লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান- একটু শুনুন । জন মার্টিন

  
    

ভেবেছিলাম অনেকে এক সাথে ‘লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান’ দেখব। কিন্তু লক-ডাউন আমাদের বাঁধা দিল। অতএব, আমরা আলাদা ভাবেই দেখতে বসলাম।
শুরুর আগে বলে রাখি, আমি অনেক দিন ধরে কাউন্ট ডাউন করছিলাম। ফেসবুকে, ব্যক্তিগত আলোচনায় রীতিমত ঝড় তুলেছি যে এই ওয়েব সিরিজটি অবশ্যই দেখা দরকার। তার দুটা কারণ ছিল যে এটা বাংলাদেশের একটি ওয়েব সিরিজ আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে যে এটা সারোয়ার তৈরি একটি ওয়েব সিরিজ। অনেকে চোখ রগড়িয়েছেন, কেউ চোখ কুঁচকিয়েছেন। আমি অনুরোধ করা বন্ধ করিনি। ধরে নিচ্ছি যে আমি যখন এই সিরিজটি দেখছিলাম- তখন আমার অনুরোধে আরো অনেকেই সেটা দেখছিল।

সিরিজটি শুরু হোল। বেশ চমক ছিল। শুরুতেই মেয়েটির উচ্চস্বরে চিৎকার – সবাইকে স্ক্রিনে আটকে দিল। আমাদের চোখ আটকে গেল। তারপর গল্প শুরু হোল। শুরুতেই গান এবং চমৎকার ‘পিকচারাইজেসন’  দিয়ে মুল চরিত্রের অনেক কথাই কিন্তু ডিরেক্টর আমাদের বলে দিলেন। আমার ভাল লেগেছে। কিন্তু সেই পর্বের বাকি অংশ আমাদের আর স্ক্রিনে ধরে রাখতে পারল না। প্রথম পর্বের শেষ দৃশ্যের গল্পের সুতো আমাকে যে ভাবে গল্পের পরের অংশ দেখার জন্য টানার কথা – আমি ঠিক তা অনুভব করলাম না। কিন্তু আমার প্রি-কন্সিভড অনুমান থেকে আমি ইচ্ছে করেই পরের পর্বে ক্লিক করলাম।

সিরিজের প্রধান চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন তাসনিয়া ফারিন।

শুরু হোল দ্বিতীয় পর্ব। গল্প ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। কিন্তু আমি কেন জানি – গল্পের বাকি অংশ জানার জন্য তেমন টেনশন অনুভব করছিলাম না। প্রতিটি পর্বে আমার ঠিক একই অবস্থা। ওয়েব সিরিজের প্রথম শর্ত হচ্ছে যে দর্শককে প্রতিটি পর্ব দেখার জন্য ‘নিমন্ত্রণ’ জানাতে হবে না – রীতিমত ‘নেশার’ ঘোরে পর্বগুলো দেখার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে তো তাই দেখছি। অনেক ওয়েব সিরিজ দেখতে বসে আটকে গিয়েছি! ঘড়ি দেখে চমকে উঠেছি। কিন্তু ‘লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান’ এর বেলায় আমি ঠিক সেই তাড়না অনুভব করলাম না।
গল্পটি এই ভাবেই ধীর লয়ে এগুলো।
গল্পের প্রচারণা দেখে অনুমান করতে পারিনি যে ‘লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান’ একটি ডিটেকটিভ নাটকে মোড় নিবে। একটি সময় ছিল যখন আমরা মাসুদ রানা আর দস্যু বনহুর পড়ে সময় কাটিয়েছি। তারপর সময় গড়িয়েছে অনেক! আমরা অন্যান্য চমৎকার ডিটেকটিভ গল্প পড়ার সুযোগ পেয়েছি। শরীরের লোম কাঁটা দিয়েছে। আর যদি টেলিভিশন সিরিজের কথা বলি তাহলে তো সিএসআই, ক্রিমিনাল মাইন্ডের কথা বলতেই পারি। আমরা দেখেছি ডিটেকটিভরা কিভাবে রহস্যের জট খুলেন। জটিল জট গুলোর কি চমৎকার বিশ্লেষণ এবং সমাধান! কিন্তু ‘লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান’ যখন রহস্য নিয়ে উপস্থিত হোল – আমি সেই জটিল বিশ্লেষণ দেখলাম না। অতি সাধারণ একটি সমাধান। নাহ……। আমার ভাল লাগেনি।

পরে মনে হোল – সরোয়ার নিশ্চয় এমন একটি সাধারণ রহস্যের গল্প বলতে চায়নি। আমি শেষ পর্বটি আবার দেখলাম। সরোয়ার কি অন্য কথা বলতে চাচ্ছে? আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এই সিরিজের প্রচারণা দেখলাম। মনে হোল সরোয়ার একটি ম্যাসেজ দিতে চাইছে। আমি এই সিরিজের উপর পোস্টারগুলো দেখলাম। সমস্ত প্রচারণায় ওই জেন্ডার অসমতার কথা। কিন্তু পুরো সিরিজটি দেখে আমি তো সেই বিষয়টি খুঁজে পেলাম না! পুরো সিরিজে আমি টের পেলাম না – কোথায় এবং কিভাবে পুরুষ ঈগো, মেয়েটির ন্যায্য বিচার পাবার অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করেছে। খুনি যা করেছে – সেটা তার রাগ, ক্ষোভ থেকে করেছে। খুনির চিন্তায় কোন ‘জেন্ডার’ এর উপাদান নেই। খুনি ‘চেতন’ অবস্থায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়নি যে – এই খুনের বিচার সে লুকাতে চাচ্ছে। অথবা এই বিচার হয়ে গেলে – তাঁর স্ত্রী তাঁর উপরে টেক্কা মারবে। হ্যাঁ হতে পারে এটা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটি শক্ত সামাজিক অবস্থান- যা আমাদের মন আর মননে বসে আছে। কিন্তু ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় – আমরা মেয়েটির স্বামী সম্বন্ধে এমন কোন গল্প শুনিনি যে আমাদের চিন্তায় অন্য কোন ভাবনা জায়গা করে নিবে।

নেটফ্লিক্স সহ বেশ কিছু চ্যানেলে অনেক ‘মাইন্ড ব্লয়িং’ সিরিজ দেখি। তাই ‘লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান’ এর প্লট – অতি সাধারণ মনে হয়েছে। এই বিষয় নিয়ে অনেক গল্প সিনেমা দেখেছি। তারমানে এই নয় যে এই গল্পগুলো আর বলা যাবে না। কিন্তু এই গল্পগুলোই যখন ভিন্ন ভাবে বলা যাবে – তখনই মনে হবে – অলস ভাবে এই বিষয়গুলো দেখার অভ্যাস বদলাতে হবে।
হ্যাং অন !
তার মানে আমি কি ‘লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান’ এর কোন প্রশংসা করবো না? দূর ……। এটা ভাবা ঠিক নয়। তাহলে শুরু করি।

আমি সরোয়ারের কাজ মনোযোগ দিয়ে দেখি। ‘লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান’ এর নির্মাণ কৌশল নিয়ে আমার কোন তির্যক মন্তব্য নেই। চমৎকার লোকেশন, সিনেমাটোগ্রাফি। কিছু কিছু ফ্রেম এখন চোখে লেগে আছে। পুরো সিরিজটি দেখে মনে হয়েছে যে নির্মাতা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে একটি ভাল  মুভি মেকিংএর জন্য।  কিন্তু সরোয়ার মেকিং স্টাইল যত না সিরিজটি এগিয়ে নিয়েছে – গল্পটি ততটা সাহায্য করেনি।
এটা হতে পারে যে আমরা প্রতিদিন অসংখ্য ওয়েব সিরিজ দেখি, সিনেমা দেখি। আমাদের চোখ এবং মন বদলে গ্যাছে। তাই ‘লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যান’ দেখতে গিয়ে আমাদের মনের মধ্যে একটি ‘স্কেল’ আমরা জুড়ে দিয়েছিলাম। আর সেই স্কেল দিয়ে এই সিরিজটি বিবেচনা করেছি।

এবার অভিনয় এর কথা বলি।
আফজাল হোসেন আমাকে বিস্মিত করেছেন। উনার অনেক মঞ্চ এবং টিভি নাটক দেখেছি। উনি কেমন অভিনেতা আমি জানি। এই সিরিজে আফজাল হোসেন আন্ডার টোনে অভিনয় করে চমৎকার একটি ‘ইনোসেন্ট’ ভাব তৈরি করেছেন যা দর্শককে বিরক্ত করে পারে। কিন্তু এই সিরিজে এমন চরিত্রায়ন দরকার ছিল। এবার মুল চরিত্রের কথা বলছি। তাসনিয়া ফারিন চমৎকার অভিনয় করেছেন। কিন্তু আমি যদি চোখ বুজে সিরিজটি দেখি তবে আমার মনে হবে চরিত্রটি তিসা করছে। কারণ ফারিন এর সংলাপ প্রক্ষেপণ এবং অভিনয় দেখে মনে হয়েছে মেয়েটি তিসাকে অনুকরণ করছে। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে প্রথম আর দ্বিতীয় পর্ব দুটি আবার শুনুন। হ্যাঁ – দেখবেন না কেবল চোখ বুজে শুনবেন। আর সময় করে তিসার যে কোন একটি নাটক আরেকবার দেখবেন। এমনও হতে পারে যে ডিরেক্টর ঠিক এমনই চেয়েছিলেন। অন্যদের অভিনয়ের ব্যাপারে মনে হয়েছে যে সংলাপগুলো আরো পরিষ্কার হওয়া দরকার ছিল। অনেকের সংলাপে ‘টেইল ড্রপ’ বেশ কানে লেগেছে।

সিরিজটিতে চমৎকার ফ্রেমিং আর গল্প বলার ঢং আছে! এই কাজের কৃতিত্ব নিশ্চয় ভাগ হবে আলেস্ক কসরুকভ আর রাজিবুল ইসলাম এর মাঝে। তবে আমি কৃতিত্ব দিব সরোয়ারকে। কারণ কাজটি ও বের করে নিয়েছে। কিন্তু একটি সিনেমা, একটি নাটক, একটি ওয়েব সিরিজ শুধুমাত্র ‘মেকিং’দিয়ে উৎড়ে যায় না। গল্পের গাঁথুনি আর টান টান আবেগ দর্শককে রাত ‘হারাম’করে সিরিয়াল দেখার জন্য অশরীরী হয়ে ডাক দেয়। এই সিরিজটির মেকিং যত সুন্দর – এর ‘স্টোরি লাইন’আমাকে সেই ভাবে টানেনি।

একটি গল্প দিয়ে শেষ করতে চাই।
আমি ছোট বেলা পাড়ার ছেলেদের সাথে আমাদের বাড়ী থেকে একটু দূরে মাঠে গিয়ে ক্রিকেট খেলতাম। সেই খেলায় কোন দর্শক ছিল না। তারপর আমাদের সেই দলের কেউ কেউ পাড়ার ক্লাবের সাথে খেলা শুরু করল। পড়ে দেখলাম কেউ কেউ জাতীয় পর্যায়ে খেলছে। আমি সেই খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই খেলা আমার আর ভাল লাগত না। কারণ আমার মনের মধ্যে ছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল খেলা’। আর আমি সেই খেলার সাথে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া খেলার একটি তুলনা করতাম। ঠিক একই ভাবে ‘লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যান’ দেখার সময়, আমার দেখা অনেক ডিটেকটিভ ছবির রেফারেন্স আমার মনে জেগে উঠেছে। এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু শেষ কথা হচ্ছে – এটা সরোয়ারের গল্প। যেহেতু এটা ওর গল্প – অতএব সরোয়ার ওর গল্প ওর মত করে বলবে। এটা আমার গল্প নয়। আমি গল্প নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কিন্তু গল্পের কোন কোন বিষয় আমাকে স্পর্শ করেনি – সেটা আমি বলতেই পারি। আমার গল্প নিয়ে আমি কাঁদতে পারি। কিন্তু আমার কান্না দর্শকের মাঝে ছড়াতে পারলাম কিনা সেটাই হচ্ছে মুনশিয়ানা। সরোয়ার এই গল্প বলার ক্ষেত্রে যত মুনশিয়ানা দেখিয়েছে – গল্পটির গাঁথুনিতে ততখানি মুনশিয়ানা দেখায়নি।

এবার শেষ কথা।
আমি সরোয়ারের অন্য কাজ দেখেছি। বিশেষ করে ওর শনিবার বিকেল এর কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশের মানুষ এখনো জানে না ওরা কি দেখেনি ! অত্যন্ত সুন্দর একটি কাজ। যা একবার নয় – বেশ কয়েকবার দেখা দরকার শুধু একটি বিষয় বুঝার জন্য – ছোট খাটো এই মানুষটি এমন চমৎকার কাজটি করল কি করে? আমি অপেক্ষা করবো – ‘শনিবার বিকেল’ কোন ওয়েব পোর্টালে খুব শীঘ্র দেখা যাবে। কারন আমি আর আরেকবার দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।
সরোয়ারের অন্য অনেক শুভ কামনা।

জন মার্টিন
নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা
প্রিন্সিপাল সাইকোলজিস্ট
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments