
একটা সময় নির্বাচন ছিল উৎসব। পাড়া-মহল্লায়, চায়ের স্টলে, সেলুন-মুদির দোকান- কোথাও বাদ ছিল না। সে উৎসবের আমেজ ছিল সর্বত্র, ঘরে ঘরে, মাঠে-রাস্তায়। মানুষের চোখে-মুখে আনন্দ খেলা করতো। মুড়ি, খিচুড়ি, বিস্কুট, কত রকমের খাবার। ছেলেপুলের দল জোট বেঁধে, কোমড়ে মাফলার পেচিয়ে, আস্তিন গুটিয়ে, মিছিল করতো। বাহারী মিছিল। কত রকমের স্লোগান, নিজেরা নিজেরা বানাতো। শোভা পেত হাতে বানানো প্রার্থীর প্রতীক, কখনোবা আসল জিনিসটাই এনে তুলতো মিছিলে। সে মিছিল দেখার জন্য পাড়ার মুরব্বি, নানা বয়সী মানুষ অপেক্ষা করতো। হাসতো। আনন্দ পেত।
ভোটের দিনটাও ছিল আনন্দের। ঘরে ঘরে উৎসব। চোখে-মুখে হাসি। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্যই কত প্রস্তুতি। নতুন শাড়ি, মাথায় ঘোমটা। মেয়েরা নতুন সালোয়ার কামিজ পড়তো। টিপ দিতো কপালে। মুরব্বিরা পান চিবুতো। হাতে লাঠি নিয়ে, ঠোট রাঙিয়ে ভোট দিতে যেত।
ভোট কেন্দ্রে কী কদর ভোটারের, কী যত্ম-আত্তির! সকালে গেলে এক অভাবনীয় দৃশ্য চোখে পড়ে। বুথগুলোর সামনে স্বেচ্ছাসেবক নারীরা লালপেড়ে হলুদ শাড়ি পড়ে হাসিমুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। বুথগুলো সুন্দর করে সাজানো। লম্বা লাইন। স্লিপ হাতে। সুনশান। শান্ত-স্থির। একজন একজন করে ভেতরে ঢুকছেন, ভোট দিচ্ছেন, হেসে হেসে বের হচ্ছেন। এ দৃশ্য আমি বহুবছর দেখেছি, শৈশব থেকে।
আর মাঠের বাইরে, উৎসুক মানুষের ভীড়। সেখানে প্রার্থীর সমর্থক-কর্মীরাও আছেন। চায়ের স্টল বসেছে। বাদাম-বুট বিক্রি হচ্ছে। বেলুনের দোকান। পান-বিড়ি-সিগারেট। কে জিতবে, কে হারবে, সে সব নিয়ে যত না তর্ক-বিতর্ক; তার চেয়ে বেশি বহুদিন না দেখা চেনা মানুষটিকে দেখে আনন্দ প্রকাশ।
আগামীকাল শনিবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন। প্রচারণা শেষ হয়েছে শুক্রবার মধ্যরাতেই। আজ ঘরে ঘরে নিরবে ভোট চাইতে পারবেন প্রার্থীরা। ভোটারদের কাছে পৌঁছে দেবেন ভোটের স্লিপ। নির্বাচনী ক্যাম্পগুলোতে নানা হিসেব-নিকেষ নিয়ে ব্যস্ত প্রার্থীর লোকজন। এতদিনের মুখর শহর, আজ নিরব। মাইকের শব্দ নেই। কান ঝালাপালা প্যারোডি গান নেই। টুকটাক যে মিছিল, তাও নেই। মানুষ অপেক্ষা করছে ভোটের।
সেদিন রাতে অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলাম। বাসার সামনে রিকসা থেকে নামতেই একজনের পোস্টার দেখে রিকসাচালক বললেন, ডিপজলের মতো দেখতে। ডিপজল মানে বাংলা চলচ্চিত্রের খলনায়ক। আমি হাসলাম। বললাম, কি মনে হচ্ছে, নির্বাচন কেমন হবে? এবার রিকসাচালক সিরিয়াস। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ভোট তো হয়েই গেছে। আমি বললাম, মানে? ভোট তো শনিবার। লোকটি বললো, সব ঠিক হয়ে আছে। এটা তো খালি দেখানোর জন্য। আমি হাসলাম। কি বলে লোকটা!

এখানে ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরণের অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ভোট কারচুপির বিষয়ে। সাধারণ ভোটারদের ধারণা, কে বা কারা আগে-ভাগেই বাক্সে ব্যালট ভরে রাখে। পরে ভোটের দিন লোকদেখানো ভোট নেয়। এই যে এবার ইভিএমে ভোট হবে, সেখানেও একই শঙ্কা প্রকাশ করছে। তারা মনে করছে, আগেই ইভিএমে সব ঠিক করে রাখা আছে। এখন শুধু ভোটের সময় গেলেই গণনা করবে।
ভোট নিয়ে এই যে অবিশ্বাস, সেটার সবটুকু সত্যি নয়। বেশির ভাগই অমুলক ও ধারণা। সংবাদকর্মী হিসেবে আমি প্রতি নির্বাচনেই মাঠে থাকি। আগামীকালও থাকবো। একেবারে বুথ পযন্ত ঢুকতে পারি। ঢুকি। দেখি। যে কারচুপির কথা বলা হয়, সেটা পুরোপুরি সত্য নয়। এখন গণমাধ্যম এত শক্তিশালী ও মানুষের চোখমুখ এত খোলা যে, এভাবে প্রকাশ্য কারচুপি করা সম্ভব নয়। তবে আমি কয়েকটি নির্বাচনে ছেলেপেলেদের জোট বেঁধে ব্যালটে সিল মারতে দেখেছি।
তা হলে ভোটের প্রতি মানুষের এই অবিশ্বাসটা এলো কিভাবে? হুম, প্রশ্নটা সেখানেই। প্রত্যেক নির্বাচনেই ক্ষমতাসীনরা এক ধরণের কৌশল নেয়। নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা পক্ষপাতিত্ব করেন। জাল ভোট যে হয় না, তা নয়, হয়। তবে সেটার পরিমান খুব বেশি না। সমস্যা হচ্ছে প্রতিপক্ষ আগেভাগেই মাঠ ছেড়ে দেন। ভোটের পরিমান কমে যায়। বিপক্ষ দলের লোকজন ভোট দিতে খুব একটা আসেন না। ফলে মাঠ থাকে ক্ষমতাসীনদের দখলে। তারা ইচ্ছেমত নিয়ন্ত্রণ করেন।
গত কয়েকটি নির্বাচনে বিপক্ষ দলের মাঠ ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। প্রতিরোধ নেই। বুথে এজেন্ট থাকে না। দেয় না। ভোটার স্লিপ দেওয়ার মতো লোকও থাকে না। এমনকি এবার তো বাসায় বাসায় আওয়ামী লীগ ছাড়া বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা অন্য কোন দলের কোনো প্রার্থীকে লিফলেট বিলি করতে দেখলাম না। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোন প্রার্থী ভোটও চাইতে এলো না।
আমার একটা ধারণা, এবার মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই ভোট হবে। দু’তিনটি এলাকায় ছোট আকারের সংঘর্ষ বা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। তবে বড় ধরণের কোন বিশৃঙ্খলা এবার হবে না। সংঘর্ষও না। মুল প্রতিদ্বন্দ্বি বিএনপির প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। প্রকাশ্যে কোন অনিয়ম বা ভোটকারচুপির ঘটনা ঘটলেও সেটা দলটি কতটুকু প্রতিরোধ করতে পারবে, সে সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কাউন্সিলার প্রার্থীদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা থাকবে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কিছু কাউন্সিলার, তাদের দল সমর্থিত প্রার্থীদের সঙ্গে কিছু ঝামেলা হতে পারে।
উত্তর সিটিতে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলামের সঙ্গে বিএনপির তাবিথ আউয়াল লড়ছেন। সেখানে খুব একটা ভোটযুদ্ধ হবে বলে আমার মনে হয় না। এখানে নৌকা নির্বিঘ্নে জিতে যাবে। এমনকি এখানে হট্টগোলের আশঙ্কাও কম। তবে সবার নজর দক্ষিণে। সেখানে এবার আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদল করেছে। নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ছেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের শেখ ফজলে নূর তাপস। স্থানীয় সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে তিনি মেয়র হতে চাইছেন। বিপরীতে বিএনপির ইশরাক হোসেন। তিনি অবিভক্ত ঢাকার সাবেক জনপ্রিয় মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার ছেলে। এই সিটিতে তাপসের যেমন জনপ্রিয়তা রয়েছে, তেমনি বাবার উত্তরসুরী হিসেবে ইশরাকও বেশ শক্তিশালী। তবে বিএনপি দলীয় কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ঠিক কতটুকু মাঠে থাকতে পারবে, সে নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ সাদেক হোসেন খোকার লোকজন দীর্ঘদিন মাঠে নেই। তাদের রাজনীতিও নেই। তারা তাদের প্রয়াত নেতার ছেলের জন্য ঠিক কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারবেন, সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
এবার নির্বাচনে মুল লড়াইটা হবে কাউন্সিলার প্রার্থীদের মধ্যে। এখানেই কেউ কাউকে ছাড় দেবেন না। নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালীন যে ক’টি সংঘর্ষ হয়েছে, তার বেশির ভাগই কাউন্সিলার প্রার্থী, সমর্থক ও কর্মীদের মধ্যে। এমনকি আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এ ছাড়া শহর জুড়ে এসব কাউন্সিলার প্রার্থীরাই মাঠ গরম করেছিলেন। উত্তেজনা ছড়িয়েছেন। কারণ শেষদিন পযন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে বিদ্রোহী প্রার্থী বেশ দাপট নিয়ে মাঠে ছিলেন।
বিকেল পাঁচটার দিকে অফিসে বসে যখন এই লেখা লিখছি, তখনো চারপাশ থেকে নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা তথ্য আসছিল। বিশেষ করে কাকরাইলে বিএনপির কেন্দ্রিয় কাযালয় থেকে নানা আশঙ্কামুলক খবর দিচ্ছিলেন আমাদের সংবাদকর্মীরা। কিছু কেন্দ্রের আশেপাশের লোকজনও নানা ধরণের তথ্য দিচ্ছিলেন। যাচাই-বাছাই ছাড়া এসব তথ্য ঠিক কতটুকু সত্য, তাই শুনে যাচ্ছিলাম মাত্র। কারণ নির্বাচনকে ঘিরে নানা মহল নানাকাজে লিপ্ত থাকে। সুতরাং সঠিক তথ্য ছাড়া কোনকিছুতেই বিশ্বাস করা যাবে না।
কাল আমিও ভোট দিতে যাবো। আমার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেব। এই নগরে শহরে বহুবছরের বাস। এখানকার সংকট সমস্যা জানি। বুঝি। প্রার্থীদেরও চিনি। বিশেষ করে মেয়র প্রার্থীরা মুখস্থ। এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন। রাজনীতি যত না মুখ্য, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, স্থানীয় সংকট। যে প্রার্থী নাগরিকদের বুঝবেন, বোঝার সক্ষমতা ও মন-মানষিকতা রয়েছে, তাদেরই নির্বাচিত করা উচিত। প্রতিনিধি নির্বাচনে ভুল হলে, পরবর্তি পাঁচটি বছর আমাদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে, কষ্ট পেতে হবে। এই শহরে এমনিতেই নানা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করছি আমরা। এবার সেখান থেকে মুক্তি চাই।
ভোট নিয়ে আমার একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে আমি ভোট দিতে গিয়ে দেখি আমার নাম ও সিরিয়াল নম্বরের পাশে টিক চিহ্ন দেওয়া। মানে ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। আমি চ্যালেঞ্জ করলাম। দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার ও প্রিসাইডিং অফিসাররা ভড়কে গেলেন। শেষঅবধি ‘টেন্ডার্ড ব্যালট পেপারের’মাধ্যমে আমি ভোট দেই।
এবার ইভিএমে ভোট। এক্সাইটিং মেটার। জীবনের প্রথম এভাবে ভোট দেব আমি। তাই এবার ভোটটা দিতে চাই। তাছাড়া এবার টেন্ডার্ড ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থাও নেই। তাই যদি কেউ আগেভাগেই বা ভুল করে আমার ভোটটা দিয়ে দেন, তা হলে বহুকাঙ্খিত ভোটটা দেওয়া হবে না আর।
ভোট উৎসবমুখর হোক। মানুষ আনন্দে, হেসে হেসে, লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে, শীত সকালে ভোট দিক। নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করুক। নিশ্চয়, সুন্দর ও সুশৃ্ংখল ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধি নাগরিকদের কষ্ট বুঝবে। সংকট সমাধানে সর্বোচ্চটুকু আত্মত্যাগ করবে। কারণ এই শহরে বহুকষ্টে নানা যন্ত্রণা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাস করতে হচ্ছে আমাদের।
৩১ জানুয়ারি শুক্রবার ২০২০
পশ্চিম মালিবাগ, ঢাকা।
প্রতীক ইজাজ: সাংবাদিক।