ক্যারিয়ারে আমার বিচরণ মূলত প্রিন্ট মিডিয়ায়। এটাতেই বরাবর সাবলীল। কাজ করেছি আজকের কাগজ, দৈনিক ভোর, আমার দেশ, যায় যায় দিন, ডেসটিনি, সমকাল, কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশের খবরে। আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মধ্যে বিডিনিউজ২৪ডটকম আর রেডিও টুডেতে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। আমার কাজের ক্ষেত্র মূলত অফিস কেন্দ্রিক। হররোজ বিভিন্ন বিভাগীয় সম্পাদকদের সঙ্গে মিটিং, রিপোর্টারদের সঙ্গে বসে তাদের পরিকল্পনা জানা, বিশেষ রিপোর্টের পরিকল্পনা দেওয়া, নিউজ এডিট, বিভিন্ন পাতায় নিউজ ডিস্ট্রিবিউশন, পত্রিকার ডামি করা এবং মেকআপ দেওয়া। আবার প্রেসে দৌড়ানো, ছাপা তদারকি, মেইল ধরানোর দায়িত্বও পালন করতে হতো সময় সময়। পাশাপাশি অবশ্যই লেখালেখি। এটাই আসলে আমার নেশা- প্যাশন বলতে পারেন।
আগ্রহের কারণে অনেক সময় নিজেই অ্যাসাইনমেন্টে চলে যেতাম। আমার প্রিয় একটা শখ হলো ইন্টারভিউ করা। আর পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার জন্য বৈঠকি ঢংয়ের অনেক গোলটেবিলের সঞ্চালনাও করেছি। এসব কাজে জড়িত হতে পেরে অনেক কিছু শিখেছি, জেনেছি। অনেক প্রখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে এসেছি। প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছি। যাঁদের কথা কখোনই ভোলার নয়, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, প্রখ্যাত সেতার বাদক পণ্ডিত রবি শংকর, বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়া, হূমায়ূন আহমেদ, আনুস্কা শংকর, কবি শামসুর রাহমান, লেখক হুমায়ুন আজাদ, আহমেদ ছফা, কিংবদন্তিতুল্য সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কবির সুমন (সুমন চট্টপাধ্যায়), বাচিক শিল্পী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্চ অভিনেত্রী শোভা সেন (উৎপল দত্তের স্ত্রী), অভিনেতা সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়, নায়করাজ রাজ্জাক, সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আবুল বাশার, সমরেশ মজুমদার, জাফর ইকবাল, বোমা হামলায় নিহত সাবেক অর্থমন্ত্রী গোলাম কিবরিয়া, প্রয়াত রক শিল্পী আইযুব বাচ্চু, লাকি আখন্দ, অভিনয় শিল্পী শাবানা আজমী, উইনি ম্যান্ডেলা, শমি কায়সার, চলচ্চিত্র নির্মাতা গৌতম ঘোষ, আমজাদ হোসেন, কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বারসহ আরো কতজন। আর বন্ধুর মতো দিনের পর দিন আড্ডায় বসেছি প্রয়াত অভিনেতা যুবরাজ খালেদ খান, হ্যাপি আখন্দ, ভাস্কর রাশা, বুলবুল চৌধুরী, তসলিমা নাসরিন, অভিনেতা শাকিব খান, ফেরদৌস, শিমুল, কলকাতার চলচ্চিত্র নির্মাতা রিঙ্গো, নুপুরের সঙ্গে। এরমধ্যে রিঙ্গো তো আমাকে মডেল বানিয়ে একটা বিজ্ঞাপন চিত্রও তৈরি করেছিল। আর বাংলাদেশের মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে কি আর বলবো। তাদের সঙ্গেই তো আমার এতদিনের দ্বিতীয় সংসার। এই ধারাবাহিক লেখার বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁদের অনেকের কথাই চলে আসবে।

একদিন রাতে যথারীতি কাজে ব্যস্ত। সময়টা ’৯৫/’৯৬ সাল হবে। খবর পেলাম ভারতীয় অভিনেত্রী শাবানা আজমি রাতে ঢাকা আসছেন একটি সম্মেলনে অংশ নিতে। পরের রাতেই ফিরে যাবেন। আমাদের চিফ রিপোর্টার তখন মাহবুব (মাহবুবুল আলম) ভাই। তাঁকে খবরটা দিতেই তিনি ভীষণ উত্তেজিত। বললেন, যে করেই হোক শাবানার ইন্টারভিউ করতেই হবে। জানালাম, সম্মেলন হবে গাজীপুরের ব্র্যাক কমপ্লেক্সে। মাহবুব ভাই বললেন, চিন্তা কোরো না। গাড়ির ব্যবস্থা করছি। আর ইন্টারভিউ তুমিই করবে। ডেস্কের তৌফিক আজীজ, আতিক, মনতোষ, ফুয়াদসহ আর যারা যারা ছিল, সবাই বললো আফতাব ভাই আপনিই যান। রাত তিনটায় বাসায় ফিরে আবার ভোরে রওনা হলাম। সঙ্গে একজন ফটো সাংবাদিক (নামটা মনে করতে পারছিনা) আর সহকর্মী টুনটুন। সকাল নয়টার দিকে ব্র্যাক মিলনায়তনে পৌঁছেই দেখলাম সম্মেলন শুরু হয়ে গেছে। প্রায় ২৫/৩০ জন আলোচক। আমার চোখ তখন খুঁজছে একজনকেই। শাবানা আজমী। তিনি সত্যিই এসেছেন তো? হ্যাঁ খুঁজে পেলাম তাঁকে। সাড়ে দশটার দিকে চা-বিরতি দেওয়া হলো। আমি তখন প্রবল চেষ্টায় অভিনেত্রীর কাছাকাছি হওয়ার। কিন্তু আলোচকরাই এমনভাবে তাঁকে ঘিরে থাকলেন যে, সুযোগ মিললো কই। আলোচনা আবার শুরু হয়ে যেতেই আমি গিয়ে ধরলাম নাট্যজন মামুনুর রশীদকে। তিনিও তেমন ভরসা দিতে পারলেন না। জানালেন, তিনিও এসেছেন শাবানার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু তাঁর যে সংক্ষিপ্ত সফরসূচি তাতে সে সুযোগ মিলবে কিনা বুঝতে পারছেন না। বললেন, শুনছি এখান থেকেই তিনি সরাসরি এয়ারপোর্টে চলে যাবেন। এ তথ্য জানার পর একেবারে দমে গেলাম। তবে হাল ছাড়তে রাজী নই। লাঞ্চ ব্রেকে আমি মরিয়া। তাঁকে ঘিরে থাকা লোকজনকে টপকে একেবারে পৌঁছে গেলাম শাবানার সামনে। কাছে গিয়ে কালবিলম্ব না করে নিজের পরিচয় দিয়ে জানালাম মনের কথা। বললাম কথা বলতে চাই। ক্যান্টিনের পথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি জানতে চাইলেন কোন পত্রিকা, কোন ঘরানার, সার্কুলেশন কত?
আজকের কাগজ তখন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ প্রচারিত পত্রিকা। সেটা জানাতেই পাশে থাকা তাঁর এক প্রটোকল অফিসার এ তথ্য সত্য বলে জানালেন। এ কথা শুনে খুশি হলেন শাবানা আজমি। বললেন, হাতে সময় একদম কম। লাঞ্চের পর ফের শুরু হবে কনফারেন্স। শেষ হওয়ার আগে আমাকে ছুটতে হবে এয়ারপোর্ট। লাঞ্চ খেতে খেতে আমরা কথা বলি? ওটুকুই কিন্তু সময়। আমিতো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেলাম। আঠার মত সেঁটে গেলাম তাঁর সঙ্গে। দেখলাম খুবই মৃতভোজী তিনি। সামান্য কিছু খাবার নিলেন, আমিও তাই। আমার লক্ষ্য তখন লাঞ্চ নয়, ইন্টারভিউ। প্লেট হাতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে তিনি বললেন, চলো আমরা ওই কর্নার টেবিলে গিয়ে বসি- কথা বলতে সুবিধা হবে। চার চেয়ারের টেবিল। একপাশে তিনি, অন্য পাশে আমি। মুখোমুখি-দুহাত ব্যবধান। এরমধ্যে কেউ কেউ শাবানার সঙ্গে লাঞ্চ করার প্রত্যাশায় এগিয়ে আসলেন টেবিলটার দিকে। খুবই স্বাভাবিক-এত বড় সেলিব্রেটি। কিন্তু অভিনেত্রী তাঁদের বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিলেন এই বলে- আই অ্যাম টকিং উইথ দিস ইয়াং ম্যান। প্লিস গিভ আস সাম স্পেস। নিজের সৌভাগ্যে আমি বিস্মিত। পুরো ক্যান্টিনের চোখ তখন কর্নার টেবিলটার দিকে। সবাই নিশ্চয়ই ভাবছিলেন, কোথাকার কে হে এই ছোকড়া? শাবানা আজমির সঙ্গে বসে খাচ্ছে, কথা বলছে।
তিনি পরেছেন শাড়ি, মুখে হালকা মেকআপ। চুলগুলো পনিটেল করে বাঁধা, গলায় একটা মালা। সম্ভবত স্টোন পুতির। তিনিই প্রথম কথা শুরু করলেন। এখনো তো স্টুডেন্ট মনে হয়। কোথায় পড়ছো? খুব অবাক আমি। জানালাম, ঢাকা ইউনিভার্সিটি, মাস কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম। মনে হল খুশি হলেন তিনি। বললেন, জার্নালিজম আমারও খুব প্রিয়, কিন্তু হওয়া হলো না। বললাম, ভাগ্যিস হননি। তাহলে এমন অভিনেত্রী বিশ্ব মিস করতো। কথাটা শুনে মুখ টিপে হাসলেন। আমি খাবারের প্লেট সরিয়ে রেখে নোটবুক আর কলম নিয়ে পয়েন্ট নিতে শুরু করলাম। এটা দেখে তিনি চোখ কুঁচকে তাকালেন, হাঁসিমুখে বললেন, আগে খাবারটা খাও। হাতে হাফ অ্যান আওয়ার তো আছে? জানালাম, এমনিতেই মিনি ইন্টারভিউ, একটা পয়েন্টও মিস করতে চাই না।

এর পর কথা চললো নানা বিষয়ে। তাঁর কাজ, পরিবার, বাবা কাইফি আজমি, মা শওকত আজমি স্বামী জাভেদ আখতার, ছেলে ফারহান আখতার প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে আসলো। শাবানা আজমি জানতে চাইলেন, সিনেমা দেখা হয়? বললাম, ফিল্ম আবার খুব প্রিয়। আপনারও বেশ কিছু ছবি দেখেছি। এ প্রসঙ্গে অঙ্কুর ছবিটার প্রসঙ্গ তুললাম। জানালাম, কয়েকবার দেখেছি ছবিটা। এবার তিনি আমারই ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করলেন। জানতে চাইলেন, কেন? জানালাম, ভালো লেগেছে এ ছবির গল্প, ফটোগ্রাফি, গ্রামীণ লোকেশন, আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান, শেষ দৃশ্যে শিশুটার দ্রোহ আর সেই বৃষ্টির দৃশ্যটা। এবার শাবানা আজমির কাছে আবার অবস্থান আরো উজ্জ্বল হলো বলেই ধারনা জন্মালো। নিজেই বলতে শুরু করলেন, শ্যাম বেনেগালের ছবি। সত্যি ছিল সেই ঘটনাটা। যেখানকার ঘটনা, সেই জায়গাটাতেই শ্যুটিং হয়েছিলো, হায়দরাবাদে। আমার জীবনের প্রথম ছবি। সিনেমাটা সেরা ছবির ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলো। আমি বললাম, নিজের কথাটা বললেন না যে? প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করে সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার? আর বিশ্ব পেল এক শক্তিমান অভিনেতা? কথাটা শুনে তাঁর চোখে তখন অন্য আলো। জানতে চাইলাম অভিনয়ের বাইরে তাঁর অন্যান্য সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী কাজ সম্পর্কে। শিশু মৃত্যু কমানো, এইডস সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কর্মকাণ্ড, জাতিসংঘ পপুলেশন ফান্ডের দূত হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা বিষয়ে বলতে গিয়ে শাবানা আজমির উপলদ্ধি, জীবনটা খুব ছোট। তাই বসে থাকার সুযোগ নেই। কত কিছু করার যে আছে। সবশেষে বস্তিবাসীদের অধিকার আদায়ে তাঁর সংগ্রাম বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম মনে আছে। জানতে চেয়েছিলাম, চার দিনব্যাপী তাঁর সেই লংমার্চ, গেপ্তার হওয়া বস্তিবাসী নেতার মুক্তির দাবিতে শাবানার অন্দোলন, ধরনা, আদালতে-আদালতে ছুটে বেড়ানো, মামলা চালানো বিষয়ে।
সময় তখন শেষ হয়ে এসেছে। প্রটোকল অফিসার এসে তাগাদা দিয়ে গেছেন একদফা। কিন্তু আমার এ প্রশ্নটি শুনে তিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন। বললেন, আমরা শহরে যে আরাম আয়েশে থাকি, গোছানো- পরিপাটি জীবন কাটাই, তার সব আয়োজন ওই মানুষগুলো করে দেয়। শহরগুলোকে পরিস্কার রাখে, অনেক জটিল কাজ করে আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ করে দেয়, অথচ ওরাই থাকে সবচেয়ে অবহেলায়, কষ্টে। প্রশাসন, সরকার বারবার ওদের আশ্রয়হীন করে। অথচ কেউ বুঝতে চায় না, ওরা না থাকলে শহরগুলো মরে যাবে। ওরাও তো আমাদের মতই মানুষ। ওদের পাশে না দাঁড়ালে নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে যাবো আমরা।
শাবানা আজমির খাওয়া অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তারপরও আমার মত তখনকার তরুণ ও উঠতি এক সাংবাদিককে এতটা সময় দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতেই তিনি বললেন, তোমার সঙ্গে কথা বলে আমারো ভালো লেগেছে। উনি ক্যান্টিন ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই নোটগুলোর ওপর চোখ বুলাতে শুরু করলাম। কোথাও কী কোনো গ্যাপ থেকে গেলো? যদি থাকে, তাহলে তাঁকে আবার ধরতে পারবো- এমন একটা আত্মবিশ্বাস কেনো যেন আমার ভেতরে জন্ম নিয়েছিলো। সেমিনার কভারেজের দায়িত্ব ছিলো টুনটুনের। শেষ পর্যায়ে ওকে তাড়া লাগালাম। ঢাকা ফিরতে হবে রাস্তার জ্যাম ঠেলে। গাড়িতে বসে চোখে পড়লো সকালে মুখ দেখানো সূর্যটার বয়স বেড়েছে। অনেকটা হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। সাংবাদিকের জীবন। সাক্ষাৎকার তো নেওয়া হলো। কিন্তু সেটাকে সময় মত পরিপাটি করে লিখতে ও সাজাতে হবে। আজই পেস্টিং হবে এবং কাল সকালে পাঠকের হাতে পৌঁছাবে। ভেতরে ভেতরে সেই তাগিদের কারণে কিছুটা টেনশনও কাজ করছিলো। তারপরও মনের ভেতরে তখন প্রবল প্রশান্তি। শাবানা আজমি মিশন ইজ অ্যাকোম্পলিশড্ উইথ আ গ্রেট সাকসেস। এতটা সহযোগিতা পাবো কল্পনাতেও ছিলো না। তখন ভাবছিলাম একটা কথাই। কোথায় যেন পড়েছিলাম- গ্রেটনেসই একজনকে গ্রেট বানায়। আমার দেখা শাবানা আজমি ইজ আ গ্রেট পারসন।
চৌধুরী আফতাবুল ইসলাম : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক। সাংবাদিকতা: আজকের কাগজ, সমকাল, কালের কন্ঠ। বসবাস করছেন ক্যালিফোর্নিয়া, ইউএসএ।