২০১৯ সালও উড়ে চলে যাচ্ছে । ফেলে যাচ্ছে তার ছায়া। আমার ব্যক্তি জীবনে দেশে বিদেশে কত সুখ, কত বিষাদ, কত আকাঙ্খা ছিল এই বছরটি ঘিরে। ভুল ভ্রান্তি, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, ন্যায় অন্যায়, ভালোলাগা ভালোবাসা, সুখ দুঃখ, আর কান্না হাসির দোল দোলানো অন্তরালে গেঁথে ছিল বছরটি।
কোন কোন সময় দুঃখ এসে পায়ের কাছে নতজানু হয়ে তার আকাঙ্খা বা বেদনার কথা জানিয়ে দেয়। আমি সেটি দেখা না দেখার ভান করে সাজিয়েছি আবার নতুন করে।বেশির ভাগ সময় আমাদের চারিপাশ জুড়ে হাজারও মানুষের বেড়ে উঠা মানুষের স্পর্শে বা সন্নিবেশে কাটিয়েছি। বিদেশ জীবনে খুব কম সংখ্যক মানুষের কপালে জোটে এমন স্পর্শ, এমন দেশি মানুষের ভীড়, সমাগাম অথবা এমন শত মানুষের ভালোবাসা। আমি চিরকালই বাইরের মানুষ। বাজারের মানুষ বললেও ভুল বলা হবেনা।ঘরের মধ্যে জুবুথুবু হয়ে বা আনমনা বসে থাকার মানুষ নই আমি ।অনেক বছর আগে আমার এক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিলো, তোমাকে যদি খুব নিরিবিলি, জন মানব শুণ্য এলাকা ,আছে শুধু প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যের স্পর্শ, তার মধ্যে সুন্দর একটা মনোরম বাড়ি, সেই বাড়ি থেকে বের হলেই নিরব নিস্তব্ধ রাস্তা, সন্ধ্যার পর নিভু নিভু বাতির আলো, যে আলোতে তোমার ছায়া ছাড়া অন্যকারো ছায়া পড়বে না, পারবে থাকতে?
অন্যদিকের শত শত মানুষের আনাগোনা, ঘর থেকে বের হলেই দোকানপাট, দোকানের সামনে পেঁছনে আড্ডা আর আড্ডা, ঝকঝকে আলো, আলোর মাঝে শত শত মানুষের ছায়া, মুড়ি চানাচুর কিংবা চা কফির টুংটাং আমার প্রিয় খুব প্রিয়।
আমি আমার বন্ধুকে নির্দিধায় বলেছিলাম আমি দ্বিতীয় পরিবেশটাই নেব। দ্বিতীয় বাড়িতে থাকবো। সে অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছিলো, কেনো? কারণ মানুষের মধ্যেই আমার আনন্দ। মানুষের মধ্যেই আমি খুঁজে পাই আমার ভালোলাগা ভালোবাসা। আড্ডার মধ্যেই আমি দেখতে পাই আমার শৈশব কৈশর, আমার বেড়ে ওঠা।

আমি এমন প্রকৃতির মানুষ। যা অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে মেলা ভার।আমি যেদিন সিডনি এসেছিলাম। উঠেছিলাম আমার বড় ভাইয়ের বাসায়। বড় ভাইয়ের বাসাতেই পার্মানেন্টলি থাকার কথা ছিলো। বড় ভাইয়ের বাড়ি নিরব নিস্তব্ধ ঘেরা। চারিপাশ জুড়ে শুধু প্রকৃতির স্পন্দন। নেই কোন হৈ হুল্লোর, নেই মানুষের আনাগোনা। বিকেল হলে অসহায় নিস্তব্ধ রোদ এসে পড়ে বাড়ির উঠোনে। এমন নৈসর্গ ঘেরা বাড়িতে আমার ক্রমশই হাহুতাশ লাগতে থাকে । আমার বুকের মাঝে অসহায় লাগে। নিজেকে দরিদ্র শ্রেণীর রাজার মতো লাগতে থাকে। মনে হতে থাকে রাজ্য সিংহাসণ হারিয়ে নিস্ব এক রাজা। আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে সুনসান এমন নীরবতা। আমার বুকে আঁকড়ে ধরে বিষন্নতা। আমি বের হয়ে আসি সেখান থেকে। খুঁজে ফিরি লোকারণ্য।
তারপরের ইতিহাস লাকেম্বা, সিডনিতে এক টুকরো বাংলাদেশ। নিবাস স্থাপন করি লাকেম্বাতে। মনে হচ্ছিল আমার বাংলাদেশ ফিরে পেয়েছি। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকি। অপরিচিত লোকজন গুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তাদের কে আমার নিজের মানুষ ভাবতে থাকি। আমি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকি। শ্বাসের সঙ্গে আমি দেশের সুবাস পেতে থাকি । পুরো লাকেম্বা একা একা হাঁটতে থাকি। ধীরে ধীরে কয়েকজনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠতে থাকে। আরও বেশি মিশতে থাকি। আরও বেশি মানুষ চেনা জানা হতে থাকে। ধীরে ধীরে আড্ডা জমতে থাকে। বড় ভাইরা ছাড়াও বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। লাকেম্বাও দিন দিন লোকজনের ভাঁড়ে বড় হতে থাকে।সকল দোকানপাটে ভীড় হতে থাকে। দোকান, হোটেল একাধারে বাড়তে থাকে। কোন কোন রেস্তোরাতে দেখি আমাদের যাদুকরী কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বা বিস্ময় ক্রিকেটার সাকিবের প্রতিকৃতি। বাঙ্গালীরা দূর দুরান্ত থেকে ছুটে আসে এই লাকেম্বায়। এই তারকাদের পাশে বসে চা সিঙ্গারা খায়। বাংলাদেশ থেকে কেউ ঘুরতে আসলে অপেরা হাউজ, হার্বার ব্রিজ কিংবা ব্লু মাউন্টেন ঘুরে এসে একবার লাকেম্বায় ঢু মারবেই। এই লাকেম্বায় এসেছেন ড. জাফর ইকবাল, ড. ইয়াসমিন হক, মৌসুমী ভৌমিক, সাদাত হোসাইন, অর্ণব, পার্থ, শাকুর মজিদ আরও কত কীর্তিবান সব মানুষ। এখানে আয়োজিত হয় পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ভ্যালেন্টাইন্স ডে আরও কত কি!

এই লাকেম্বায় আমরা নানা সুবিধা পেতে থাকি। যখন তখন নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতের কাছে পেতে থাকি। দেশি খাবার থেকে শুরু করে এমনকি দেশের মতো পান বিড়ির টঙ দোকানও এখানে গড়ে ওঠে। আমরাও দেশের সেই স্বাদ, সেই অনুভূতি উপলদ্ধি করি। সেদিন আমার বন্ধু ফয়সাল বলল, লাকেম্বার কারণে তার দেশে আর তেমন যাওয়া পড়েনা। আমি তাকে বলি কারণ কি? লাকেম্বা কি করে তোমার দেশে যাওয়া কমে দিল? সে বলল, দেশে যাই তো বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা মারতে ,ফুটপাতে চায়ের দোকানে বসে গল্প করার আগ্রহে। সেটাতো এখানেই পাওয়া যায়। সেই স্বাদ তো এখানেই নিতে পারি। সে আরও বলে, তোমরা আমার বন্ধু, দোকানপাট গুলো আমার দেশের আড্ডাস্থল। সবকিছুই তো আমরা পাচ্ছি। তাই দেশের জন্য মনটা আগের মতো ওরকম ছটফট করেনা।

বৈশাখ মাস হলে এখানেই আমরা ঢাকঢোল পিটিয়ে, গায়ে রঙবেরঙের পাঞ্জাবি পড়ে, পুরো রাস্তা জুড়ে আল্পনা সাজিয়ে আনন্দ করি।
লাকেম্বা বাজারটা আমার বাসার পাশে হওয়ায় প্রায়ই গভীর রাতে বের হই। বের হয়ে দেখা যায় আমাদের দেশি পরিচিত ভাই বন্ধুরা জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এসব দেখলে অন্তত কিছু সময়ের জন্য বাংলাদেশ ভুলে থাকা যায়।সত্যি একটা ছোট বাংলাদেশ । যদিও কিছু কিছু মানুষের নাক সিটকানি দেখা যায় । অনেককেই বিভিন্ন সময় দেখি নাকটা কপালের উপরে আকাশের দিকে নিয়ে বলতে, ‘ লাকেম্বা শিট লাকেম্বা। এখানে কি ভদ্র মানুষ আসে!’ অথচ এরাই লাকেম্বা আসে। বসে বসে চা সিগারেট খেয়ে চলে যায়। যাবার সময় হয়তো আরেকবার শিট লাকেম্বা বলে গালি দিয়ে যায়। এই শ্রেণীর মানুষরা চির জীবনই এমন । তারা কোন কিছুতেই ভালো কিছু দেখতে পায়না। তাদের কাজই হলো ভুল ধরা, তার আশেপাশে নোংরামি খুঁজে বেড়ানো। যদিও তাদের কথার গোণায় ধরার মনমানসিকতা নেই । তাই এমন একটা দিনে তাদের কে নিয়ে বলে দিনটাকে নস্ট করা ছাড়া আর কিছু হবে না।
কিন্তু একটা জিনিস লাকেম্বাকেও নষ্ট করে ফেলছে। এখানেও একে অপরের কুৎসা রটনায় ব্যস্ত। একে অপরের অমঙ্গল কামনা । অপসংস্কৃতি।অপরাজনীতি।তবুও এসব কিছু ছেয়ে এখানে দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে বাংলাদেশের গন্ধ বুকের ভেতরে নিতে পারি। বাংলাদেশকে ভাবতে পারি।
রাত পোহালেই সূর্য উঠবে ঝলমলিয়ে ! সোনার অলংকারের মতো চমকাবে সেই আলো সব খানে। চমকাবারই কথা। দিনটাইতো অন্যরকম, সব দিনের চেয়ে আলাদা। কারণ গোটা একটি দিনের ব্যবধানে আমরা পাচ্ছি নতুন একটি বছর।
‘শুভ নববর্ষ’ হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০২০।
২০১৯ চলে যাচ্ছে দুনিয়াজোড়া নানান ঘটনার ঘনঘটায়। দাবানলের আগুনে পুড়ছে পুরো অস্ট্রেলিয়া। তারমধ্যেও আজ রাতে সিডনি হার্বারে বসবে নতুন বছরকে বরণ করে নেবার আতশবাজি উৎসব। কেটে যাচ্ছে হাসি কান্না, আনন্দ আর বেদনায়।রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’
আমাদের মাঝে অনন্তের সন্ধান নিয়েই দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে আরও একটি বছর । এই বছরটা আমাদের পরবাস জীবনের জন্য হয়ে উঠুক অনন্তেরই সন্ধান। আরও সমৃদ্ধ হোক আমাদের এই ছোট্ট বাংলাদেশ লাকেম্বা অথবা আপনার শহর, মহল্লাটি।
আরিফুর রহমান
ঔপন্যাসিক, আবৃত্তিকার
বার্তা সম্পাদক, প্রশান্তিকা।
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।