ছিলো, আপনার কথা খুব বলছিলেন।
– কি কথা?
– আপনি কেমন মানুষ, আপনার যেন ঠিকমত যত্ন নেই, এই আর কি।
– যেমন অঞ্জন, তেমনি নীলাপু।
– ক্ষতি কী? এমন শুভাকাঙ্ক্ষী পাওয়া তো ভাগ্যের কথা। তবে কি জানেন- এত ভাল একজন মানুষ নীলাপু, অথচ ওনার জীবনটা অনেক কষ্টের। খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে, নিজের কষ্টের কথা কাউকে বুঝতে দেয় না।
অনি কিছু বলে না, কেবল কক্সবাজারে বিদায়ের মুহূর্তে নীলার অশ্রুসিক্ত মুখচ্ছবিটা চোখে ভাসে।
– একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? মৃদু কণ্ঠে বললো বীথি।
– করুন না!
– না থাক। যে কথা কষ্ট বাড়ায় তা না শোনাই ভাল।
– কী করে বুঝলেন কষ্ট বাড়বে?
– কার যে কখন কিসে কষ্ট বাড়ে বলা কঠিন। আমরা বরং অন্য কথা বলি।
অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলে না। চারদিকে সুনসান নীরবতা। অনি মনে মনে ভাবে- আমার সকল দুঃখ-কষ্ট অন্যদের যেভাবে ভাবিয়ে যায়, মাঝে মাঝে তা নিতান্ত লজ্জায় ফেলে দেয়।
সকাল দশটা। অনি দাঁড়িয়ে আছে ষ্টেশনে। চট্টগ্রামগামী ট্রেন এসে পৌঁছেছে কিছুক্ষণ হল। অনির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বীথি। আজকে অবশ্য ও না এলেও পারতো। তবুও নিতান্ত ভদ্রতাবশে চলে এলো। আর অন্যপাশ থেকে একজনের অনুরোধ অবশ্য ছিল, যা ওকে অনির সাথে ষ্টেশন পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছে।
– এরপর যখন শ্রীমঙ্গল আসবেন তখন হয়ত আর কেউ আপনাকে এভাবে বিরক্ত করবে না, অযাচিতভাবে বিব্রতও করবে না।  বীথি হঠাৎ বলে উঠলো।
অনি হাসে। -বিব্রত হবো? তেমন তো কিছু ঘটেনি বরং আমি এসে আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়ে গেলাম।
– হ্যাঁ, কষ্ট তো দিয়েছেনই। এই যে চমৎকার কিছু সময় পার করে চলে যাচ্ছেন, এগুলো মনে পড়লে হয়ত কষ্টই পাব। নীলাপুর সাথে দেখা হলে বলবেন- আমি ভাল আছি, বেশ ভাল।

অনি হঠাৎ থমকে যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর ট্রেনে উঠে বসে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। একটু একটু করে দূরত্ব বাড়ে দু’জনার। বীথি দাঁড়িয়ে থাকে স্টেশনে। একসময় ট্রেনটি বাঁক নিয়ে হারিয়ে যায় সবুজ পাহাড়ের আড়ালে।

অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments