অনবদ্য অভিনয় গোলাম মোস্তফা এবং মৌসুমী মার্টিন। ছবি: অভ্র অধিকারী
শাখাওয়াৎ নয়ন: অভিবাসী মানুষের কোনো ঘর থাকে না। প্রবাস জীবন-যাপনকে আমার কাছে দড়ির উপর দিয়ে নিরন্তর হেঁটে যাওয়া মনে হয়। টানটান করে বাঁধা সেই দড়িটা মাটি থেকে ততখানি উচুতে, ঠিক যতখানি দূরে আমাদের মাতৃভূমি। অনেক উচুতে বাঁধা দড়িটার নিচে দৃশ্যত কোনো সেফটি নেট নেই; কিন্তু নিজ দেশ, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ভাষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জাতীয় গৌরব আছে। এসব কিছুই একজন প্রবাসীর মননে সেফটি নেটের মতো কাজ করে। সেখানে সে নিঃসংকোচে যা মন চায়, তাই বলতে পারে, নিজের ভাষায়। প্রবাসীরা তাই কারনে অকারনে নিজের দেশের গল্প করে; জাতীয় গৌরবের কথা বলতে ভালোবাসে। টাকা জমাতে না পারলেও ক্রেডিট কার্ডে টিকেট কিনে দেশে যায়। বারবার যায়, সারা জীবন ধরে যায়। যতখানি পৃথিবী দ্যাখে তার চেয়েও বেশি দ্যাখে নিজের দেশ আর মনে মনে গায় “আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ”।
“লীভ মি এলোন” আমাদের সর্বোচ্চ জাতীয় গৌরবগাঁথা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত একটি অসাধারণ নাটক। বাংলাদেশের বাইরে এত সুন্দর মঞ্চনাটক হয়, না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। নাটকটিতে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন-সাহসিকতা,‘অন্ধকারেও গন্ধরাজ ফুটবেই’ ধরনের আশাবাদ, ‘সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে’ ধরণের আত্মপীড়ন, বীরঙ্গনাদের আত্মত্যাগের বেদনা, পাক-হানাদার এবং আলবদর-আলশামস-রাজাকারদের বর্বরতা যেমন সবলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, ইতিহাস বিকৃতি, যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতকরণ, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী নানা রকম আজাদী সংগঠনের কর্মকান্ড দর্শকমনে দাগ কেটেছে, গভীরভাবে।
শিল্পই আমাদেরকে মানুষ করে। আবেগ-আপ্লুত করে, মানবিক করে, সুবোধ-বিবেককে জাগিয়ে তোলে। জন মার্টিনের রচনা ও নির্দেশনায় “লীভ মি এলোন” নাটকটিতে মৌসুমী মার্টিন এবং গোলাম মোস্তফার অভিনয় দর্শকদেরকে যারপরনাই আবেগ-আপ্লুত, অশ্রুসিক্ত করেছে। পালিয়ে এবং হারিয়ে যাওয়া ভীত-অন্ধ-মূক-বধির সুবোধকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে। ন্যায়-অন্যায়কে বলিষ্ঠভাবে চিহ্নিত করেছে, আলো-অন্ধকারের মতো।
শাখাওয়াৎ নয়ন
কথাসাহিত্যিক, একাডেমিক, ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।