রোহিঙ্গামুক্ত কক্সবাজার জরুরী প্রয়োজন । রণেশ মৈত্র

  
    

বাংলাদেশের স্বার্থে শুধুমাত্র কক্সবাজারকেই রোহিঙ্গামুক্ত নয়, গোটা বাংলাদেশকেই রোহিঙ্গামুক্ত করা জরুরী প্রয়োজন। বিগত কয়েক বছর যাবত এদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সামগ্রিক আচরণ, ঐ সৌন্দর্য্যলীলার কেন্দ্রস্থল কক্সবাজারে সৃষ্ট মারাত্মক পরিবেশ দূষণ, বেপরোয়া চোরাকারবারী, অস্ত্র ও মাদক আমদানীর ভয়াবহতা এবং ব্যাপক সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে একটি বিশেষ ষড়যন্ত্র সফল করার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে তাদের অবাধ বিচরণ, কিছুতেই মিয়ানমারে না ফেরা এবং বাংলাদেশে, বিশেষ করে কক্সবাজার ও তার চতুর্দিককার সীমান্ত এলাকায় থাকার জিদে, সন্ত্রাসী ও জঙ্গী-উৎপাদনের লীলাভূমিতে ঐ বিশাল এলাকাকে পরিণত করা, কক্সবাজারের আদি অধিবাসীদেরকে শুধুমাত্র সংখ্যালঘুতে পরিণত করাই নয়, তাদেরকে উৎখাত করার সুদূর প্রসারী লক্ষ্য নিয়ে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা, দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট প্রভৃতি সংগ্রহ করে দেশ বিদেশে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দেওয়া-প্রভৃতি হেন অপকর্ম নেই যার সাথে এদেশে ‘অস্থায়ীভাবে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নেতৃস্থানীয় অংশ জড়িত নয়’।

যতটুকু লক্ষ্য করেছি, আমাদের সরকার মানবতার নামে যে উদারতা দেখিয়ে তাদের অবাধে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ দিতে সীমান্ত এলাকা উন্মুক্ত করে দিয়ে “১৬ কোটি মানুষ না হয় এক বেলা খাব-তবু রোহিঙ্গাদের অনাহারে থাকতে দেব না” বলে সীমাহীন মমতা দেখিয়েছিলেন, রোহিঙ্গারা তাকে তাদের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণ বলেই ধরে নিয়েছিল এবং সেই ধারণা থেকেই তারা নির্বিবাদে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল।
বাঙালির জীবনেও নির্বিচারে ভয়াবহ বর্বর সামরিক বাহিনীর নির্য্যাতনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। যে কোন হিসেবেই সে নির্য্যাতন রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্য্যাতন অনেক বেশী ভয়াবহ। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ১৯৭১ এ বাঙালির হেন বাড়ী ছিল না যা জ্বালিয়ে দেয়নি, তারাও ভিন্ন ভাষায় হলেও বাঙালিদের পাকিস্তানী নাগরিকত্ব অস্বীকার বলেছে বাঙালিরা খাঁটি পাকিস্তানী নয়-তারা হিন্দু-তারা ভারতের প্রতি আনুগত্যশীল। তার ফলে এক কোটি বাঙালী ভারতে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, শ্রেফ জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজন।
যে এক কোটি বাঙালি ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা কেউ সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত হননি, কেউ চোরাকারবাড়ী, অস্ত্রের চোরাচালানী, মাদক পাচার, ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণের সামান্যতম চেষ্টা বা প্রয়োজনের চাইতে একদিনও বিদেশের মাটিতে থাকতে চান নি। শরণার্থী শিবির ভারতের পূর্বাঞ্চল জুড়ে ভারত সরকার গড়ে ঐ দেশত্যাগী বাঙালিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন যেমন, বাঙালিাও তেমন নানা কষ্ট সহ্য করে সেগুলিতে অবস্থান করেও কদাপি কেউ ভারতের কোন আইন লংঘন করে নি। ক্যাম্পের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় করে মানুষ হত্যা করে ক্যাম্পের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাও কেউ করে নি।

মিয়ানমার সরকার যেমন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী নয়, পাকিস্তান সরকারও তেমনি দেশত্যাগী বাঙালিদেরকে দেশে ফেরত নিতে চায় নি। বাঙালি কোন দিন দেশে নিজভূমে থাকার অধিকার পরিত্যাগ করেনি-বরং দেশে ফিরবার প্রত্যয় নিয়ে নয়মাস ধরে সশস্ত্র লড়াই করে শত্রুপক্ষকে নির্মমভাবে পরাজিত করে বীরের মত দেশে ফিরে এসে দেশের জাতীয় পরিচয়পত্র, দেশের সরকারের ইস্যু করা পাসপোর্ট গ্রহণ করেছে। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে গিয়ে ৩০ লক্ষ বাঙালি প্রাণ হারিয়েছে-চার-পাঁচ লক্ষ নারী তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন, লক্ষ লক্ষ বাড়ীঘর, দোকানপাট, জমির ফসল পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে।
সে তুলনায় রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের মিয়ানমার সরকারের নির্য্যাতন কি কোনক্রমে বেশী? মিয়ানমার সরকার যে অভিযোগ বারংবার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে উত্থাপন করেছে। রোহিঙ্গারা আরসা নামে সশস্ত্র জঙ্গী বাহিনী গঠন করে সন্ত্রাসী কার্য্যকলাপ চালাচ্ছিল তা কি পূরাপূরি মিথ্যা? আজ আমরা কক্সবাজার কুতুপালং এ রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলিতে গোপন অস্ত্র প্রশিক্ষণ, গোলাগুলি, জঙ্গী উৎপাদন ও অস্ত্রের চোরাকারবারী প্রভৃতি দেখছিলাম তারা কি দুর্নীতির মাধ্যমে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের পাসপোর্ট অফিসগুলিকে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র-পাসপোর্ট প্রভৃতি বে-আইনীভাবে সংগ্রহ করতে দেখেছি। তারা আমাদের সীমান্ত-বাহিনীর একাংশকে একইভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে অস্ত্র, মাদক প্রভৃতি পাচার করছে না? তারা সামগ্রিকভাবেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবনের প্রতিহুমকি। তাই দেশের স্বার্থেই, যে কোন মূল্যে তাদের সকলকে দেশে ফিরতে বাধ্য করার বিকল্প দেখা যাচ্ছে না।

বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গারা যাচ্ছে না নানা কারণে। ওখানে গেলে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই, বাংলাদেশে আছে-দেশে ফিরলে খেটে ক্ষেতে হবে, এখানে বিনাপরিশ্রমে বিনামূল্যে খাবার পাওয়া যাচ্ছে-ওখানে গেলে সন্তানদের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা-শিক্ষার দায়িত্ব স্ব স্ব পরিবার প্রধানকে নিতে হবে-এখানে ঐসব দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার নিজ কাঁধে স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছেন। তাদের জন্য বাড়ী, রাস্তা, স্কুল, মসজিদ-সবকিছু নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়েছে-আর চাই কি?

তারা এমন কি ভাসান চরেও যাবে না।পরবর্তীতে তাদের দেশী-বিদেশী মুরুব্বীদের পরামর্শে ভাসান চরে যেতে অস্বীকার করেছে।
ওখানে অনেকগুলি এন.জি.ও কাজ করছে। সহায়তা দিচ্ছে বটে। কিন্তু তারাও গোপনে উস্কানী দিচ্ছে তারা যেন কেউ বাংলাদেশ ছেড়ে মিয়ানমার প্রত্যাবর্তন না করে, কেউ যেন কক্সবাজার ছেড়ে ভাসান চরে না যায়। তাদের স্পষ্ট বুঝ, রোহিঙ্গারা তাদের চাকুরী থাকার গ্যারান্টি থাকবে না-যে বাজার হলে নামীদামী হোটেলে তারা বাংলাদেশে থাকছে সেই আরাম-আয়েশ থেকে তারা বঞ্চিত হবে…ইত্যাদি।
বিদেশী রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক আদালতের রায় পাওয়ার পরেও কেন উদ্যোগ নিয়ে রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে উদ্যোগী হচ্ছে না-তাও খতিয়ে দেখা জরুরী হয়ে পড়েছে। ীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাহুলাংশে থিতিয়ে পড়েছে। এাঁকে চাঙ্গা করা এবং মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তিন থেকে ছয় মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া প্রয়োজন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। রোহিঙ্গাদেরকেও জানান প্রয়োজন অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে যে, নির্দিষ্ট ঐ সময়-সীমার পর পর বাংলাদেশ সরকার আর একদিনও তাদেরকে বাংলাদেশের মাটিতে অবস্থান করতে দেবে না।
রোহিঙ্গারা সরকারের এমন ভূমিকা না দেখে ধরেই নিয়েছে তারা চিরকাল এদেশে থাকতে পারবে-তাই তারা, এমন কি, ভাসানচরে যেতেও অস্বীকৃতি জানানোর ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে।

এ অবস্থায় সুপারিশ করবো-
এক. আপাতত: প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করেও রোহিঙ্গাদেরকে ভাসানচর পাঠানো হোক অস্থায়ীভাবে;
দুই. সরকার যে সময়সীমা বেঁধে দেবেন তার একনিও বেশী কোন রোহিঙ্গাকে এদেশে কোন ক্রমেই থাকতে দেওয়া হবে না। এই কথা স্পষ্টভাবে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হোক;
তিন. যারাই রোহিঙ্গাদেরকে স্বদেশে ফিরতে বা ভাসানচরে যেতে বাধা দিচ্ছে অবিলম্বে তাদেরকে গ্রেফতার করে করারুদ্ধ করে ক্যাম্প থেকে বিচ্ছিন্ন করা হোক;
চার. নির্দিষ্ট সময় সীমার পরে সংশ্লিষ্ট কোন এন-জিও কে বাংলাদেশে বা কক্সবাজার, রাঙামাটি, চিটাগং এলাকায় কাজ করতে দেওয়া হবে না;
পাঁচ. ২০২১ সালের জুলাই আগষ্ট থেকে বিদেশী পর্য্যটকদেরকে ব্যাপক হারে কক্সবাজার রাঙ্গামাটির নানা স্থান পর্য্যটন করতে আসতে বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।;
ছয়.সরকারের এই স্থির সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও জানিয়ে দেওয়া হোক।

রণেশ মৈত্র
কলামিস্ট, রাজনীতীবিদ
একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments