তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আমরা একটা কঠিন মানসিক সমস্যায় ভুগছি।সেটি হলো সস্তা লাইক-কমেন্টের আশা। যা আমাদের অজান্তেই আমাদের প্রতিভাকে ধ্বংস করছে তীলে তীলে।
বর্তমান সময়ে প্রায় দেখা যাচ্ছে, একজন লেখক-ডিজাইনার কিংবা শিল্পী ফেসবুকে তার প্রতিভা প্রর্দশন করে, বার বার সামাজিক মাধ্যমে খোঁজ নিচ্ছে তার কাজে কতগুলো লাইক-কমেন্ট আসলো। প্রচুর পরিমানে লাইক-কমেন্ট পেয়ে দ্বিতীয়বার সেই লাইক কমেন্টের সংখ্যা নিয়েও পোস্ট দিচ্ছে। আবার অন্যদিকে আশানুরূপ লাইক কমেন্টের অভাবে কেউ কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে, নিজের প্রতিভা বেড়ে উঠার রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে। সেটা কিভাবে আসুন বিস্তারিত জেনে নেই।
ধরুন আপনি একজন লেখক কিংবা চিত্রশিল্পী। কয়েক মাস আগে, আপনার আঁকা একটি ছবি কিংবা লেখা যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছেন, তখন প্রায় এক হাজার মানুষ আপনার পোস্টে লাইক দিয়েছেন কিংবা প্রশংসা করে অনেকে কমেন্ট করেছেন। আমাদের মস্তিষ্ক প্রশংসা কিংবা অনুপ্রেরণা পেতে পছন্দ করে। এবং আপনাকে আরো প্রশংসা পাওয়ার জন্য উৎসাহী করে তুলে, নতুন কাজ করবার জন্য। সেই ধারাবাহিকতায় আপনি কদিনপর আরো একটি লেখা কিংবা ছবি পোস্ট করলেন এবং দিনশেষে দেখলেন, প্রথমবারের মতো সেই লাইক আর কমেন্ট আসছে না। অল্প কয়েকজন মানুষই লাইক দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে আপনি মনে মনে ভাবতে থাকবেন, আপনার করা কাজটি কিংবা লেখাটি হয়তো ভালো হয়নি। অতপঃর মস্তিষ্কে সেটা অটোসাজেশন রূপে স্থান করে নিবে। এরপর আপনি যে লেখাই লিখতে যাবেন, কিংবা সে ছবিই আঁকতে যাবেন, বার বার আপনার মনে হতে থাকবে হয়তো আপনি পারছেন না। এভাবে নিজের অজান্তেই আপনার প্রতিভাকে আপনি ধ্বংস করছেন। আপনার মস্তিষ্কে ক্রিয়েটিভ চিন্তার পাশাপাশি লাইক পাওয়ার বিষয়টিও ঘুরপাক খেতে থাকবে। মস্তিষ্ক একসাথে দুটো কাজ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে আপনার ক্রিয়েটিভিটি সুস্পষ্টভাবে কাজ করবে না।
এবার আসুন জেনে নেই, কেন প্রথম পোস্টে এতগুলো লাইক পড়লো, কিন্তু দ্বিতীয়পোস্টে আশানুরূপ লাইক আসলো না। ইন্টারনেটের জগৎটা কিন্তু আপনার হাতের মুঠোয় না। এটা পৃথিবী বিস্তৃত সুবিশাল এক পরিসরে সাজানো। এখানে স্থান, কাল, পাত্র সবই কাজ করে।
সর্বপ্রথম যেটা আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে, তা হলো, গণহারে সস্তা লাইক আর কমেন্টের জোয়ারে নিজেকে ভাসানো যাবে না। সমীক্ষায় দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের বেশিরভাগই তরুণ যুব সমাজ। সেই ক্ষেত্রে আপনি প্রেম ভালোবাসা কিংবা রোমান্টিক কিছু লিখলে, গাইলে কিংবা আঁকলে, সেক্ষেত্রে লাইক বেশিই পড়বে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন, কারা আপনার পোস্টে লাইক দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে আপনি যদি একজন লেখক হয়ে থাকেন এবং আপনার কোন লেখায় আপনার সিনিয়র একজন লেখক-লেখিকা যখন কমেন্ট কিংবা লাইক করবে, সেটাই হবে আপনার প্রকৃত পাওয়া। আপনার কাজের প্রকৃত প্রশংসা। তাই বলে, আমি তরুণ যুব সমাজকে না বুঝে লাইক দেয়ার তালিকায় রাখছি না।
অতঃপর যে বিষয়টা আপনার মাথায় রাখতে হবে। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির আাঁকা মোনালিসা যে পরিমান সমাদৃত হয়েছে, তার সকল চিত্রকর্মই কিন্তু সে পরিমান সমাদৃত হয়নি। ঠিক একইভাবে ভিনসেট ভ্যান গগ, সালভাদর দালিসহ অন্যান্যদের সব চিত্রকর্মই কিন্তু একই পরিমান প্রশংসিত হয়নি। তাই আপনার সব কাজই যে সবার পছন্দ হবে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। অন্যভাবে বলতে গেলে, ধরুন আপনি দেশের প্রখ্যাত লেখক হুমায়ুন আহমেদের একজন নিয়মিত পাঠক। আপনি কি হরফ করে বলতে পারবেন, তার রচিত সব গ্রন্থই আপনার ভালো লেগেছে? না লাগেনি।
আপনার কাজে লাইক কিংবা কমেন্ট আসাটাও কিন্তু সময় এবং কালের উপর নির্ভর করে। ধরুন আপনি দারুন একটি চিত্রকর্ম কিংবা লেখা বাংলাদেশ সময় বিকেল পাঁচটায় পোস্ট দিলেন। সেক্ষেত্রে আপনি আপনার কাজের যথাযথ মর্যদা পাবেন না। সেটা কিভাবে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিকাল পাঁচটায় চাকুরীজীবীদের অফিস শেষ করে বাসায় ফেরার একটা প্রস্তুতি মুহুর্ত। যে মুহুর্তে চাকুরীজীবীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়, রাস্তায় কেমন ট্রাফিক জ্যাম থাকবে, কি কি বাজার করতে হবে, সন্তানদের জন্য কি নিতে হবে ইত্যাদি। সে সময়টিতে একটা ভালো গানও তাদের কাছে বিরক্তির কারণ হবে।
আপনারা যারা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করছেন, তারা হয়তো লক্ষ্য করছেন মাঝে মাঝে কোন নির্দিষ্ট বিষয়নিয়ে ফেসবুকে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠে। ধরুন আজ দেশ কিংবা দেশের বাহিরের কোন শিল্পী কিংবা গুণীজন মারা গেছেন। ফেসবুকের নিউজফিডে সেই শিল্পী কিংবা গুণীজনকে নিয়ে সবাই শোকবার্তা, স্মৃতিচারণ করছে। সে দিনটিতে যদি আপনি কোন রোমান্টিক লেখা-চিত্রকর্ম পোস্ট করেন, সেক্ষেত্রে স্বভাবতই আপনি আশানুরূপ লাইক কিংবা কমেন্ট পাবেন না।
অন্যভাবে চিন্তা করলে, আরো একটি বিষয় চলে আসে। আজ সকাল থেকে আকাশ প্রচন্ড মেঘাচ্ছন্ন, বর্ষায় পানি জমেছে, সারা শহরে-গ্রামে। আকাশে উড়ে যাচ্ছে সাদা গাঙচিলের দল। বৃষ্টিময় সারাটিদিন। এমন একটি ঋতুতে আপনি যদি, কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া কোন গায়ের ছবি কিংবা কুয়াশা নিয়ে কোন লেখা পোস্ট করেন, স্বভাবতই তা অনেকের ভালো লাগবে না। সেক্ষেত্রে আপনি অবশ্যই আশানুরূপ লাইক কিংবা কমেন্ট পাবেন না।
এবার এমন একটি বিষয় নিয়ে বলবো যা শুনতে অনেকেরই হয়তো খারাপ লাগবে। দেশ কিংবা দেশের বাহিরে অনেক শিল্পী-লেখক-লেখিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি লাইক পাবার আশায় তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে টাকার বিনিময়ে লাইক কিনছেন। যেটা অনেকেই জানেন না। তাই হঠাৎ দেখলেন, আপনার জুনিয়র একজন তার পোস্টে ৭ হাজার লাইক পেয়েছে। সেক্ষেত্রে আপনি অনেক ভালো কাজ করা স্বত্তেও মাত্র ১০০টি লাইক পেলেন। সেসময়ে আপনি কি ভাববেন? আপনার কাজ ভালো হচ্ছে না?
এমনও দেখা যাচ্ছে, ইদানিং আপনার অনেক বন্ধুবান্ধব কাজ পোস্ট করে, আপনাকে লাইক দেয়ার জন্য অনুরোধ করছে। আপনি তার অনুরোধ রাখতে, আপনার অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও তার কাজে লাইক দিচ্ছেন। সেক্ষেত্রে ভালো-মন্দ বিচার করার কোন সুযোগই আপনি পেলেন না।
পরিশেষে বলতে চাই, সস্তা লাইক কিংবা কমেন্টের আশায় নিজের প্রতিভাকে ধ্বংস না করে, কাজ করে যান। অবশ্যই আপনি আপনার কাজে ভালো করবেন। প্রয়োজনবোধে নিজের কাজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন। মনে রাখবেন, শিল্পী জয়নুল আবেদিন, কাইয়ুম চৌধুরী, কামরুল হাসান, হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ ওপার বাংলার কিশোরকুমার, মান্না দে, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গাঙ্গোপাধ্যায়সহ আরো অনেকে আছেন, যাদের সেময়ে ফেসবুক ইউটিউব, ইন্সট্রগাম কিছুই ছিলো না। কিন্তু তাঁদেরকে আমরা চিনি, জানি, এখনও স্মরণ করি। তারা তাদের কাজে বেঁচে আছেন থাকবেন আমাদের মাঝে।
খন্দকার এনামুল হক
ভিজুয়্যাল গ্রাফিক্স ডিজাইনার ও লেখক
ঢাকা, বাংলাদেশ।