লাল সবুজের কন্যারা -ফারিনা মাহমুদ

  
    
ফারিনা মাহমুদ

আমাদের যাদের জন্মভূমি আর আবাসভূমি আলাদা, তাদের মধ্যে প্রায়ই একটা “কি যেনো নেই কি যেনো নেই” ধরণের শূন্যতার দেখা মেলে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই শূন্যতার তালিকা যেমন দীর্ঘ তেমনই ব্যাপক। এই তালিকায় আপনি দিনে পাঁচ বেলা মসজিদের আযানের ধ্বনি থেকে শুরু করে গলির মুখের গরম ধোঁয়া ওঠা সিঙ্গাড়া পর্যন্ত সবই পাবেন। হাহাকার মানুষকে ছোটাছুটিতে তাড়িত করে… হোক সে কারণে বা অকারণে। আর এজন্যই আমরা বাংলাদেশ থেকে বন্ধু আত্মীয় কেউ বেড়াতে এলে যেমন পাগল হয়ে যাই তাকে কি দেখাবো, কি খাওয়াবো এই উচ্ছ্বাসে তেমনি দেশকে এদেশের মাটিতে কেউ যদি তুলে ধরতে আসেন, তাহলে তো কথাই নেই ! আমরা ছুটে যাই তাদের কাছে.. যেন এটাই শেকড়ের কাছে যাওয়া, শেকড়কে কাছে পাওয়া !

২৯ শে ফেব্রুয়ারি, চার বছরে একবার আসে দিনটা। তার উপরে শনিবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তেমনি একটি দিনে সাত সকালে চোখ কচলে উঠে সবুজ লাল শাড়িটা পরে রওয়ানা দিলাম জাংশন ওভাল স্টেডিয়ামে। সাথে ফেইস পেন্টিংয়ের যাবতীয় সরঞ্জাম।
আমি একা নই, মেলবোর্নের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসলেন অনেক আপু, ভাবীরা। কেউ কেউ আসলেন পরিবার নিয়েও। অসি বাংলা সিষ্টারহুড নামে প্রায় ১০ হাজার প্রবাসী অস্ট্রেলিয়ান মেয়ের একটি গ্রূপ আছে আমাদের। সেই গ্রূপে আলোচনার প্রেক্ষিতে একসাথে কেটেছি টিকেট। খেলার দিনে আমরা দলে দলে রওয়ানা হলাম ভেন্যুতে।

মেলবোর্নের জাংশন ওভালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের লাল সবুজের মেয়েরা

বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ডের মহিলা ক্রিকেট দলের খেলা, টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ! খেলার ফলাফল সবাই জানেন, আমি খেলা নিয়ে আসলে এখানে কথা বলতে আসিনি। এসেছি খেলাকে উপলক্ষ্য করে আমার/ আমাদের ভাবনাগুলোকে তুলে ধরতে।

টসের পরে খেলার শুরুতে আমাদের কন্যারা যখন মাঠে হেঁটে যাচ্ছিলো, আমি আমার নিজের হার্টবিট নিজেই শুনতে পাচ্ছিলাম। জাংশন ওভালের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমরা যখন চিৎকার করে আমার সোনার বাংলা গাইছিলাম, আমার সমস্ত শরীরে শিহরণ খেলে যাচ্ছিলো। হেঁটে যাওয়া এক একটি কন্যাকে মনে হচ্ছিলো গ্রিক পুরানের এক একজন দেবী। আমি অবাক বিস্ময়ে ওদের দেখছিলাম! সালমা, জাহানারা, ঋতু, ফাহিমা, শুকতারা, পান্না.. আমাদের লাল সবুজের কন্যারা। যে দেশে এখনো একটা মেয়ের রাতে দিনে একাকী চলার পথটি অমসৃণ, যে দেশে এখনো অনেকাংশেই একটি মেয়ের ভালো খারাপের মাপকাঠি তার চামড়ার মেলানিনের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল, সে দেশের কন্যারা.. বুকে হাত দিয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার মাইল দূরে অন্য এক ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে গাইছে- মা তোর বদন খানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি… ।
সে নয়ন জল ওদের একা ভাসায়না, আমাদেরও ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আমরা আবেগে বুকে হাত দিয়ে মাঠের কোনায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সোনার বাংলা গাই।
শ্বেতাঙ্গ ক্যামেরাম্যান অবাক বিস্ময়ে ক্যামেরা তাক করে তাকিয়ে থাকে… আমাদের আবেগ দেখে হয়তো ভাবে, এরা কারা রে! দেশকে বুঝি এতো ভালোবাসা যায় ?

চলছে লাল সবুজের পতাকা অঙ্কনের পালা।

বুকের খুব গভীরে আমি ঝড়ের শব্দ শুনি, ভাঙ্গনের শব্দ শুনি। যে ঝড় জীর্ণ সমাজের শত বছরের অন্ধকারকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। যে ভাঙ্গন ভাসিয়ে নিয়ে যায় চির অভ্যস্ত চোখে দেখা নারীর অবদমিত প্রতিবিম্ব।
লাল সবুজের কন্যারাই সে ঝড় তুলছে। ওদের হাত ধরেই বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসছে হাজার কন্যা !
এবার আমাদের আর কে রুখবে?

ফারিনা মাহমুদ
প্রদায়ক সম্পাদক, প্রশান্তিকা।
মেলবোর্ন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments