
নট, নাট্য, নাটক এই তিনটি শব্দের মূল হলো নট। আর নট এর অর্থ হলো নড়াচড়া করা বা অঙ্গ চালনা করা, অর্থাৎ নাটক শব্দটির মধ্যেই রয়েছে ইঙ্গিত। মঞ্চে অভিনেতা অভিনেত্রীর সাহায্যে মানব জীবনের সুখ-দুঃখ ,হাসি -কান্না, আনন্দ-বেদনা যখন সংলাপের আশ্রয়ে দর্শকের সামনে উপস্তিত হয়, তখন দর্শক আর অভিনেতার মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরি হয় যা একই সময়ে একটি বাস্তবতাও তৈরি করে যাকে মঞ্চের বাস্তবতা বলে ।

‘লীভ মি এলোন’ নাটকে আমরা মঞ্চের সেই বাস্তবতকে খুঁজে পেয়েছি। নাটকের পটভূমি বাংলাদেশর স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড ও তার পরিক্রমা। ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ নিয়ে অনেক প্রশ্ন যা নাট্যকার এবং নির্দেশক মঞ্চে তুলে এনেছেন।সেই ১৬ বছর আগে প্রথম লীভ মি এলোন নাটকটি মঞ্চে নিয়ে আসেন নাট্যজন জন মার্টিন।এ পর্যন্ত সিডনি, ক্যানবেরা, মেলবোর্নে নাটকটির মঞ্চায়ন হয়েছে। সিডনিতে নাটকটির নিয়মিত মঞ্চায়ন দেখে নাট্যকর্মী হিসেবে আমরাও সাহস পাই। সেদিন হয়তো দূরে নয় যে প্রতি সপ্তাহে বা পাক্ষিকে কিংবা প্রতি মাসে এই সিডনিতে অন্তত একটি করে নাটক মঞ্চস্থ হবে।
মাত্র ১ঘন্টা ১০ মিনিট। এত অল্প সময়ে, এত বিশাল একটি সময়কে উপস্থাপন করা যেমন নির্দেশকের পক্ষে কঠিন, তেমনি অভিনেতার পক্ষেও কঠিন। অভিনেত্রী মৌসুমি মার্টিন দক্ষতার সাথে তার অভিনয়ের নিপুণতা দেখিয়েছেন, একই সাথে একটি চরিত্রকে ভেঙ্গে আর একটি চরিত্রে ধারন করেছেন। চরিত্রের মাঝে বর্ণা কখনো বীরঙ্গনা, কখনো সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। বর্ণা চরিত্রের মাঝে আমি সমগ্র বাংলাদেশর তরুণ প্রজন্মের প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিকে দেখতে পাই।

অবশ্যই নির্দেশকের ভূমিকা ছিল অন্যতম। নির্দেশক জন মার্টিন গল্পকে ভেঙ্গে একটি ভিন্ন মাত্রা দাঁড় করিয়েছেন। এটি অপূর্ব মাত্রার একটি নাটক। এতে আমরা সেই ভিন্ন মাত্রার একটি মিশ্র রীতি অবলম্বন হতে দেখি। নির্দেশক বাস্তবতাকে কখনো কখনো নিয়ে গেছেন বর্ণনাত্মক ধারা অবলম্বন করে। সেট ডিজাইনে ছিলো সাজেস্টিভ রীতির ছোয়া। সেটে যুদ্ধকালীন বা স্বাধীনতার সময়ের কিছু সাজেসন থাকলে হয়ত আরো অন্যরকম হত। আর দর্শকের সাথে অভিনেতার দূরত্বটা আরো একটু বেশী হলে আমার মনে হয় নাটকের ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার সাথে দর্শকের আন্ত:সম্পর্ক আরো গভীর হতো। অবশ্য সেরকম হল বা স্থান পাওয়াওতো এতো সহজ নয়।
মঞ্চে আলো একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ রোল প্লে করে। নাটকের বিশেষ মুহূর্ত, কাল , সময় অর্থাৎ নাটকের বাস্তবতাকে আমরা আলোর মধ্যে পাই। পরিচালনার পাশাপাশি জন মার্টিনের আলোক নির্দেশনার কথা না বললেই নয়। তিনি আলোর চমৎকার ব্যবহার করেছেন। আমার তো মনে হচ্ছিলো অনেক দিন পর যেনো শিল্পকলায় বা মহিলা সমিতিতে বসে নাটক দেখছি। আগের শোগুলোতে বাবা চরিত্রটি করেছিলেন গুণী অভিনেতা গোলাম মোস্তফা। তাঁর অভিনয় দেখার সৌভাগ্য হয়নি। শুনেছি এই নাটকে তিনি ছিলেন অন্ত:প্রাণ। তবে প্রথমবার এই চরিত্রটি করার সুযোগ পেয়ে তানিম মান্নান অসাধারন অভিনয় করেছেন। নির্দেশক বাবা চরিত্রটিকে এমন ভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন মনে হয়েছে সমগ্র জাতির বিবেক হয়ে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। লীভ মি এলোন -সংলাপ নির্ভর নাটক, কোরিওগ্রাফী নির্ভর নাটক নয়। তবে কিছু জায়গায় থিয়েট্রিকাল মুভমেন্ট রাখা যেতো নয় কি?
অসংখ্য ধন্যবাদ নাটকের সকল অভিনেতা, অভিনেত্রী এবং কলাকুশলীদের সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় মঞ্চ নাটক করার সাহস দেখানোর জন্য। যেহেতু নিজেও একজন মঞ্চকর্মী, আর পড়াশুনাও করেছি এই নাটক আর অভিনয় নিয়ে, তাই ভালো মানের একটি নাটক দেখে অনেক ভালোলাগা কাজ করেছে। আরো ভালো লাগছে এটা দেখে যে ,এই প্রবাসে একদল নাট্যপ্রেমী লোক নাটকের প্রতি অগাধ ভলোবাসার উপর ভর করে এই ব্যস্ত জীবনের মাঝে নিয়মিত নাটক চর্চা করছেন। আলাপনের কাছে নতুন আরো নাটকের প্রত্যাশায় রইলাম।
শাহীন আক্তার স্বর্ণা
সাবেক শিক্ষার্থী, নাটক ও নাট্যকলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বাবিদ্যালয়। মঞ্চ অভিনেত্রী,নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়,ঢাকা।
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সখের থিয়েটার, সিডনী।
প্রোগ্রাম ডিরেক্টর, জন্মভুমি টেলিভিশন অষ্ট্রেলিয়া।