লকডাউন -শিমুল শিকদার

  
    

আজ ২৫শে মার্চ, ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশে COVID19, অর্থাৎ করোনা ভাইরাসে ৩৯ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর শোনা গিয়েছে। কিন্তু এই ৩৯জন তলে তলে কয়শ’ ঊনত্রিশকে যে বাঁশ দিয়ে জাতির ভাগ্য বাঁশময় করেছে, খুব শীঘ্রই তার ফলাফল প্রকাশ হবে। পরিসংখ্যান বলে প্রতিটি করোনা রোগী গড়ে ২.৬ জনকে আক্রান্ত করে। অর্থাৎ প্রতি একশজন আরো ২৬০ জনকে আক্রান্ত করে। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা তাই হঠাৎ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। এক সময় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। চীন, ইতালি, স্পেন, ইরান, জার্মানি, ফ্রান্স, আমেরিকা এর উদাহরণ। ভয়ানক এই সংক্রমণ থামানোর আপাতত একটাই উপায়। তা হলো সংক্রমণের চেইনটাকে ভেঙ্গে দেয়া। আর এই চেইন ভাঙ্গারও উপায় একটাই – লকডাউন।
অস্ট্রেলিয়াতে সরকার বিভিন্ন কারনে সরাসরি লকডাউনের ঘোষণা না দিলেও দেশ কার্যত লকডাউনই হয়ে আছে। এয়ারপোর্ট, ইউনিভার্সিটি, অফিস আদালত, বার ক্লাব, রেস্টুরেন্ট, সিনেমা প্রায় সবই বন্ধ। ব্যাংক, পোস্ট অফিস, মেডিকেল সেন্টার, মদের দোকানে, ফার্মেসী, পেট্রোল স্টেশন – এরকম জরুরী কিছু প্রতিষ্ঠান খোলা আছে। আমার এমন এক ব্যবসা, জরুরী সময়ে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। করোনার এই হুড়াহুড়ির মধ্যে সবাই যখন ব্যবসার শাটার বন্ধে ব্যস্ত, আমার তখন অফিসের সব শাটার খুলতে হয়। কাজেই বাধ্য হয়েই এই অকালে আমাকে মাঝে মাঝেই ঘরের বাইরে বের হতে হয়। আমার স্টাফদের মধ্যে পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু লোকজন আছে। আমাকে তারা যখনই দেখে ‘ব্রাদার ব্রাদার’ করে জড়িয়ে ধরে। কিছুদিন ধরে এদের বারবার বলছি, এখন সময় ভাল না। চারিদিকে ভাইরাস। কেউ কাউকে ধরিস না। কিন্তু এগুলার মাথায় সহজে কিছু ঢুকতে চায় না। উল্টো বলে,
– সাদারা পায়খানা করে পানি নেয় না। ওরা শুয়োর খায়। করোনা ভাইরাস ওদের রেখে আমাদের ধরবে কেন? ব্রাদার! আমরা মুসলমান। দিনে পাঁচবার ওজু করি। তুমি দেখো, আমাদের কিছু হবে না।
আমি বললাম,
– আমরা যে মুসলমান, পায়খানা করে পানি নিই, শুয়োর খাই না – এই খবরগুলো করোনা ভাইরাস এখনো জানে না। যতদিন না জানে ততদিন সাবধানে থাকতেই হবে।
আমি ওদের গ্লাভস, মাস্ক, হ্যান্ড সেনিটাইজার দিয়েছি। কিছুই ব্যবহার করে না। এমন মোটা মাথার জাত এরা, কোন কিছু কেয়ারও করে না। অসুস্থ হয়ে গেলে আমাকে ঝামেলায় পড়তে হবে। ভীষণ ভাবনায় পড়ে গেলাম।

এর মধ্যে এক মেইল পেলাম, অস্ট্রেলিয়ার সরকার জনগণকে সচেতন করতে করোনা ভাইরাসের কোর্স চালু করেছে। আমাদের সেই কোর্স করতে হবে। ভাবলাম, ভয় ধরানোর এই সুযোগ। মোটা মাথা স্টাফগুলোকে বললাম, তোমাদের জন্য করোনা ভাইরাস কোর্সের সার্টিফিকেট জমা দেয়া বাধ্যতামূলক। নাইলে চাকরি নট। এক রকম বাধ্য হয়েই ওরা কোর্সটা করলো। কোর্স করার পরে টের পেলাম, ছেলেপেলেগুলো একটু ভয় পেয়ে গিয়েছে। এখন তারা শুধু মাস্ক, গ্লাভসই পড়ে না, চোখে গগলস, গলায় এক ধরনের মাফলার আরো কি কি পড়ে চেহারার এমন দশা করেছে যে কোন স্টাফটা যে কে তা বুঝার আর উপায় রইলো না। সেদিন দেখলাম, পাকিস্তানী ছেলেটা কালো রঙের রেইন কোর্ট গায়ে দিয়ে, মুখে হেলমেট পড়ে ফোঁস ফোঁস করছে। হঠাৎ দেখে আমি চমকে উঠে বললাম, কি জ্বালা! ঘরের মধ্যে তুমি রেইন কোর্ট পড়ে বসে আছে কেন? তোমাদের সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।
ও উত্তর দিলো, ব্রাদার! শরীরে ভাইরাস ঢোকার সব রাস্তাই এখন বন্ধ। ঠিক আছে না?
আমি বললাম, তোমার নাক দিয়ে ভাইরাস কেন বাতাসও তো ঢুকবে না। তুমি তো দম আটকেই মারা পড়বে। আর তুমি ওই কোণায় বসে আছো কেন?
ও উত্তর দিলো, সোশ্যাল ডিস্টান্সিং।
বুঝলাম, কোর্সে ফল হয়েছে ভালো।
বাঙালি জাতির অবস্থা অনেকটা আমাদের অফিসের স্টাফদের মতো। এরা জীবনের ভরকেন্দ্রে থাকতে জানে না। হয় থাকবে এমাথায়, না হয় আরেক মাথায়। তাই নুতন কিছু এদের ধরানো বেশ কঠিন। কিন্তু একবার ধরিয়ে দিতে পারলে তা রক্ষার জন্য একেবারে জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিবে। প্রায় বিশ কোটি জনসংখ্যার বিশাল এক জাতিকে এতো অল্প সময়ের মধ্যে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করা সহজ কথা না মোটেও। আমাদের চোখের সামনে যখন চীন, ইতালি, ইরানে করোনা ভাইরাসের তাণ্ডব চলছিল সে সময়ে আমাদের সরকারও ছিল বেশ উদাস। অথচ প্রস্তুতি নেয়া উচিত ছিল তখনই। অন্তত করোনা জীবাণু সংক্রমণরোধে সচেতনতামুলক অনুষ্ঠান, অ্যাপ, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি তৈরি করে জনগণকে সতর্ক করতে পারতো, যা আজ পর্যন্ত দেখা যায় নি। সঠিক কোন তথ্য না পেয়ে মানুষ অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে। এ এটা বলছে ও বলছে। মানুষ বুঝতে পারছে না কোনটা সঠিক, কোনটা ভুল। এর সাথে ভর করেছে গুজব, ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কুসংস্কার। এই হৈচৈ এর ভিড়ে তলে তলে নীরব ঘাতক করোনা তার কাজ কতদুর কি করেছে কে জানে?

অস্ট্রেলিয়ান গভর্নমেন্টের করোনা ভাইরাসের কোর্সটা আমি নিজেও করেছিলাম। কাজেই একটু ধারনা আমার আছে, যদিও সেসব তথ্য এখন সবারই জানা। তবুও আরেকবার মনে করিয়ে দেয়া। আমি যেহেতু মেডিকেল সাইন্সের কোন এক্সপার্ট না, তাই কথাগুলো ভাসাভাসাই বলবো, কেউ যেন আবার মনে না করে, এহ! আইছে এক পন্ডিত! COVID19 মানুষের কাছে নুতন ভাইরাস। এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের রাত দিন গবেষণা চলছে। তাঁদের গবেষণায় আজ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমার এই লেখা।
করোনা ভাইরাসকে সংক্ষেপে COVID19 বলে। এর পুরো অর্থ CORONA VIRUS DECEMBER 2019। ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে প্রথম ধরা পড়েছে। COVID19 নোভেল করোনা ফ্যামিলির একটা ভাইরাস। কয়েকটি বাদে করোনা ফ্যামিলির কোন ভাইরাসই মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর না। COVID19 এর কোন ভ্যাকসিন অথবা মেডিকেশন বিজ্ঞানীরা এখনো কব্জা করতে পারে নাই। তাই আমরা এই মুহূর্তে এতিমের মতো খোলা ময়দানে বসে আছি। অর্থাৎ COVID19 থেকে মানবজাতি একেবারে আনপ্রটেক্টেড। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের রোগের চিকিৎসার আয়োজন করা হয়েছে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা হাসপাতালে। বাকি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগী ভর্তি হলে রোগ সারানোর ছেয়ে ছড়ানোর ও রোগী বাড়ানোর কাজই হবে বেশি। তাই এসব হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি হলে অনেক ডাক্তার নার্সরাই ভয়ে সরে যাচ্ছে। যাবেই বা না কেন? উন্নত দেশেগুলোতে সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও এই রোগে অনেক ডাক্তার নার্স, হাসপাতালের কর্মচারীরা প্রাণ হারিয়েছে। আর সেখানে আমাদের দেশে করোনা সাথে লড়াই করা হাসপাতালের এই যোদ্ধারা যেন – ঢাল নাই, তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দার হয়ে বসে আছে। এদের না আছে পার্সোনাল প্রোটেকশন, না আছে রোগীর প্রোটেকশন, না আছে করোনা ভাইরাস টেস্টের উপযুক্ত উপকরণ। আমাদের কর্তব্যপরায়ণ ডাক্তার, নার্সরা শুধু সাহসের উপর ভর করে নীল রঙের এক টুকরো ন্যাকড়া নাকে গুঁজে কঠিন এ যুদ্ধে নিজেদের কতক্ষণ রক্ষা করতে পারবে? প্রাণের ভয় প্রাণ রক্ষাকারী ডাক্তার, নার্সদেরও তো আছে। তাই প্রতিরোধই এখন একমাত্র রাস্তা। এবং করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের সহজ উপায় হলো- লকডাউন। লকডাউন মানে বেশি করে চাল, ডাল, তেল, নুন নিয়ে যে যে যার যার গুহায় ঢুকে পরা। একেবারে গৃহবন্দী। আপাতত আর কোন বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায় নাই। পেলে তখন তাই নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

করোনা ভাইরাস অন্যান্য ভাইরাস থেকে একটু ভারী। ইনফেক্টেড মানুষ হাঁচি, কাশি দিলে ভাইরাসটা ২/৩ ঘন্টার মতো বাতাসে ভাসতে থাকে। এরপর নীচে পড়ে যায়। এরা মাটি, কাঠ, মেটাল, প্লাস্টিকের উপর দুই তিন দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এদের বংশ বিস্তারের জন্য আপনার, আমার শরীরের প্রয়োজন। এই ভাইরাস কোন শরীরে ঢোকার পরে ভীষণ এক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। গোপনে গোপনে এদের সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা বাড়াতে থাকে। এরপর যুদ্ধক্ষেত্র সাজায়। এই প্রক্রিয়াতে তারা একটু সময় নেয়। এই সময়টায় রোগের কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। কাজেই ইনফেক্টেড মানুষটি টের পায় না যে, অজান্তে তার রাজ্য আক্রমনের কি সর্বনাশা ষড়যন্ত্র চলছে। ধীরে ধীরে ভাইরাসরা শরীরের উপর কন্ট্রোল পুরোপুরি নিয়ে নেয়। তখন আমাদের প্রিয় শরীর আর আমাদের কথা শুনে না। শরীর চলে করোনা ভাইরাসের ইচ্ছায়। সমস্ত ভাইরাসরা পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে গেলে হঠাৎ একদিন “আক্রমন” বলে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন এক ধাক্কাতেই রাজা কুপোকাত। রাজ্য হারিয়ে রাজা তখন সোজা কোয়ারেন্টাইনে।
ভাইরাসটা ছড়ায় কিভাবে? মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাসের ঢোকার প্রধান ও সহজ রাস্তা হলো নাক, মুখ ও চোখ। অর্থাৎ মানুষের শরীরে চোখ, নাক ও মুখ দিয়ে ঢুকে তাকে ইনফেক্টেড করে। আবার সেই চোখ, নাক ও মুখ দিয়ে বেরিয়ে আরেকজনকে ইনফেক্টেড করবে। ইনফেক্টেড মানুষের চোখ, মুখ ও আর নাকের চারিপাশে অসংখ্য ভাইরাস থাকে। আমরা কিছুক্ষণ পর পর নাকে, মুখে হাত দেই, চোখ মুছি। এটা আমাদের স্বভাব। ইনফেক্টেড মানুষ যখন নাক, মুখ, চোখ স্পর্শ করে, তখন ভাইরাস তার হাতে চলে আসে। এরপর সে যত মানুষের সাথে হ্যান্ডশেক করবে, যতো মানুষকে স্পর্শ করবে সবারই শরীরে ভাইরাস যাবে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে টেবিলে বসলে টেবিলের উপর ভাইরাস লেগে থাকবে। যত লোক ওই টেবিলের উপর হাত রাখবে সবাই ইনফেক্টেড হবে। লিফটের বাটন চাপ দিলে, পানির ট্যাপ খুলে হাত মুখ ধুইলে, লিফটের বাটনে, ট্যাপের সাথে ভাইরাস লেগে থাকবে। যত মানুষ লিফটের ওই বাটন, ওই ট্যাপ স্পর্শ করবে, সবাই ইনফেক্টেড হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি দরজা ধাক্কা দিয়ে খুললে দরজায় ভাইরাস লেগে থাকবে। যত মানুষ সে দরজায় হাত দিবে সবাই ইনফেক্টেড হবে। ইনফেক্টেড মানুষের হাত যেখানে যেখানে যাবে সেখানেই সে ভাইরাস রেখে আসবে। এজন্য বলা হয়, এই মুহূর্তে নিজের হাতকেও বিশ্বাস করো না। বিষয়টা ভয়াবহ মনে হচ্ছে। পরিস্থিতি কিন্তু আসলেই ভয়াবহ।
বাইরে গেলে মানুষে মানুষে ছোঁয়া তো লাগেই। সিঁড়ির রেলিং, দরজা, পানির ট্যাপ, দেয়াল, টেবিল, চেয়ারের হাতল, লিফটের বাটন, চায়ের কাপ, পানির গ্লাস, চামচ, থালা, বাসন সবকিছুতেই মানুষের হাতের স্পর্শ লাগে। এগুলোর কোথাও কোন ভাইরাস লেগে থাকলে সে স্পর্শকারীর হাতে চলে আসবে। কাজেই বাইরে গেলে ইনফেক্টেড হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। ইনফেক্টেড একজন হাঁচি দিলো। সম্ভাবনা আছে, সামনের যে কয়জন বসা থাকে সবাই ভাইরাসের ফাঁদে জড়িয়ে যাবে। এরা প্রত্যেকে যখন ঘরে ফিরবে, করোনা ভাইরাস গোপনে তাদের ঘরে ঢুকে পড়বে। আক্রান্ত করবে একে একে সবাইকে। এজন্য WHO বারবার বলছে, সবাইকে ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে। ঘরের দরজা বন্ধ করে পরিবারের সাথে সময় কাটাতে। নইলে এ ভাইরাসের গতি থামানো যাবে না। আপনি বলবেন, আমার অনেক ব্যস্থতা আছে। বাইরে না যেয়ে পারছি না। আমি বলি, সারা পৃথিবীর অনেক উজির নাজিররা এখন ঘরে বসে মাছি মারছে। আর আপনি কোন জমিদার? কয়েকদিন একটু স্থির হয়ে ঘরে থাকেন। ছেলেমেয়ের সাথে সময় কাটান। ভালই লাগবে।
জরুরি কাজে বাইরে যেতেই হলে হাতে গ্লাভস পড়ে নেয়া নিরাপদ। হাতের পরিবর্তে কনুই ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজা খোলা, কনুই দিয়ে লিফটের বাটন চাপ দেয়া। হাত যতটা পারা যায় কম ব্যবহার করতে হবে। কনুইর ব্যবহার একটা প্রাকটিসের বিষয়। দুই তিনদিন প্রাকটিস করলেই অভ্যাস হয়ে যাবে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির তিন ফুট দূরত্বের মধ্যেকার মানুষদের আক্রমন করার ক্ষমতা রাখে। কাজেই অন্য মানুষ থেকে চার ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে পারলে ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায়। একে বলে সোশ্যাল ডিস্টান্সিং। সোশ্যাল ডিস্টান্সিং এর বিষয়টা আপনি মানছেন। কিন্তু আরেকজন যে মানবে অথবা বুঝবে তা নাও হতে পারে। তবে একান্ত বেকায়দা পরিস্থিতিতে সোশ্যাল ডিস্টান্সিং এর একটা কৌশল আছে। সোশ্যাল ডিস্টান্সিং গ্রাহ্য করে না এমন মানুষের সামনে গিয়ে খুকখুক করে কেশে হালকা একটা আওয়াজে তাকে বলা- ভাই, আমাকে মনে হয় করোনা ভাইরাসে ধরেছে। শরীরটা ভালো ঠেকতেছে না। অগ্রাহ্য করা লোকটি গন্ডার না হয়ে মনুষ্য প্রজাতির হলে অবশ্যই ভয়ে দূরে সরে যাবে। মানে – এখন আপনি ঝুঁকিমুক্ত। হাঁচি, কাশির সাথে সাথে টিস্যু দিয়ে মুখ চেপে ধরতে হবে, যাতে নাক, মুখের জীবাণু এখানে সেখানে না পড়ে। টিস্যুটি সাথে সাথে নিজ হাতে ময়লার বাস্কেটে ফেলে দিবে। হাতের কাছে টিস্যু না থাকলে কনুই দিয়ে মুখ চেপে ধরা যেতে পারে। হাতে পড়া গ্লাভস ঘরে ফেরার আগে অবশ্যই নিজ হাতে বাস্কেটে ফেলতে হবে এবং হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।

শরীরের চামড়ায় কোন ক্ষত না থাকলে করোনা ভাইরাস চামড়ার ভিতর দিয়ে শরীরে ঢুকতে পারে না। কাজেই ভাইরাস হাতে লেগে থাকলে ঘনঘন সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ভাইরাসমুক্ত হওয়া সম্ভব। আপনার ঘরে করোনা ভাইরাস ঢুকলে হয়তো আপনার শরীরের সাথে আপনার গেস্ট হয়েই ঢুকবে। তাই ঘরে ঢুকে কাউকে স্পর্শ করার আগে সোজা বাথরুমে চলে যাবেন। ভালো করে হাত মুখ না ধুয়ে কাউকে স্পর্শ না করাই ভালো। কে জানে আপনার শরীরের কোথাও ভাইরাসের এক এক টুকরো লেগেও তো থাকতে পারে। পরনের জামা কাপড় বাথরুমে খুলে ফেলে রেখে ফ্রেস কাপড় পরতে পারলে ভাল হয়। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাড়িতে বয়স্ক মানুষ থাকলে নিরাপত্তার জন্য তাকে অবশ্যই আলাদা রুমে কোয়ারেন্টাইনে রাখুন। অন্তত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত। তার কাছে কাউকে ঘেঁষতে দিয়েন না। কারন, বয়স্ক মানুষেরা করোনা ভাইরাসের সহজ টার্গেট।
বাসায় পেপারওয়ালা, দুধওয়ালা, ডিমওয়ালা, ফেরিওয়ালা সব ওয়ালা বাদ। ছুটা কাজের লোক থাকলে বাদ, ড্রাইভার বাদ। সোজা কথা নিজের বাসাটা একটা জেলখানা বানিয়ে ফেলেন। এখানে দরজা দিয়ে কেউ ঢুকবে না। নিজেরাই কাজের বুয়া হয়ে যান। পরিবারের সদস্যরা কাজ ভাগ করে নেন, সময় কেটে যাবে। জরুরি কাজে বাইরে যেতে হলে পরিবারের সবচেয়ে করোনা সচেতন মানুষটাই যেন শুধু যায়। বাসার কাজের লোককে বাইরে পাঠানো বিপদজনক। কারণ, সে আপনার চেয়ে কম সচেতন। ঘরে ভাইরাস নিয়ে ফিরতে পারে। প্রতিদিন বাড়ির মেঝে, রান্নাঘর, টয়লেট বেসিন, দরজার হাতল, লাইট ফ্যানের সুইচ, সিঁড়ির রেলিং, লিফটের বাটন, টেবিলের উপরের ভাগ, গাড়ি, মোটরসাইকেল ইত্যাদি ব্লিচ অথবা অ্যালকোহল আছে এমন ক্যামিকেল দিয়ে পরিস্কার করা জরুরী। করোনা ভাইরাস বরফে যেমন এক্টিভ, ৪০/৫০ ডিগ্রী তাপমাত্রায়ও একইভাবে এক্টিভ। কাজেই শীতের দেশে ও গরমের দেশে তার সমান দাপট দেখা যায়। আর মশা দিয়ে এ ভাইরাস বাহিত হয় না।
ঘন ঘন পানি খাবেন। করোনা ভাইরাসের টার্গেট ফুসফুস। তারা মুখে ঢুকলে পানির সাথে পাকস্থলীতে নেমে যাবে। পাকস্থলীর এসিডে এরা মারা যায়। প্রচুর ভিটামিন সি খাবেন। আর মনে রাখবেন, নো হ্যান্ডশেক, নো কলাকুলি। বিশ্বের কোন রাষ্ট্রপ্রধানরা এখন আর হান্ডশেক করে না। একজন আরেকজনকে দেখলে জাপটেও ধরে না। ইদানিং তাদের দেখা যায় দূর থেকে ‘সালাম’ অথবা ‘নমস্তে’ বলে। গ্রামে, পাড়ায়, মহল্লায় বিদেশ ফেরত পাবলিকের খবর শুনে দেখার জন্য জন্য হুমড়ি খেয়ে পরবেন না। এরা বিদেশ থেকে ডলার, পাউন্ড, স্নো, পাউডার, সাবান, কম্বল, আয়না, চিরুনির সাথে প্রচুর পরিমানে ট্যাক্স ফ্রি ফ্রেশ করোনা ভাইরাসও আমদানি করছে। এই দেখলে তাই আপাতত এড়িয়ে চলুন। এখন ভীষন জরুরী অবস্থা চলছে। এই সময়টায় কোন মতে টিকে থাকাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আমি এখন দুইটা গল্প বলবো।

গল্প এক.
এই মার্চের ১৫ তারিখে জাপানফেরত এক লোক উঠেছে তার টাঙ্গাইলের ভাড়া বাসায়। বাংলাদেশের পাবলিক ইতিমধ্যে জেনে গেছে, বিদেশ ফেরত লোকেরা সাথে করে করোনা ভাইরাস নিয়ে আসে। তাই বাড়িওয়ালা তাকে সেই বাড়িতে জায়গা দিতে রাজি হলো না। তখন ভদ্রলোক তার স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে বাসাইল উপজেলায় তার নিজের গ্রামের বাড়ি চলে যায়। করোনার ভয়ে সেই গ্রামবাসী লোকটিকে জায়গা দিলো না। শেষে উপায় না দেখে লোকটি আশ্রয়ের জন্য শ্বশুরবাড়িতে গেলো। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে সোজা পুলিশে ধরিয়ে দিলো। পুলিশ এসে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে সেই টাঙ্গাইলের ভাড়া বাসাতেই হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ দিয়ে গেলো। পকেটে ডলার, পাউন্ড ভর্তি বিদেশ ফেরত মানুষদের এমন অমর্যাদা বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন কালে আর ঘটে নাই। পরিস্থিতি মানুষকে কতো দ্রুত বদলে দেয়।
(সুত্রঃ প্রথম আলো। ২৩ মার্চ, ২০২০)

গল্প দুই.
প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে কুষ্ঠ রোগের ভীষণ প্রাদুর্ভাব ছিল। রোগটা ছিল ভীষণ ছোঁয়াচে। এর কোন চিকিৎসাও ছিল না। এজন্য কারো এই রোগ দেখা দিলে পরিবারের লোকজন নিজেদের নিরাপত্তার জন্য রোগীকে টেনে শহরের বাইরে ফেলে রেখে আসতো। রোগী ধুঁকে ধুঁকে সেখানেই মরে পড়ে থাকতো। শিয়াল, কুকুরে সে লাশ ছিঁড়ে খেত। এই করোনা ভাইরাসের কারনে আজ ইতালিতে লাশ দাফনের জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। লাশ লাইন ধরে মাটি চাপা দিতে হচ্ছে। ইংল্যান্ডের হাসপাতালগুলোতে করোনা ভাইরাসের রোগীদের জায়গা দিতে পারছে না। তাই হার্ট, ডায়াবেটিকস, ক্যান্সারের যে রোগীগুলোর বাঁচার সম্ভাবনা কম তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে। হাসপাতালের বক্তব্য, জায়গা খালি করো, বাড়িতে গিয়ে মরো। বাস্তবতা মানুষকে যে কি পরিমান নির্দয় করে ফেলে গল্প দুটি পড়লে বোঝা যায়। বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছেন, আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি।

এতো সব কাহিনী শুনে আপনি হয়তো আমাকে দুইটা গালি দিয়ে বলবেন, এ ভয় ছড়ানোর মতলব। আমি বলবো, অবশ্যই ভয় ছড়ানোর মতলব। কারণ, ভয়ের সাথে সতর্কতার আনুপাতিক একটা সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ যতো ভয় ততো সতর্কতা। ভয় ধরানো ছাড়া বীর বাঙ্গালিকে থামানোর আর কোন উপায় নাই। তাই এই সময়ে এদের এই ভয়ের ভীষণ দরকার। নইলে মানুষদের ঘরে উঠাতে পুলিশের কেন লাঠিচার্জ করতে হবে? মানুষ যে একটু নিরিবিলি কোয়ারেন্টাইনে থাকবে তারও উপায় নাই। দলবেঁধে গ্রামবাসী তার বাড়িতে গিয়ে উপচে পড়ে। লকডাউনকে বাঙালী ঈদের ছুটি মনে করে দলে দলে সমুদ্র দেখতে যায়। মিরপুরে এক লকডাউন বাড়িটি দেখতে শতশত মানুষের ভিড় করে। কি সব ভয়াবহ কান্ডকারখানা! এ বেপরোয়া জাতিকে কে, কোন প্রকারে থামাইতে পারিবে?
বিজ্ঞের মতো অনেক লম্বা লেকচার দিলাম। এখন হাঁফাইতেছি। আর টাইপ করতে ইচ্ছা করতেছে না। অনেক দুঃসংবাদের মধ্যে একটা সুসংবাদ দিয়ে শেষ করি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এক এক মানুষের এক এক রকম। কোন কোন মানুষের শরীরের ইমিউন সিস্টেম খুব শক্তিশালী। ছোট খাট ভাইরাস এদের কাবু করতে পারে না। এরকম ভাগ্যবানদের শরীরে করোনা ভাইরাস কখন ঢুকে কোন সুবিধা করতে না পেরে আবার শরীর ছেড়ে কখন যে চলে যাবে তা তারা টেরও পাবে না। একইভাবে যাদের বয়স ত্রিশের নিচে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে করোনা তাদের তেমন ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু তারা ভাইরাস ছড়াতে ভুমিকা রাখবে ঠিকই। কাজেই ছোট ছেলেমেয়ে ও যুবক যুবতীরা অনেকটা নিরাপদ। তারপরও তাদের নিয়ম মেনে চলতে হবে তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কথা ভেবে।
আমার লেকচার এখানেই শেষ। বুঝলে বুঝপাতা না বুঝলে তেজপাতা।

২৫শে মার্চ, ২০২০, র‍্যাবি, সিডনি।

শিমুল শিকদার
: গল্পকার, নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments