রাফসান রোহান: সাম্প্রতিককালে আমাদের জীবনযাত্রার ধরন বদলেছে। এখন মানসিক চাপ বা এক কথায় যাকে বলে স্ট্রেস আমাদের নিত্য সঙ্গী। পারিবারিক সমস্যা হোক কিংবা অর্থনৈতিক চাপ, বৈবাহিক সম্পর্কের অবনতি হোক কিংবা কাজের চাপ – একটা না থাকলে অন্যটা সঙ্গী হয়েই দাঁড়ায়। আর সেই স্ট্রেস উপশমে নানান সময় বিশেষজ্ঞরা নানান সমাধান দিয়ে থাকেন। কিন্তু একটু ভিন্নধর্মী সমাধান নজর কেড়েছে। স্ট্রেস উপশম করতেই আঁকাআঁকি করেন শর্মিষ্ঠা রায়।
ডিজিটাল আর্ট, ডিজিটাল ইলাস্ট্রেশন, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল পোর্ট্রেট ড্রয়িং, ক্রিয়েটিভ পোস্টার কিংবা কভার ডিজাইন, কার্টুন ড্রয়িং এবং টি-শার্ট ডিজাইনিং এসব করেই নাকি মানসিক প্রশান্তি পেয়ে থাকেন তিনি। শুরুটা ছিলো উচ্চমাধ্যমিকে পদার্থ বিজ্ঞানের জোটবাঁধা ধাঁধালো সমীকরণ সমাধানের স্ট্রেস থেকে। সেসময় ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বন্ধু-বান্ধবের খাতায় কিংবা বইয়ের খালি পৃষ্ঠায় নানান ধরনের কার্টুন এঁকে দিতেন। যা দেখে ভীষণ আনন্দিত হতো বন্ধু-বান্ধবেরা। তাদের উৎসাহ পেয়ে শর্মিষ্ঠা রায়ের আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক আরো বেড়ে যায়। নিজের অজান্তেই নিজের ভালো লাগার একটি জগৎ আবিষ্কার করে ফেলেন তিনি।
ভালো মানের সম্মানীর জন্যে মোটেও কাজ করতে আগ্রহী নন। নিজের আত্মতৃপ্তি এবং সৃজনশীলতার জায়গা থেকে কাজ করতে বেশি আনন্দ পান তিনি। বর্তমানে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি জুয়েলারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে যুক্ত আছেন। পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছেন চকবোর্ড নামক একটি ইন্টারেক্টিভ ডিজিটাল কনটেন্ট প্লাটফর্মের সাথে চুক্তিভিত্তিক গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে।
কাগজে আঁকাআঁকির বিশাল একটি ভাঙ্গা পরে গত লক ডাউনে। সেসময় ডিজিটাল আঁকাআঁকির দিকে খানিকটা ঝোঁকতে শুরু করেন তিনি। শুরুতে আকার সরঞ্জাম বলতে হাতের অ্যান্ড্রয়েড ফোনটাই ছিলো একমাত্র সম্বল। স্ক্রিনের উপর আঙুল দিয়ে আঁকাআঁকি করতেন। এরকমই একদিন বিকেলে নিতান্তই কৌতুহলবশত যামিনী রায়ের স্টাইল অনুকরণে ভিঞ্চির মোনালিসাকে আঁকার একটা প্রচেষ্টা চালান তিনি। অতঃপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করতেই প্রশংসার জোয়ারে ভেসে যেতে শুরু করে তার আঁকা ডিজিটাল ছবিটি। সেসময় স্বনামধন্য আর্টিস্টদের প্রশংসা এবং বাহবা পেয়ে ডিজিটাল ইলাস্ট্রেশন নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। কাজের ক্ষেত্র এক্সপ্লোর করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন শর্মিষ্ঠা রায়। যেমন বর্তমানে ওয়াটারকালার স্টাইলটা আয়ত্ত করার চেষ্টায় আছেন। নিজেকে শুধু যামিনী রায়ের স্টাইলে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না। তার করা সব ড্রয়িং পাবলিশও করা হয়নি। একটা খাতা রয়েছে, যেখানে হাবিজাবি এঁকে ভরাট করেন তিনি। স্ট্রেস রিলিভার হিসেবে কাজ করে সেটা।
বর্তমানে পড়াশোনা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে। উচ্চ মাধ্যমিক এবং মাধ্যমিক দুটোই শেষ করেছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজগুলো চালিয়ে নেওয়া একটু চ্যালেঞ্জিং তো বটেই। পরীক্ষা, কুইজ, অ্যাসাইনমেন্টের প্রেশার তো থাকছেই। শর্মিষ্ঠা রায় দুই দিকেই ব্যালেন্সড রাখার চেষ্টা করেন। সেকালের কথাই আবারো এলো স্ট্রেস রিলিভ করতে কিংবা একদমই খারাপ সময়গুলোতেও তিনি ঠাই খুঁজে পেয়েছেন ওই কাগজ, পেন্সিল, রঙের বাক্সতেই। ওসব একটানা বহুদিন করতে না পারলে একরকম শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হোন তিনি। যেকোনো গান কিংবা সিনেমা অথবা ওয়েব সিরিজ নতুবা ঘটনা – সেটা নিয়ে কিছু একটা আঁকাআঁকির আড়ালে গল্প ফুটিয়ে তুলতে ভালোবাসেন। যেটা হতে পারে অনেকটা ট্রিবিউটের মতোই। ট্রিবিউট হচ্ছে শ্রদ্ধা বা গুণমুগ্ধতা প্রকাশ্যে কিছু করা।
শর্মিষ্ঠা রায় সাম্প্রতিক কিছু পোস্টার ইলাস্ট্রেশন করেছিলেন। তারমধ্যে হাওয়া সিনেমার ভাইরাল হওয়া গান ‘সাদা সাদা কালা কালা’ নিয়েও একটি ভিন্নধর্মী ইলাস্ট্রেশন পোস্টার রয়েছে।
বহুল আলোচিত সৈয়দ আহমেদ শাওকী পরিচালিত ‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজটার উপর তকমা লাগানো পোস্টার ইলাস্ট্রেশন করেছিলেন তিনি। যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ওয়েব সিরিজটার পরিচালক, কলা কৌশলীরা এবং অভিনয়শিল্পীরা। আরো রয়েছে বেলাবোসের ওপর ইলাস্ট্রেশন পোস্টার, সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে এক খানা কার্টুন আর্ট যা দুই বাংলায়ই ভালো সাড়া ফেলেছে। এসব কাজগুলোয় খ্যাতনামা আর্টিস্ট এবং শর্মিষ্ঠা রায়ের শুভাকাঙ্খী বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে যে পরিমাণ উৎসাহ কুড়িয়েছেন তা অকল্পনীয়। যেটা বিশাল অনুপ্রেরণা এবং সাপোর্ট হিসেবে কাজ করছে।
বাবা-মা বরাবরই চেয়েছেন দুই ভাই-বোনকে প্রয়োজন অনুসারে সবকিছুই দিতে। পড়াশোনা ঠিক রেখে আঁকাআঁকি, সঙ্গীত কিংবা নৃত্য সবকিছুতেই পারদর্শী হবার অনুমতি রয়েছে পরিবার থেকে। শর্মিষ্ঠা রায়ের করা পেইন্ট ক্যানভাসগুলো মা ঘরে ঘরে সাজিয়ে রেখেছেন যত্নে। শুধু তাই নয় নতুন কোনো কাজ করতে দেখলে উৎসাহ ও আনন্দ ভরা মুখে ছুটে আসেন দেখতে।
অ্যানিমেশন জগতে পা ফেলতে চান ভবিষ্যতে তিনি। এছাড়া নিয়মিত আঁকাআঁকি করে হাত পাকানোর চেষ্টা চলছে। এখন ব্যস্ততা ‘স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ান’ নামে একটা ড্রয়িং সিরিজ ও প্রোগ্রামিং নিয়ে। সিরিজটা এখনো একদম শুরুর পর্যায়ে রয়েছে। মনমতো হলে শীঘ্রই এটা নিয়েও পোস্টার ইলাস্ট্রেশন দেখা যাবে তার ফেসবুক পেইজ উল্টা ঘুড়ি এবং ব্যক্তিগত প্রোফাইলে।