লকডাউনের পনের মিনিট । আহমেদ আবিদ

  
    

কে এল থেকে শাহজালালে নেমে বিমান বন্দরে করোনা ভাইরাস নিয়ে কোন আলাদা প্রস্তুতি দেখিনি। ফেব্রুয়ারি বিশ মাঝরাতে বিমান থেকে নেমে লাগেজ নিয়ে মোহাম্মদপুর পৌঁছাতে রাত দুই টা। তবুও ভাল বড় ভাই গাড়ী নিয়ে আনতে গিয়েছিলেন। আঠারো ঘন্টার ভ্রমণ ক্লান্তি নিয়ে অন্য সময় হলে কাপড় ছেড়েই বিছানায় চলে যেতাম। সাড়ে তিন বছরের ডাকাবুকো ছেলেটার জন্য সেটা আর সম্ভব নয়। স্নানঘরে গিয়ে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সাবান শ্যাম্পু দিয়ে পর পর তিন বার গা ধুয়ে তবে খানিকটা নিশ্চিত। জীবনে বোধহয় এই প্রথম এত যত্ন করে নিজের শরীর পরিস্কার করছি। মৌ টেবিলে খাবার দিয়ে রেখেছিল। দ্রুত অল্প খেয়ে তবে শোবার ঘরে প্রবেশের অনুমতি- সেই ঘরে ঘুমাচ্ছে এক প্রাণ ভোমরা। দু’ বছর পর ডিম লাইটের আলোয় শিশু সন্তানের ঘুমন্ত মুখ দেখা জীবনের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা ! চোখ ঝাপসা হয়ে গেসে, কিস্যু দেখতে পাচ্ছি না!

এক মাসের মধ্যে জমে গেল ‘সাধারণ ছুটি’ নামে লকডাউন, লকডাউন খেলা ! এর মধ্যেই খুশিতে না হোক, ঠেলায় পড়ে ঘোরা চলছিল। মার্চের ১৯ একটা জরুরী শুটিং সিডিউল থাকায় ট্রেন ধরে ঢাকার বাইরে গিয়ে আবার রাতেই ফিরতে হল। একদম পড়ি মরি দৌড়।  ফিরে আবার মালিবাগ বড় ভাইয়ের বাসায় আস্তানা। একটা একটা করে ১৪ টা দিন পার করে তবে আবার বাবান্ডুলের সাথে সাক্ষাৎ হবে। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার করোনা পজেটিভ রোগী পাওয়া ও এলাকা লকডাউনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ১১ দিনের মাথায় মোহাম্মদপুরে দু’জন করোনা পজেটিভ পাওয়া  গেল! রিস্ক নিয়ে ১২ দিনের মাথায়ই চলে এলাম বাবান্ডুলের কাছে। পাছে পুরো এলাকা লক ডাউন করে দেয়- আর ঢুকতে না পারি!

ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয় তার দেওয়ানি। এঘর- ওঘর, এ খেলনা ও খেলনা, হুটোপুটি সব এই সাড়ে তিন ঘরের ফ্ল্যাটে! প্রতিটি ঘরের প্রতিটি  ইঞ্চি তার জানা। শেষে কি করবে বুঝতে পারে না! বারান্দায় টবের মাটি ছানা যাবে না, ডাক্তার মামুজানের ঘরের বইপত্র ছুঁতে মানা, রান্নাঘরে ঢুকতে মানা, সিঁড়িতে যেতে মানা, বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ দুমাস। ছোট মানুষটা হাঁপিয়ে ওঠে। ১২০০ স্কয়ার ফিটের এক খাঁচায় আটকে পড়া ছোট্ট প্রাণ। তাই বুঝি জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখা আর বারান্দায় বসে চুপচাপ বৃষ্টি দেখা তার খুব প্রিয় কাজ। অথচ ওই বয়সে আমার ছিল পুরো গ্রাম, একটা নদী ও মাটি জল কাদা আর আধ ডজন সম বয়েসী খেলার সাথী!

নগর জীবনের বড় যাতনা ইলেকট্রনিক মিডিয়া! টেলিভিশনগুলো হঠাৎ মনে হচ্ছে দ্রুত মিলিশিয়া আক্রান্ত এক দেশ থেকে রিপোর্ট করা শুরু করেছে। স্বাস্থ্য মুনতি মশয় আর তার আইজকার দরবার মিলে পুরাই একটা জাতীয় সার্কাস, বোকা বাক্সের কট শো, শেষে মসজিদ বন্ধ হলেও বাজার ঘাট খোলা ! সুপার শপের বাইরে দূরত্বে দাড়ালেও ফ্রি স্যানিটাইজার ঘষে ভেতরে গেলে মাত্র এক ফিট দূরত্বে বজায় রাখা যায় না! বাসা বাড়িতে কাজের বুয়া’র প্রবেশ বারণ। তাই মধ্যবিত্তের বৃত্তে ফ্রি খাবারের সাথে কাজের ভাগও মিলে। একটু আধটু বাসন মাজা, গেরস্থালির কাজে বেটার হাফকে ফুল সাপোর্ট দেয়া আর ছেলের সাথে খেলা। গবেষণা আর লেখালেখি চুলায়। জীবন আর আতঙ্কের এক অমোঘ গোল্লাছুট।

লুকোচুরি খেলা ছেলেটার প্রিয়, সেটা মাঝে মাঝে সম্ভব যখন যখন বড়রা সময় দেয়।  বারান্দা থেকে লুকোচুরি খেলা ঘরে। ডিভানে পুতুলগুলোর মাঝে বা নানীর ঘরের দরজার পেছনে লুকানো! কিন্তু এ ক’দিন বুড়ো’র বরাদ্দ কেটে  দু’ কোটি টাকার একটা ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স ফান্ডের প্রপোজাল করতে হচ্ছে। করে দিতে হবে মুফতে! এপলিক্যান্ট এনজিও তথ্যে কিছু গরমিল আর গোঁজামিল ঠিক করতে কাজ করছি প্রিন্ট কপির উপর। সারাদিন শেষে সন্ধ্যা আটটার পর একটু ল্যাপটপ খুলে বসেছি, বসার ঘরে। সামনে ছেলেটা দৌড়ে এল। অনেকগুলো পাজল হাতে, চোখের কোন দিয়ে দেখলাম অবাক হয়ে আমাকে দেখছে!  ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে দেখলাম খাবার টেবিলে থেকে গ্লাসে পানি এনে সে কার্পেটের একটা দিক ভিজিয়ে ফেলেছে। যেই আমি গ্লাসটা হাতে নিলাম সে লাফ দিয়ে সরে গিয়ে দৌড় দিল নানীর ঘরে। দরজা দিয়ে দিল যাতে আমি পিছু না নিতে পারি। কার্পেটটার ভিজে অংশ দেখে গ্লাসটা টেবিলে রাখতেই ভেতর থেকে দরজায় নব লকের খুট আওয়াজ কানে ভেসে এল। ভেতর থেকে বাবা দরজা লক করে দিয়েছে!

ভয়ে হৃদপিণ্ড বন্ধ হবার দশা। মৌকে ডাকছি কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না! ঘরে তিন জন নারী- তার দুজন সিনিয়র সিটিজেন। আমি একমাত্র অক্ষম পুরুষ! মৌ ডুপ্লিকেট চাবি আছে বলে ছেলেকে নব ঘুরিয়ে দরজা খুলতে উৎসাহ দিচ্ছে। জানামতে শিশুর হাতের কব্জি ও জোর কোনটাই সে কাজ করার কথা নয়। খালা শাশুড়ী করিতকর্মা ও বুদ্ধিমতী, তিনিই বোধহয় ডুপ্লিকেট চাবির গোছা নিয়ে এলেন। মৌ বলল আমাকে ঘরের পেছনের বারান্দা দিয়ে দরজা খোলার চেস্টা করতে। সাধারণত পেছনের বারান্দার দিকের দরোজাটা খোলাই থাকে। আজ সন্ধ্যায় দস্যি’টার নানু মশার ভয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন! আমার কাজ হল ছেলেকে কথা বলে ব্যস্ত রাখা। দু’ মিনিট পর মনে হল দুদিক থেকে আওয়াজ পেলে সে আরো বিভ্রান্ত হবে।

সামনের দরজায় মৌ তখন একটার পর একটা চাবি ঘুরিয়ে যাচ্ছে। চাইলাম একটু চেষ্টা করে দেখতে। পাত্তা পেলাম না ! এই লকডাউনের  কোন মিস্ত্রি পাওয়া যাবে না। দরজার গোল হ্যান্ডেল এর ভিতরের পিন খুলে নেওয়ার মত শক্তিশালী হাতুড়ি ও স্ক্রু ড্রাইভার বাসায় থাকার কথা নয়! বিশেষ করে এই গোল হাতল দরজার নব ও লক সম্পর্কে আমি জানি। গত দেড় যুগের বাউল জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি কম করে হলেও আধ ডজন দেশে গোটা দশেক এই রকম ডোর লক জরুরী ভিত্তিতে মিস্ত্রি দিয়ে খুলিয়েছি। প্রতি বারই হয় চাবি হারিয়ে নতুবা চাবি ঘরের ভেতর রেখে দরজা লাগিয়ে। এখন তো লকডাউন। কোন মিস্ত্রি পাওয়া অসম্ভব। মৌ দ্বিতীয় রাউন্ডে দ্রুত হাতে একটা একটা চাবি ঘুরিয়ে চেস্টা করছে। ওর হাত মনে হল কাঁপছে। আমি আবার চাইলাম। মাথা স্থির রেখে কাজ করতে হয় এইসব মুহূর্তে। ভয় দু’দিকে। শিশুটা আতঙ্কিত হলে বড় বিপদ ঘটতে পারে। একই সাথে তিন জন মহিলা না আতঙ্কিত হয়। মৌ এর মা বেশিক্ষণ চাপ নেবার কথা না। উনি অনেক কিছু বলছেন কিন্তু সেটা কারো মাথায় ঢুকছে বলে মনে হয় না।

খালা শাশুড়ি যখন বললেন দোতলায় বাড়িওয়ালার বাসা থেকে ডুপ্লিকেট চাবি আনতে তখন একটু দম পেলাম। দোতলা থেকে চাবি আনতে ২ কি ৩ মিনিট! এর মধ্যে পুতা নিয়ে শাশুড়ী মা নাতি উদ্ধারে দরজায় হাজির। ৭৫ বছরের জননী সাহসিকা! আরেকটু হলেই হাতলে তালায় ঘা পড়েছিল। গলার কাছে হৃদপিন্ড আবার গেল। একবার ও ঘা পড়লে আগামীকাল সকাল পর্যন্ত মিস্ত্রীর অপেক্ষায় আঙ্গুল চুষতে হত।

শুরু হল বাড়িওয়ালা’র চাবি দিয়ে চেষ্টা। মৌ কিছুতেই হাত স্থির রাখতে পারছে না। আবার আমাকেও চেষ্টা করতে দিচ্ছে না। আমি ভয়ে কিস্যু বলতে পারছি না। পাশের ফ্লাটের আরেক ভদ্রলোক এসেছেন সাহায্য করতে – সেও আমার মত বোকা বনে গেছে। এরই মধ্যে দেবদূতের মতো হাজির হল বাড়িওয়ালার ছেলে এবং দ্বিতীয় বার চাবি ঘোরাতেই দরজা খুলল ! সকল প্রশংসা সেই ত্রাণকর্তা তরুনের জন্য!  দরজা খুললেও বাপুজি ভেতর থেকে দরজার সামনে লাগেজ আর কাপড়ের স্তুপ ফেলে উঁচু করে তার উপরে বসে হাতল ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছিল ! কৌশলে দরজার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকে পুত্রকে উদ্ধার করে মায়ের ধন মা’কে ফেরত দিলুম। ঘড়ি দেখে বুঝলাম মাত্র ১৫ মিনিটের  ড্রামা! করোনা কালের বাস্তবতা। সামনে কি আছে কে জানে।

অলংকরণ: আসমা সুলতানা মিতা 

আহমেদ আবিদ
লেখক, সমালোচক, গবেষক-মানবাধিকার, সমাজ ও সমন্বিত শাসন, ওয়েস্টার্ন সিডনী বিশ্ববিদ্যালয় ও পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালি।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments